চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য,Chandragupta Maurya

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব । Achievement of Chandragupta Maurya

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব-র ( Achievement of Chandragupta Maurya ) বলে মৌর্যবংশের শাসন ভারতে এক নবযুগের সূচনা করেছিল। ভারতবর্ষ এক বিশালাকার ভূখণ্ড।

অতীতে বহু রাজবংশের শাসনের কাহিনী এদেশের প্রতিটি কণায় মিশে আছে। আর এই কাহিনীর মূলে রয়েছেন কোনো না কোনো শাসক।

প্রাচীন ভারতের বুকে এমনই এক রাজবংশের নাম মৌর্য রাজবংশ। সেই মৌর্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

যদি সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্যের কথা বলা হয়, তাহলে তা অবশ্যই মৌর্য সাম্রাজ্য। একথা সর্বজনবিদিত। আর এই মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রথম শাসক তথা বৃহৎ সাম্রাজ্যকার হলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

সুপ্রাচীনকালে মগধই ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। একসময় মগধের সিংহাসনে রাজত্ব করেছিল শিশুনাগ বংশ।

কিন্তু এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে শিশুনাগ বংশের পতন ঘটে নন্দবংশের শুরু হয়েছিল। শেষ নন্দ শাসক ধননন্দের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে উঠেছিল মগধ সাম্রাজ্য।

আবার ঠিক সেইসময়ই ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশ বিদেশী গ্রীকদের দখলে চলে যায়। সেসময় ভারতের অবস্থা বেশ সংকটজনক।

এমন পরিস্থিতিতে মগধের সিংহাসনের যোগ্য দাবীদার হিসেবে আবির্ভাব ঘটে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের।

তাঁর নেতৃত্বে মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাকে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

যদিও দেশের এইরকম প্রতিকূল পরিস্থিতি চন্দ্রগুপ্তের সিংহাসনে বসার জন্য অনুকূল ছিল। তবে কোন কৃতিত্বের ফলে একাজ সম্ভব হয়েছিল সেটাই এখানে আলোচিত হবে।    

chandragupta maurya,চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য,চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব নিরূপণের আগে তাঁর বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানা জরুরী। তবে একথা প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসনে বসেননি।

চন্দ্রগুপ্তের জন্মস্থান পাটলিপুত্র। চন্দ্রগুপ্তের বংশকৌলিন্য ছিল না। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্থানের বিষয়টি খুবই রোমাঞ্চকর।

তাঁর বংশপরিচয় নিয়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সাহিত্যে অনেককিছু বলা আছে।

এই যেমন, গ্রীক লেখক জাস্টিনের এপিটোমগ্রন্থে বলা হচ্ছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন ‘সাধারণ বংশজাত’ সন্তান।

ভারতীয় কবি, দার্শনিক ক্ষেমেন্দ্র ও সোমদেবের রচনায় চন্দ্রগুপ্তকে জানা যাচ্ছে ‘নন্দ সূত’ বা নন্দ রাজার পুত্ররূপে।

বিশাখদত্তের রচিত মুদ্রারাক্ষস গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্তকে বলা হচ্ছে ‘বৃষল’ ও ‘কুলহীন’। এর অর্থ শূদ্র সন্তান। এইসব গ্রন্থের মতে চন্দ্রগুপ্তের মা মুরা ছিলেন শেষ নন্দরাজার উপপত্নী।

সেকারণে মুরা নাম থেকেই মৌর্য কথাটি এসেছে।

কিন্তু জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থ যথা পরিশিষ্টপর্বণ ‘, ‘মহাবংশ ‘, ‘মহাপরিনির্বাণ সুত্ত ‘ তে চন্দ্রগুপ্তকে মোরীয় গোষ্ঠীর ক্ষত্রিয় বংশজাত বলা হয়েছে।

বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে প্রাচীন উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের পিপ্পলীবন নামক স্থানে ক্ষত্রিয় মোরীয়দের গণরাজ্য ছিল।

আর চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন এই মোরীয় গোষ্ঠীরই অন্তর্ভুক্ত।

তাই চন্দ্রগুপ্তকে একেবারে নীচ বংশজাত বলা যাবে না। তাই এই মোরীয় নাম থেকেই মৌর্য নামটির সৃষ্টি হয়েছিল, এই মতকেই আধুনিক ঐতিহাসিকরা সীলমোহর দিয়েছেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব জানতে হলে তাঁর প্রথম জীবন সম্পর্কে জানা জরুরী। সেই সম্পর্কে তথ্যও খুবই কম। তবে যেটুকু তথ্য পাওয়া যায়, তা বৌদ্ধ ঐতিহ্য থেকেই।

জানা যায় চন্দ্রগুপ্তের পিতা ছিলেন মোরীয় গোষ্ঠীর একজন নেতা। মগধের অত্যাচারী রাজা ধননন্দের দ্বারা সীমান্ত সংঘর্ষে পিতার মৃত্যু ঘটে।

জীবনের একেবারে গোড়ার দিকে গোপালকের ভূমিকা পালন করলেও একসময় চন্দ্রগুপ্ত নন্দরাজাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।

সম্ভবত পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধের কারণেই এমনটা হয়েছিলেন।

পাটলিপুত্র থেকে পালিয়ে চন্দ্রগুপ্ত পাঞ্জাবে গ্রীক শিবিরে চলে আসেন এবং এখানে অস্ত্রশিক্ষা রপ্ত করেন। এরও পরে তিনি বিন্ধ্য পর্বতের জঙ্গলে এসে উপস্থিত হন।

জঙ্গলের উপজাতিদের নিয়ে সেনাদল গঠনের চেষ্টা করেন। খুব সম্ভবত এখানেই চন্দ্রগুপ্তের প্রতিভা চাণক্য বা কৌটিল্যের নজরে আসে।

ইতিমধ্যেই পাঞ্জাবে দিগ্বিজয়ী গ্রীক রাজা আলেকজান্ডারের কাছে মহারাজ পুরু গৌরবজনক পরাজয় বরণ করেছেন। সময়কাল ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

অন্যদিকে তক্ষশীলার রাজা অম্ভী আলেকজান্ডারের বশ্যতা স্বীকার করে তাঁকে উপঢৌকন প্রদান করেন।

কৌটিল্যের উদ্দেশ্যই হোলো ভারতের রাজনৈতিক জীবনকে কলুষতা মুক্ত করা। কিন্তু একাজে পাশে পাবেন কাকে ?

পরিচয় হোলো চন্দ্রগুপ্তের সাথে। প্রথম সাক্ষাতেই চন্দ্রগুপ্তের মধ্যে যে প্রবল সম্ভাবনা আছে তা বুঝতে বাকি রইল না চাণক্য বা কৌটিল্যের।

আবার নন্দরাজাদের পতন ঘটাতে চন্দ্রগুপ্তেরও দরকার ছিল কৌটিল্যের মতো অসাধারণ কূটনীতিকের।

চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে যুদ্ধবিদ্যা, শাস্ত্র প্রভৃতিতে পারদর্শী করে সুযোগ্য সহযোগী তৈরী করলেন। গঠন করলেন সেনাদল।

একজন ব্রাহ্মণের শক্তিশালী কূটনীতি এবং একজন ক্ষত্রিয়ের শৌর্য মিলেমিশে নন্দবংশের পতন ঘটালো। চাণক্য বা কৌটিল্য হলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী।

খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪ অব্দে শেষ নন্দ রাজা ধননন্দকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে বসলেন। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হোলো।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব চন্দ্রগুপ্তের প্রতিভা ও বাস্তব বুদ্ধির মধ্যেই লুকায়িত ছিল। এই কৃতিত্বের দাবীদার অনেকাংশেই চাণক্য। চন্দ্রগুপ্তের মহৎ হয়ে ওঠার নানা লক্ষণ ও গুণাবলী চাণক্যই অনুভব করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব নিরূপণ করা হয় প্রধানত চারটি কাজের ওপর ভিত্তি করে।

(১) মগধ থেকে নন্দবংশের উচ্ছেদ করা। (২) উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে গ্রীকদের হটানো। (৩) ভারতের বিশাল এলাকা জুড়ে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার করা। (৪) দক্ষ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা।

কিন্তু পরে পাটলিপুত্র হয়েছিল মগধের রাজধানী।

মগধের মাথা তুলে দাঁড়ানোর অহংকারই ছিল এর অবস্থান, প্র্রাকৃতিক সম্পদ, মজবুত কৃষি অর্থনীতি ।

বিম্বিসার থেকে শুরু করে অজাতশত্রু, উদায়িন, শিশুনাগ, মহাপদ্মনন্দ, ধননন্দ, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রমুখেরা মগধ শাসন করেছেন।

কিন্তু মগধের ইতিহাসে নন্দরাজাদের শাসনকাল লজ্জাজনক।

বিশেষ করে এগ্রামেস বা ধননন্দের শাসনের প্রতি মগধবাসীরা ছিলেন বীতশ্রদ্ধ। ধননন্দের দুর্ব্যবহার, নিষ্ঠূরতার থেকে পরিত্রাণের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হন চন্দ্রগুপ্ত।

যদিও বালক অবস্থায় চন্দ্রগুপ্ত আলেকজান্ডারকে মগধ আক্রমণ করতে দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মগধ থেকে স্বৈরাচারী শাসন ধ্বংস করা।

যদিও আলেকজান্ডার এইরকম দুঃসাহসের কথা শুনে চন্দ্রগুপ্তের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন।

পরবর্তীকালে চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধ থেকে নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধন করেছিলেন। নিজের দূরদৃষ্টি, প্রতিভা, বাস্তব বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে মগধের রাজদণ্ড লাভে সফল হয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব কেবল নন্দবংশের উচ্ছেদেই আটকে নেই। উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে বিদেশী গ্রীক শক্তিকে হটানোও চন্দ্রগুপ্তের অন্যতম কৃতিত্ব।

রত্নগর্ভার দেশ ভারতবর্ষ। সেই রত্নভাণ্ডারকে লুঠ করতে বিদেশীদের লোলুপ দৃষ্টি সদা জাগ্রত ছিল। গ্রীকরাই বা পিছিয়ে থাকবে কেন।

সুদূর গ্রীসের ম্যাসিডনের গ্রীক রাজা আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণের নায়ক।

৩২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে ভারতের রাজ্যগুলি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। কিন্তু পাঞ্জাবের রাজা পুরু বশ্যতা মানেননি।

বরং বীরবিক্রমে গ্রীকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পরাজয় বরণ করেন। এদিকে মগধে ধননন্দের আমলে ভারতে গ্রীক অভিযান ঘটলেও ধননন্দ শাসক হিসেবে সক্রিয়তাই দেখাতে পারেননি।

গ্রীক শাসনের পরাধীনতা উত্তর-পশ্চিম ভারতের মানুষজন মেনে নিতে না পেরে বিদ্রোহ করেছিলেন।

৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর স্যান্ড্রোকোট্টস বা চন্দ্রগুপ্তই গ্রিক শাসনের ওপর আঘাত হানেন। ভারতের সেই স্বাধীনতার যুদ্ধের নায়ক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

তবে ভারত থেকে গ্রীক শাসনকে পুরোপুরি হটাতে চন্দ্ৰগুপ্তকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল। আলেকজান্ডারের সেনাপতি সেলুকাস গ্রীকদের হারানো রাজ্যগুলিকে ফিরে পেতে পুনরায় আক্রমণ করেন।

সেলুকাসের আক্রমণের সময় ভারত এক যোগ্য নেতার নেতৃত্বাধীন। গ্রীক লেখক স্ট্রাবো-র রচনা থেকে জানা যায় সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন।

সন্ধি স্বাক্ষর করে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট, বালুচিস্তান চন্দ্রগুপ্তকে অর্পণ করেন। সেলুকাসের কন্যা হেলেনকে চন্দ্রগুপ্ত স্ত্রী রূপে গ্রহণ করেন।

অপর পক্ষে চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০টি হাতি উপহার দেন। সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্রে চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় আসেন।

মেগাস্থিনিস ‘ইন্ডিকা ‘ ( Indica ) নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ইন্দো-গ্রীক সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্বের আরেকটি ধাপ গ্রীক শাসনের শৃঙ্খল থেকে ভারতকে মুক্ত করা।

গ্রীক লেখকরা বর্ণনা দিয়েছেন যে, প্রায় ৬লক্ষ সৈন্যের দ্বারা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতবর্ষকে অধিকারে রেখেছিলেন।

মৌর্য সম্রাট অশোক জীবনে একটি যুদ্ধই লড়েছিলেন তা হোলো কলিঙ্গ যুদ্ধ। এই তথ্যের উৎস অশোকের নিজের শিলালেখ।

তাই সম্রাট অশোক শাসিত মৌর্য সাম্রাজ্যের বেশিরভাগটাই পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের আমলের। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাম্রাজ্যের সীমা পূর্বে বাংলা থেকে পশ্চিমে আরব সাগর, কাবুল পর্যন্ত ছিল।

অপরদিকে দক্ষিণে মহীশূর, তামিলনাড়ু থেকে উত্তরে হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এইসমস্ত স্থানে পাওয়া শিলালেখ গুলি থেকেই এই তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে।

ভাবলে আশ্চর্য হতে হয় যে, এতবড় সাম্রাজ্য এর আগে কেউ বিস্তার করতে পারেনি।

সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় চন্দ্রগুপ্ত সৌরাষ্ট্রে বিখ্যাত ‘সুদর্শন হ্রদ ‘ ( Sudarshan Lake ) নির্মাণ করেছিলেন। যদিও এই হ্রদ তৈরিতে রাজকর্মচারী পুষ্পগুপ্তের বিশেষ সহায়তা পান তিনি।

ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ‘। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীও একই সুরে বলেছেন, ‘চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট ‘।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব সুশাসন প্রবর্তনেও। শুধু মৌর্য সাম্রাজ্যের স্থাপনা করেই ক্ষান্ত থাকেননি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

একটি নতুন প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যকে দীর্ঘায়ু করতে যে ধরণের শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন তা বেশ ভালোই অনুভব করেছিলেন তিনি।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় শাসনের শীর্ষে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। সম্রাটই সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং সর্বেসর্বা।

তবে মন্ত্রী, অমাত্য, দৌবারিক, গুপ্তচর, সচিব, দুর্গপাল প্রমুখ কর্মচারীবৃন্দ সম্রাটকে রাজকার্যে সাহায্য করতেন।

সাম্রাজ্যকে চারটি প্রদেশে ভাগ করে ‘আর্যপুত্র‘ নামক কর্মচারীকে প্রদেশের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত। জনপদের শাসনের দায়িত্ব দেন ‘গোপদের‘।

গ্রাম শাসনের জন্য নিযুক্ত করেছিলেন ‘গ্রামিক‘ নামক কর্মচারীদের। ভূমি রাজস্বই ছিল মৌর্য রাজকোষের প্রধান আয়। সেখানে ভাগবলি নামক কর চালু ছিল।

বিচার ব্যবস্থায় বিচারের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন সম্রাট স্বয়ং। দুরকমের বিচারালয় চন্দ্রগুপ্ত স্থাপন করেন, ধর্মাস্তেয়কণ্টকশোধন

দণ্ডবিধিতে কঠোরতা ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে প্রায় ১৮ রকমের দণ্ডের কথা জানা যায়।

নগরের শাসন পরিচালনা করতেন ৩০ জন সদস্য যুক্ত নগর পরিষদ। এছাড়াও নগর শাসনে অস্তিনময়নগরাধ্যক্ষ কর্মচারীরাও ছিলেন।

সামরিক শাসনব্যবস্থায় পদাতিক, অশ্বারোহী, হস্তীবাহিনী, রথ বাহিনী বিভাগের দায়িত্ব পালন করতো বলাধ্যক্ষ কর্মচারীগণ।

চন্দ্রগুপ্তের পুরো শাসনকালকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি নিষ্ঠূর প্রকৃতির শাসক ছিলেন না। যদিও গ্রীক লেখক জাস্টিনের বিবরণে অন্য কথা বলা আছে।

বলা হয়েছে উত্তর-পশ্চিম ভারতের জনগণকে গ্রীক দাসত্ব থেকে মুক্ত করলেও পরে চন্দ্রগুপ্ত তাঁদের নিজ দাসত্বে আবদ্ধ করেন।

কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকেরা এই বিবরণকে খণ্ডন করেছেন। আসলে চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে বেশ কিছু প্রজাকল্যাণমূলক কাজ হয়েছিল।

এসবের চাইতেও নন্দবংশের ধ্বংস, গ্রীকদের থেকে দেশরক্ষা, সুশাসন প্রবর্তন, ইন্দো-গ্রীক সম্পর্ক মধুর করা চন্দ্রগুপ্তের জনহিতকর কার্যাবলী বটে।

ভারতীয় উপমহাদেশে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ইতিহাসে তা প্রমাণিত। গোটা ভারতবর্ষ ব্যাপী একটি বিশাল সাম্রাজ্যের জন্মদাতা চন্দ্রগুপ্ত। ইতিহাসে তিনি প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট হিসেবে প্রশংসা পেয়েছেন। যা সত্যিই যথার্থ।

এতবড় সাম্রাজ্য এর আগে কেউ বিস্তার করতে পারেনি। চন্দ্রগুপ্ত শূদ্র না ক্ষত্রিয় এনিয়ে ইতিহাসে কম বিতর্ক হয়নি।

চাণক্যকে সাথে নিয়ে অত্যাচারী নন্দরাজাদের মগধ সিংহাসন থেকে টেনে নামিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের।

কিশোর অবস্থায় গ্রীকবীর আলেকজান্ডারকে মগধ আক্রমণ করতে দুঃসাহস দেখিয়েছেন। আবার ক্ষমতায় এসে সেই গ্রীক আধিপত্যকে খর্ব করেছেন। ভারতবর্ষকে বিদেশী পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত করেছেন।

পাশাপাশি ইন্দো-গ্রীক সম্পর্কের সেতুবন্ধন করে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেন। শাসক হিসেবে সুশাসন প্রবর্তন করে মহৎ কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছেন।

এইসব কারণেই চন্দ্রগুপ্ত ভারতীয় উপমহাদেশে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিলেন।

চন্দ্রগুপ্তের শেষ জীবন সম্পর্কে ইতিহাসে খুবই কম তথ্য পাওয়া যায়। একমাত্র জৈন ঐতিহ্য থেকে জানা যায় চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন ত্যাগ করে জৈন ধর্মে প্রভাবিত হন। জৈনগুরু ভদ্রবাহু তাঁকে দীক্ষিত করেন। জীবনের শেষভাগে দক্ষিণ ভারতের মহীশূরে শ্রবণবেলগোলা-য় এসে তপস্বীর জীবন বেছে নেন। এই শ্রবণবেলগোলা-তেই চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যু ঘটেছিল। সময়কাল ২৯৫ খ্রীস্টপূর্বাব্দ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!