ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব আলোচনা করো

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব ( Geographical Elements on Indian History ) সুদূরপ্রসারী।

হিমালয়, নদনদী, বিন্ধ্যপর্বত, সমুদ্র ভৌগোলিক উপাদানগুলির প্রভাব ভারতের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ।

ইতিহাস হল মানুষের জীবন, সমাজ, সভ্যতার বিবরণ।

নানা দেশের নানারকমের ইতিহাস। এর কারণ একেক দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ একেক ধরণের। ইতিহাস পড়তে গেলে ভূগোলের জ্ঞান থাকাটা একান্ত জরুরী।

তাই ভূগোল ছাড়া ইতিহাস পড়তে গেলে অনেকটা বিনা ফ্রেমের ছবির মতো মনে হবে। ভারতের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও এই একই কথা প্রযোজ্য।

সুবিশাল ভারত আমাদের জন্মভূমি। পুরাণের ভরত রাজার নাম অনুসারে আমাদের দেশের নাম ভারত হয়েছে, এমনটা মনে করা হয়।

ভারতের গ্রীক নাম ‘ইন্ডিয়া‘ ( India )। বিশ্বের কাছে ভারত এই নামেই পরিচিত। পারসিকরা নামকরণ করেছে ‘হিন্দুস্তান’ নামে।

প্রাচীনকালে হিন্দু বিশ্বতত্ববিদরা এই দেশের নামকরণ করেছিলেন ‘জম্বুদ্বীপ’।

চীন থেকে পঞ্চম শতকে ভারতে আসা ফা-হিয়েনের বিবরণেও ভারত অর্থে জম্বুদ্বীপের উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে জম্বুগাছের পাতার মতো আকৃতি হওয়ায় জম্বুদ্বীপ নাম হয়েছে।

তবে সে যাইহোক, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ভারতবর্ষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মর্যাদাতেও ভারত শ্রেষ্ঠ।

এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত ভারতের চারদিক বেষ্টিত প্রাকৃতিক সীমারেখার দ্বারা।

পূর্বে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরবসাগর, দক্ষিণে ভারত মহাসাগর আর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয়। এইভাবে প্রকৃতি যত্ন করে আগলে রেখেছে।

বিশাল আয়তনের নিরিখে পৃথিবীতে ভারতের স্থান সপ্তম।

ভারতীয় উপমহাদেশ নামে বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। তাই এমন ভৌগোলিক উপাদান ভারতের ইতিহাসকে কতটা প্রভাবিত করেছে সেটাই দেখার বিষয়। 

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাব
হিমালয় : ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদান

ভারতের ভৌগোলিক উপাদান বিবিধ। দার্শনিক বোঁদা বলেছিলেন, কোনো দেশের ভূগোল সেই দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে।

ভৌগোলিক উপাদানের গতি প্রকৃতির ওপরই ইতিহাস নির্ভরশীল। ভারতের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম।

ভারতের ইতিহাস রচনায় ভারতের ভৌগোলিক উপাদান গুলি সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতের ভৌগোলিক উপাদানগুলি হল – পর্বত, সমুদ্র, নদনদী ইত্যাদি।

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাবকে অস্বীকার করা যাবে না। এই ভৌগোলিক উপাদানগুলি ইতিহাসকে করেছে সমৃদ্ধ। এখন সেই ভৌগোলিক উপাদানগুলির প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হল।

ভারতের ওপর হিমালয়ের প্রভাব এমনই যে ভারতবর্ষকে ‘হিমালয়ের দান‘ ( Himalaya )বলা যায়। অর্ধবৃত্তাকার আকৃতি নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত। হিমালয়ের সর্বোচ্চ পর্বতের নাম মাউন্ট এভারেস্ট।

যা অবস্থিত নেপালে। উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার। হিমালয় নামক রক্ষা প্রাচীর বিদেশী শত্রুর হাত থেকে চিরকাল ভারতকে রক্ষা করে এসেছে।

রক্ষা করেছে সাইবেরিয়া, তিব্বতের অতিশয় ঠান্ডা শুষ্ক বাতাসের হাত থেকে। ১৯৬২ সালে চীনের ভারত আক্রমণ ছাড়া উত্তরদিকের গিরিপথ দিয়ে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ভারতে তেমন আছড়ে পড়েনি।

এর কারণ বছরের বেশিরভাগ সময় হিমালয়ের বরফাবৃত অবস্থা। আবার তুষার গললে উত্তরের চীন, তিব্বত দেশগুলির সাথে বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক আদান প্রদানও হয়েছে।

এদেশের অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের মতো মনীষী উত্তরাংশের দেশে ভারতের ধর্ম সংস্কৃতির বার্তা বয়ে নিয়ে গেছেন।

আবার সেখান থেকেও ফা-হিয়েন, হিউয়েন-সাং, লামা তারানাথ হিমালয় পেরিয়ে ভারতে এসে জ্ঞানের ভান্ডার ভরেছেন। হিমালয় এই আদান প্রদানের সাক্ষী থেকেছে।

হিমালয় ভারতের ইতিহাস রচনায় ভূমিকা নিয়েছে। গোমাল, তোচি, বোলান গিরিপথগুলি ভারতের সাথে মধ্য এশিয়ার সংযোগ গড়েছিল।

অতীতে এই গিরিপথ দিয়ে শক, পারসিক, কুষাণ, হুণ এবং অবশেষে মুঘলরা ভারতে এসেছে। আক্রমণকারীর ভূমিকায় ভারতের সম্পদ লুঠেছে।

শুধু এতেই ক্ষান্ত থাকেনি সুযোগ পেয়ে এই জাতিগুলি ভারতবর্ষে শাসন কায়েম করেছে। গিরিরাজ হিমালয়ের বুকে মৌসুমী বাতাস ধাক্কা খেয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে সুজলা-সুফলা করেছে ভারতভূমিকে।

হিমালয়ের এই অকাতর দান আশীর্বাদ রূপে বর্ষিত হয়েছে ভারতের ওপর। তাই হিমালয়ের প্রভাব যেমন ভারতবর্ষের সুরক্ষাতেও, তেমনি অন্য দেশগুলির সাথে সংস্কৃতির মিলনেও।

ভারতের ইতিহাসে ভৌগোলিক উপাদানের প্রভাবে বিন্ধ্য পর্বতের ভূমিকা রয়েছে।

হিমালয়ের পরেই বিন্ধ্য পর্বত ভারতের ইতিহাসে বেশ প্রভাব ফেলেছে। বিন্ধ্য পর্বত ( Vindhya mountain ) একেবারে আড়াআড়ি ভাবে ভারতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।

বিন্ধ্য রেঞ্জ মধ্যপ্রদেশ থেকে শুরু করে বারাণসী উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিন্ধ্য পর্বতের ঢাল থেকেই সৃষ্টি হয়েছে চম্বল, নর্মদা, বেতওয়া ইত্যাদি নদীগুলি।

উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে মেলবন্ধনে বাধাদান করেছে বিন্ধ্য পর্বত। উত্তরদিক পরিচিত হয়েছে আর্যাবর্ত নামে। দক্ষিণ দিক পরিচিতি পেয়েছে দাক্ষিণাত্য নামে।

বিন্ধ্য পর্বতের উপস্থিতির কারণেই উত্তরের আর্য সভ্যতা দক্ষিণে প্রবেশ করতে পারেনি। আর সেকারণেই দাক্ষিণাত্যে সুদূর অতীতে দ্রাবিড় সভ্যতা বিকশিত হয়েছিল।

দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক জীবন সমৃদ্ধ হয়েছিল বিন্ধ্য পর্বতের জন্যই।

আবার সেইসাথে বিন্ধ্য পর্বত থাকায় উত্তর ভারতের মতো দক্ষিণ ভারতকে কিন্তু বিদেশী আক্রমণের অতটা মুখোমুখি হতে হয়নি। ভারতের এমন ভৌগোলিক অবস্থানের দরুন ভারতের ইতিহাস আলাদা পরিচিতি লাভ করেছে।

ভারতবর্ষ নদীমাতৃক দেশ। নদীকে মাতৃরূপে বন্দনা করা হয়। ভারত ইতিহাসে নদ-নদীর প্রভাব অসীম। বিশ্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলি নদীতীরেই গড়ে উঠেছিল।

এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। মিশরীয় সভ্যতা নীলনদ, মেসোপটেমিয়া সভ্যতা টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদী, আর সিন্ধু সভ্যতা ভারতের সিন্ধু নদীর উপত্যকায় গড়ে উঠেছিল।

সিন্ধু নদীর উপত্যকায় হরপ্পামহেঞ্জোদারোকে নিয়ে গড়ে ওঠা হরপ্পা সভ্যতা এর উদাহরণ। নগরকেন্দ্রিক হরপ্পা সভ্যতা বলা ভালো।

ভারতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতার জন্ম দিয়েছে।

কিন্তু এক্ষেত্রে দক্ষিণ ভারতের নদীগুলি কিছুটা পিছিয়ে।

আসলে গঙ্গা নদীর অববাহিকা এতটাই উর্বর যে, তা দেশীয় কিংবা বৈদেশিক উভয় শক্তির মধ্যেই লোভ জাগিয়েছিল।

দখলের লোভ। দক্ষিণ ভারতের নদীগুলি কৃষিকার্যে খুব বেশি সহায়ক না হওয়ায় এখানের প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়নি। ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই এমনটা সম্ভব।

ভারতবর্ষে নদ-নদীর প্রাচুর্য এত বেশী যে বড় বড় নগর নদী অববাহিকায় গড়ে উঠেছে। যেমন বারাণসী, প্রয়াগ, আগ্রা, দিল্লী, পাটলিপুত্র ইত্যাদি।

প্রাচীন তাম্রলিপ্ত ( জানা যায় এইস্থানে জাহাজে তামার লেপন দেওয়া হত তাই এই নাম ), সপ্তগ্রাম বন্দর গড়ে উঠেছিল নদী তীরেই। যদিও আজ এই বন্দরগুলির আর অস্তিত্ব নেই।

কেবল অতীতের স্মৃতিটুকু বহন করে চলেছে। গঙ্গা-যমুনার উপত্যকা এত উর্বর ছিল, যা দখল নিয়ে পাল-প্রতিহার-রাষ্ট্রকূট একে অপরের প্রতি যুযুধান হয়েছিল।

ইতিহাসে পাল-প্রতিহার-রাষ্ট্রকূটের সংঘর্ষ ‘ত্রিশক্তি সংঘর্ষ‘ নামে পরিচিত।

অন্যদিকে কৃষ্ণা-গোদাবরী বিধৌত অঞ্চল ইতিহাসে বহু রাজ্য ও রাজবংশের উত্থান পতনের সাক্ষী হয়ে আছে।

সামাজিক, ধর্মীয়, দার্শনিক দিক দিয়ে বিচার করলেও দেখা যাবে ভারতের ইতিহাসে নদনদীর গুরুত্ব অনেকখানি।

বিশেষ করে গঙ্গা বিধৌত সমতলভূমি সংস্কৃত ভাষায় কাব্য, নাটক, উপন্যাস ইত্যাদি রচনার পীঠস্থান রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে। সমৃদ্ধ হয়েছিল সংস্কৃত ভাষা।

শান্তির আশ্বাস বাণী মানুষ শুনেছে। তাই বলা যায় ভারতের নদীগুলি ভারতের ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রিত করেছে।

ভারতের ইতিহাসের ওপর সমুদ্রের প্রভাব থাকাটা স্বাভাবিক। ভারত তিনদিক দিয়ে সমুদ্রবেষ্টিত।

ভারত মহাসাগর, আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর প্রায় ৫০০০ কিলোমিটার জুড়ে ভারতকে ঘিরে রেখেছে।

সমুদ্রের এই ঘেরাটোপ ভারতবর্ষকে নিরাপত্তা দান করেছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় এখানে সামুদ্রিক কার্যকলাপ, নৌশক্তির প্রভাব স্পষ্ট।

ভারতের সুদূর দক্ষিণে ‘তাঞ্জোর‘ নামে একটি রাজ্য ছিল। সেই তাঞ্জোরকে কেন্দ্র করেই বিখ্যাত চোল রাজবংশের ( Chola Dynasty ) রাজত্ব শুরু হয়।

কারিকল ছিলেন চোলদের প্রথম ঐতিহাসিক শাসক। এরপর রাজরাজ চোল, রাজেন্দ্র চোল কৃতিত্বের সাথে চোল বংশের গৌরব বৃদ্ধি করেন।

দক্ষিণ ভারতের থাঞ্জাভুরে অবস্থিত তাঞ্জোরের রাজরাজেশ্বর মন্দির, গঙ্গইকোন্ড চোলপুরমের মন্দির চোলদের অপূর্ব কীর্তি।

এই চোলরাই নৌ অভিযানের ইতিহাসে বিশাল খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

জানা যায় চোল সম্রাট রাজেন্দ্র চোল তাঁর বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে বঙ্গোপসাগরকে ‘চোল হ্রদে‘ ( Chola Lake ) পরিণত করেছিলেন।

সামুদ্রিক অভিযানের ইতিহাস রচনা করেছিলেন চোলসম্রাটগণ। সমুদ্রপথ ধরেই অতীতে ভারতের সাথে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য গড়ে উঠেছিল।

সিংহল, মালয়, জাভা, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে সমুদ্রের সূত্রে ভারতীয় উপনিবেশ গড়ে ওঠে। ছড়িয়ে পরে ভারতের সংস্কৃতি। ভারত আত্মপ্রকাশ করে বৃহত্তর ভারত রূপে।

যেকোনো দেশের ভৌগোলিক উপাদান সেই দেশের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। ভারতবর্ষের ইতিহাস তার নিজের ভৌগোলিক উপাদানের দ্বারা পরিপুষ্ট। আসলে ভূগোলের সাথে ইতিহাসের সম্পর্কটাই এমন। দুটোই একসূত্রে গাঁথা। ভারতের ভৌগোলিক গঠন এতটাই অনোখা যে ইতিহাসের গতি প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। ভারতের পাহাড়-পর্বত, নদী, সমুদ্র, অরণ্য ভারতের ইতিহাসের একেকটি মূল্যবান উপাদান। বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষের ইতিহাস ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!