কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র । Kautilyas Arthashastra in bengali

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ( Kautilyas Arthashastra ) ভারত ইতিহাসের এক অতি মূল্যবান গ্রন্থ। ভারতের প্রাচীন ইতিহাস জানতে আমরা দেশীয়, বিদেশীয় বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থের সাহায্য নিয়ে থাকি।

যদি দেশীয় সাহিত্যের কথা বলা হয় তাহলে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কথা উল্লেখ করা বাঞ্চনীয় হবে।

শুধু মৌর্যযুগ নয়, প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ এই গ্রন্থখানি।

প্রায় ছয়হাজার শ্লোকের সমষ্টিতে রচিত অর্থশাস্ত্র। সংস্কৃত ভাষায় লিখিত অর্থশাস্ত্র আচার্য কৌটিল্যকে ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে।

এই অতি প্রাচীন বৃহৎ গ্রন্থটির লিখনশৈলী অন্যরকমের।

সংক্ষিপ্ত এবং জোরালো দুটোই। ইংরেজিতে এইরকম রচনার ধরণকে aphoristic style বলা হয়।

অর্থাৎ সংক্ষিপ্ত বাক্যে অল্প শব্দ ব্যবহার করে সত্যকে প্রকাশ করা।

রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের উপর অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু দাড়িয়ে আছে।

রাষ্ট্র পরিচালনা কেমনভাবে হবে, রাজার কর্তব্য কি হবে এইসব কিছু জানার মূল্যবান গ্রন্থ অর্থশাস্ত্র।

তবে অর্থশাস্ত্র রচয়িতা কৌটিল্য বা চাণক্য একজন বিতর্কিত চরিত্র।

ইতিহাস সাক্ষী কিভাবে তিনি বুদ্ধি, কৌশল খাটিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দ্বারা নন্দবংশের উচ্ছেদ করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত, মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ইতিহাসের এই ঘটনা হয়তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু সেই জানার চাইতেও আরও জানা দরকার অর্থশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি সম্পর্কে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র,Kautilyas arthashastra
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র

Table of Contents

ঠিক এই সময়কালে চাণক্য বা কৌটিল্যের নজরে আসে চন্দ্রগুপ্তের মতো প্রতিভাবান, বাস্তব বুদ্ধির সম্পন্ন ব্যক্তি।

কৌটিল্য অনুভব করলেন ভারতের রাজনৈতিক-নৈতিক জীবন কলুষতা মুক্ত হওয়া দরকার।

তার জন্য প্রয়োজন ছোটো ছোটো রাজ্যগুলিকে নিয়ে বৃহৎ শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠনের। কার্যত এই উদ্দেশ্যেই চন্দ্রগুপ্তকে সুযোগ্য তৈরী করে নন্দবংশ ধ্বংস করেন কৌটিল্য।

অতঃপর ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধের সিংহাসনে বসেন। আলেকজান্ডার ভারত জয়ের জন্য দিগ্বিজয়ে বের হয়েছিলেন।

ভারতে তক্ষশীলার রাজা অম্ভি আলেকজান্ডারের বশ্যতা মেনে নিয়ে উপঢৌকন বাবদ কিছু প্রদান করেছিলেন।

কিন্তু পাঞ্জাবের মহারাজ পুরু দেশপ্রেমিকের পরিচয় দিয়ে আলেকজান্ডারের সাথে যুদ্ধ লড়েন। ৩২৬ খ্রি :পূ : হিদাস্পিসের যুদ্ধে পুরুর গৌরবজনক পরাজয় হয়।

এইসমস্ত ঘটনা কৌটিল্যকে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আরও বেশি আগ্রহী করে তোলে।

কৌটিল্য বা চাণক্যের রচিত অর্থশাস্ত্রের সংস্কৃতে নাম ‘কৌটিলিয়ম অর্থশাস্ত্রম‘। বাংলা করলে দাড়ায় ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র‘। বিশাল একটি গ্রন্থ অথচ লিখনশৈলী সংক্ষিপ্ত। অর্থশাস্ত্রে রয়েছে ৬০০০টি শ্লোক, ১৫টি অধিকরণ বা বুকস এবং ১৫০টি অধ্যায় বা চ্যাপ্টার্স। গ্রন্থটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের ওপর জোরালো তথ্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন শ্যাম শাস্ত্রী মহাশয়। পেশায় তিনি ছিলেন মহীশূরের গভর্ণমেন্ট ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরীর লাইব্রেরিয়ান।

সংস্কৃতে লেখা গ্রন্থটির খানিকটা অংশ পড়ে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, গ্রন্থটি রাষ্ট্র পরিচালনার ওপর লিখিত মহামূল্যবান গ্রন্থ ( statecraft )।

যতদূর জানা যায় শ্যাম শাস্ত্রীর উদ্যোগেই অমূল্য গ্রন্থখানি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশিত হয় ১৯০৯সালে। ইংরেজিতে গ্রন্থটি অনূদিত হয় ১৯১৫ সালে।

কৌটিল্য বা চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে রাজার কর্তব্য, প্রশাসন ইত্যাদি সম্পর্কে নানা তথ্য আছে। অর্থশাস্ত্রের মতে, রাজাই হবেন রাজ্যের সর্বেসর্বা।

তবে তিনি স্বেচ্ছাচারী হবেন না। রাজা বিনয়ী হবেন এবং তাঁর যথেষ্ট বিদ্যাশিক্ষা থাকবে।

রাজা কোনোরকম প্রলোভনে পা না দিয়ে নিজের চিন্তাভাবনার দ্বারা রাজ্য শাসন করবেন। চাকার যেমন নিজের থেকে চলার ক্ষমতা নেই, তেমনি রাজার পক্ষেও একা শাসন চালানো সম্ভব নয়।

শাসন পরিচালনার জন্য দরকার মতো কর্মচারী নিয়োগের নির্দেশ অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে।

এছাড়াও প্রয়োজনে রাজা গুপ্তচর প্রয়োগ করে রাজ্যশাসন করতে পারেন। আবার প্রয়োজন পড়লে গোপনে বধদণ্ডের ব্যবহার করার ক্ষমতাও রাজা প্রয়োগ করতে পারেন।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র রাষ্ট্রনীতি বা রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের উপর লিখিত একটি গ্রন্থ।

কিন্তু একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে চলা দরকার সেবিষয়ে পূর্ণ আলোকপাত করা হয়েছে অর্থশাস্ত্রে। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র তখনই মজবুত থাকবে যখন অর্থনৈতিক মেরুদন্ড শক্তিশালী হবে।

আর হয়তো কৌটিল্য এটি উপলব্ধি করেছিলেন। তাই রাষ্ট্রের রাজস্ব আদায় ও তা বিভিন্ন খাতে খরচের ব্যাপারে অর্থশাস্ত্রে নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে।

কৃষিজ, বনজ, দুগ্ধ, আমদানি-রপ্তানি ইত্যাদিকে কৌটিল্য রাজস্ব আদায়ের উৎসের কথা বলেছেন।

আশ্চর্যের বিষয় হল প্রায় ২৪০০ বছর আগেই কৌটিল্য এই কথা চিন্তা করেছেন।

রাষ্ট্রের আদায় করা রাজস্বের ব্যয় সমাজ কল্যাণ, জলসেচ, পুকুর খনন, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের নীতি নির্ধারণের কথা অর্থশাস্ত্রে বলা হয়েছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ১৫টি অধিকরণ রয়েছে। ১৫টি অধিকরণ মানে মোট ১৫টি খন্ড।

এই অধিকরণ গুলির বিষয় মূলত রাষ্ট্রশাসন, অর্থবিদ্যা, আইন বিধি, যুদ্ধ, গোয়েন্দাবিভাগ ইত্যাদি।

ভাবলে অবাক হতে হয় সুপ্রাচীন কালে ভারতীয় মেধা, জ্ঞানের কতই না গভীরতা ও ব্যাপকতা। যদি এই পনেরোটি খন্ডের বিষয়গুলির ওপর আলোকপাত করা হয়, তাহলে বেশ খানিকটা ধারণা পাওয়া যাবে।

প্রথম খন্ড – বিনয়াধিকারিক ( রাজার বিনয়, বিদ্যাদিশিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ক )

দ্বিতীয় খন্ড – অধ্যক্ষপ্রচার ( শাসন বিভাগের প্রধানদের কর্তব্য বিষয়ক )

তৃতীয় খন্ড – ধর্মস্থিও ( দেওয়ানি আদালত বিষয়ক )

চতুর্থ খন্ড – কণ্টক শোধন ( সমাজের কণ্টক বা শান্তি বিঘ্নিতকারীদের শাস্তিবিধি বিষয়ক )

পঞ্চম খন্ড – যোগবৃত্ত ( রাজ্যশাসন গোপনীয়তা প্রয়োগ বিষয়ক )

ষষ্ঠ খন্ড – মণ্ডলাযোনি বা নীতি ( প্রতিবেশী রাজ্যগুলির মিত্রতা, শত্রুতা বিষয়ক নীতি )

সপ্তম খন্ড – ষাডগুণ্য ( অর্থাৎ রাষ্ট্রশাসনে ব্যবহৃত ছয়টি গুণ মনোনয়ন বিষয়ক )

অষ্টম খন্ড – ব্যসনাধিকারিক ( সপ্তাঙ্গ রাজ্যের বিপদ সংকটের সময় আলোচনা বিষয়ক )

নবম খন্ড – অভিজাস্যৎকর্ম ( শত্রু রাজার বিরুদ্ধে অভিযান বিষয়ক )

দশম খন্ড – সংগ্রামিক ( সংগ্রাম বিষয়ক )

একাদশ খন্ড – সংঘবৃত্ত ( প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ্যের প্রতি গোপনে সংগ্রাম পরিচালনা বিষয়ক )

দ্বাদশ খন্ড – অবলিয়স ( দুর্বল রাজ্য শক্তিশালী রাজ্যের বিরুদ্ধে কূটনীতির প্রয়োগ কিভাবে ঘটাবে সেই বিষয়ক )

ত্রয়োদশ খন্ড – দুর্গলম্ভপায় ( কোনোরকম যুদ্ধ, হিংসা ছাড়াই শত্রু দুর্গ লাভ করার কৌশল বিষয়ক )

চতুর্দশ খন্ড – ঔপনিষদ ( পরোক্ষভাবে শত্রু জয়ের উপায় সমূহ বিষয়ক )

পঞ্চদশ খন্ড – তন্ত্রযুক্তি ( অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত প্রণালী বিষয়ক বিদ্যা )

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় চারটি কার্য ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে একটি হোলো কর ও অর্থব্যবস্থা। এটি অন্যতম একটি ক্রিয়াশীল ব্যবস্থা।

সেইযুগে অর্থব্যবস্থা ছিল কৃষিপ্রধান। সেকারণে অর্থশাস্ত্রে প্রধান কর হিসেবে জমিতে উৎপন্ন দ্রব্যের ১/৬ অংশকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। জরুরীকালীন অবস্থায় সরকারি ভাণ্ডারে শস্য মজুত রাখার কথাও কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বলেছেন।

এই কর ছাড়াও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অন্য কয়েকটি বিশেষ করের কথাও বলা আছে। এই যেমন – মদ্যপান, জুয়া, বিনোদনমূলক কর, মূল্যবান রত্ন বিক্রয় কর, বন্দর কর ইত্যাদি।

অর্থশাস্ত্রে সমাজের ধনী সম্প্রদায়কেও কর প্রদানের তালিকাতে কৌটিল্য রেখেছেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থা রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার ওপরই রাখার মত প্রকাশ করেছেন কৌটিল্য।

এরফলে একটি উন্নতমানের অর্থব্যবস্থা রাষ্ট্রে থাকবে। আর এই মুদ্রাগুলি অবশ্যই সরকারি টাঁকশালে তৈরি হবে।

কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচর নিয়োগের ( secret service ) প্রথার দাবী তুলেছেন। এর কারণ রাষ্ট্রের কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত থাকেন রাষ্ট্রের বেতনভুক কর্মচারীগণ।

কৌটিল্যের মতে, এই সরকারি বেতনভুক কর্মচারীদের অবশ্যই লিখতে পড়তে জানতে হবে।

এই কর্মচারীগণ রাষ্ট্রের কাজকর্মের হেতু যে প্রয়োজনীয় হিসাবপত্র রাখবেন তা পরীক্ষা করে দেখবেন একজন পরীক্ষক। যেহেতু এখানে রাষ্ট্রের আর্থিক বিষয় জড়িত তাই অসাধুতা, গরমিল থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

তাই সরকারি তহবিলে যাতে অসাধুতা, গরমিল, তছরুপ না ঘটে সেকারণে কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচর নিয়োগের উল্লেখ করেছেন।

এরফলে আর্থিক তছরুপ, অসাধুতা বন্ধ হয়ে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত সুদৃঢ় হবে।

অর্থশাস্ত্রে পররাষ্ট্র নীতির উল্লেখ রয়েছে। কৌটিল্য পররাষ্ট্র ব্যাপারে চারটি নীতির উল্লেখ করেছেন। সেগুলি হোলো সাম, দান, দন্ড, ভেদ।

সাম অর্থাৎ সন্ধির মাধ্যমে মিত্রতা স্থাপন করা। দান, মানে সাহায্য প্রদানের দ্বারা ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলা। ভেদ দ্বারা শত্রূরাষ্ট্রে বিভেদ সৃষ্টি করা।

প্রথম তিনটি কার্যকর না হলে অবশেষে দন্ড বা যুদ্ধের দ্বারা রাজ্য জয় করা। আবার অর্থশাস্ত্রে যুদ্ধের প্রকারভেদও করা হয়েছে।

যেমন লোভবিজয় অর্থাৎ পরাজিত দেশের কাছ থেকে সম্পদ লুঠ করা।

অসুরবিজয় – র অর্থ পররাজ্য দখল। আর ধর্মবিজয় বা বশ্যতা স্বীকার করিয়ে অধিকার করা রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রাষ্ট্রের স্বামী। রাষ্ট্রের স্বামী বলতে রাজাকেই বুঝিয়েছেন কৌটিল্য। অর্থশাস্ত্রের মতে রাজাই ছিলেন রাষ্ট্রের সর্বেসর্বা।

রাজা সমস্ত কর্তৃত্বের অধিকারী, দণ্ড প্রয়োগকারী, আবার সেইসাথে সার্বভৌমও। রাজার কর্তব্য হবে জনগণের নিরাপত্তা দান ও সকলের মঙ্গল সাধন করা।

অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য রাজার কয়েকটি গুণের কথা বলেছেন। সেগুলি হোলো- অভিগামিক গুণ, প্রজ্ঞাপন গুণ, উত্থান গুণ এবং আত্মসম্পদ গুণ

সত্যের প্রতি নিষ্ঠা, বিনয়ী ভাব, ধর্মসহিষ্ণুতা, বিদ্যাশিক্ষা ইত্যাদি রাজাকে করে তুলবে অভিগামিক গুণের অধিকারী।

সঠিক সিদ্ধান্তের দ্বারা সমস্যার দ্রুত সমাধানের মধ্যে দিয়ে রাজার প্রজ্ঞাপন গুণ প্রকাশ পাবে। নির্ভীক, সাহসিকতার সাথে কার্য সম্পাদনের ক্ষমতাই রাজার উত্থান গুণ।

বুদ্ধিমত্তা, বাক সংযম, কঠিন পরিস্থিতিকালে নিজের স্নায়ুচাপ ধরে রাখা ইত্যাদি রাজার আত্মসম্পদ গুণকে বোঝায়।

কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের দ্বিতীয় উপাদানটি হোলো অমাত্য। রাজার পক্ষে একা শাসন চালানো সম্ভব নয়। এরজন্য প্রয়োজন সহকারীর।

কৌটিল্য এই সহকারীদের চিহ্নিত করেছেন অমাত্য রূপে। অমাত্য বা সচিবরা রাজার অধীনে থেকে সুষ্ঠূভাবে শাসন পরিচালনা করে যাবেন।

কৌটিল্যের মতে, অমাত্যদের অবশ্যই লিখতে পড়তে জানতে হবে। এবং অমাত্যরা নির্ভীকতা, বুদ্ধিমত্তার সাথে শাসন পরিচালনা করবেন।

শাসন-বিচার বিভাগের অমাত্য নিয়োগের ক্ষেত্রে হিসাব পরীক্ষা সহ অন্যান্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হত। সমাহর্তা, সন্নিধাতা প্রমুখ অমাত্য শ্রেণীর কর্মচারীদের নাম অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায়।

সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব অনুযায়ী তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হোলো জনপদ। জনপদ বলতে কৌটিল্য রাষ্ট্রের অন্তর্গত ভূখন্ড ও সেখানে বসবাসকারী অধিবাসীদের কথাই বলেছেন। কৌটিল্যের মতে অরণ্য, খনিজ প্রভৃতি সম্পদে পরিপূর্ণ ভূখণ্ডই রাষ্ট্রের আদর্শ জনপদ। আর সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীরাও রাষ্ট্রের সম্পদ।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব অনুযায়ী চতুর্থ উপাদান দূর্গ। রাষ্ট্র ও তার রাজধানীর সুরক্ষাহেতু দূর্গের প্রয়োজনীয়তার কথা কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন। এখানে দূর্গের কথা বলে কৌটিল্য আসলে সুরক্ষা পরিকল্পনাতেই জোর দিয়েছেন। চারধরণের দূর্গের কথা তিনি বলেছেন। যেমন – জলদূর্গ, পার্বত্য দূর্গ, মরুদূর্গ, বনদূর্গ।

কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ তত্ত্বে কোষ ইঙ্গিত করে কোষাগারকে। কোষাগার অর্থাৎ যেখানে অর্থ জমা হয়। কৌটিল্যের মতে, কোষ বা অর্থভান্ডারের ওপর রাষ্ট্রের শক্তি নির্ভর করে।

কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের ষষ্ঠ উপাদান হোলো দণ্ড। এখানে দণ্ড বলতে কৌটিল্য দমনমূলক ক্ষমতার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

এই দমনমূলক ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেন রাষ্ট্রের রাজা এবং তাঁর অধীনস্থ সেনাবাহিনী। কৌটিল্যের মতে, রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী হবে পারদর্শী, প্রশিক্ষিত এবং রাজার প্রতি অনুগত।

সেনাবাহিনী পরিচালিত হবে রাজার দ্বারা। যে রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যত বেশী মজবুত হবে সেই রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ততটাই দীর্ঘস্থায়ী হবে।

সপ্তাঙ্গ তত্ত্বের সপ্তম এবং শেষ উপাদান মিত্র। মিত্র বা বন্ধু হলেন তিনি, যিনি রাষ্ট্রের সংকটের সময়ে পাশে থাকবেন।

কৌটিল্যের মতে একজন ভালো মিত্রের কাছ থেকে রাষ্ট্রের বিপদের সম্ভাবনা থাকে না। তাই কৌটিল্য দুধরণের মিত্রের কথা বলেছেন।

সহজমিত্র ও কৃত্রিম মিত্র। বহুকাল সময় আগে থেকেই যাঁদের সাথে মিত্রতার সম্পর্ক রয়েছে তাঁরাই হোলো সহজমিত্র।

অন্যদিকে কৃত্রিম মিত্র হলেন তাঁরা, যাঁদের সবেমাত্র পাওয়া গিয়েছে। তবে কৃত্রিম মিত্র অপেক্ষা সহজমিত্র বেশী উপযোগী, এমনটাই মত কৌটিল্যের।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার তা হল, মানব শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো রাষ্ট্রেরও নিজস্ব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। কৌটিল্যের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব যেকোনো রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

যার ওপর রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। এই সাতটি অঙ্গ মিলিত ও সুষ্ঠূভাবে কাজ করলে তবেই তা রাষ্ট্রের পক্ষে কুশলজনক হবে।

এর অন্যথায় রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব সর্বাধিক। উপরের আলোচনা থেকে এতক্ষনে তা স্পষ্ট হয়েছে। তবুও নীচে আলোচনা করা হোলো।

১) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সংক্ষিপ্ত এবং জোরালো। রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের উপর লিখিত এই গ্রন্থটি। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাজ কর্তব্য সম্পর্কে যে নির্দেশ কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে পরিবেশন করেছেন তার গুরুত্ব অপরিসীম।

২) রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের ওপর লিখিত হলেও, বাস্তবিকভাবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে চলা উচিত সেসম্পর্কে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে।

৩) রাষ্ট্রপরিচালনায় রাজার ভূমিকাই সর্বাধিক। সেক্ষেত্রে রাজার পক্ষে কেমন নীতি গ্রহণে রাষ্ট্রের মঙ্গল সাধিত হবে তার গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে করেছেন।

৪) রাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য বুনিয়াদি ভিত্তি কর ব্যবস্থা। তাই একটি রাষ্ট্রের কর ব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত সেসম্পর্কে বিস্তারিত পরিসংখ্যান অর্থশাস্ত্রে রয়েছে। এখানেই অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।

৫) সর্বোপরি প্রশাসনের আইন এবং শাসন প্রণালী সম্পর্কে ব্যাখ্যা অর্থশাস্ত্রে স্থান পেয়েছে। রাষ্ট্রের শাসন ও বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে কোন কোন কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা অর্থশাস্ত্রে আছে। বলা চলে ভারতের শাসন ব্যবস্থার বহু দিক অর্থশাস্ত্র অনুসৃত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!