bhakti movement,ভক্তি আন্দোলন

ভক্তি আন্দোলন কী । Bhakti Movement in bengali

ভক্তি আন্দোলনের ( Bhakti Movement ) উদ্ভব মধ্যযুগের ভারতবর্ষে। মধ্যযুগ ভারতে মুসলমান শাসনের যুগ হিসেবে চিহ্নিত। মুসলমানদের ভারতে আসার আগে বহু বিদেশী জাতি ভারতে এসেছে।

গ্রীক, শক, হুন প্রভৃতি। ভারতে এসে এই জাতিগুলি নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়ে এখানেই বসবাস করতে শুরু করেছিল। তাঁদের ভারতীয়করণ ঘটলো।

ভারতের সবকিছু ধীরে ধীরে আয়ত্ত করে ফেলে এই জাতিগুলি। অবশেষে একদিন বিদেশী জাতিগুলির মতোই মুসলমান জাতিও ভারতে পা রাখলো।

ভারতের সর্বত্র বিজয়ী হোলো তাঁরা। এরপর মুসলমানরা এদেশে পাকাপাকিভাবে থাকতে লাগলো। ভারতে সুপ্রাচীন কাল থেকেই হিন্দু সংস্কৃতির অস্তিত্ব ছিল।

সুতরাং মুসলমানদের সংস্কৃতির সাথে হিন্দু সংস্কৃতির বিরোধ দেখা দিল।

এই বিরোধ ছিল মুসলমান একঈশ্বরবাদ বনাম হিন্দু পৌত্তলিক প্রথার বিরোধ। হিন্দু জাতিভেদ প্রথা বনাম মুসলমান অ-জাতিভেদ প্রথার বিরোধ ইত্যাদি।

কিন্তু এই বিরোধ উভয়ের মধ্যে বেশিদিন টিকলো না। একসাথে বাস করার ফলে হিন্দু ও মুসলমান একে অপরের রীতি-নীতি, আচার-আচরণ সম্পর্কে জানলো।

ইসলামে আল্লাহকে একমাত্র ঈশ্বর বলে প্রচার করা হয়। তেমনি হিন্দু উপনিষদের ‘একেশ্বরবাদ’-র তত্ত্বকেও উপস্থাপিত করা হয়।

এরফলে দুই ধর্মেরই সমন্বয় সাধন ঘটে। আর এর থেকেই জন্ম হয় ভক্তিবাদের। হিন্দু সাধকদের নেতৃত্বে শুরু হয় ভক্তিবাদী আন্দোলনের ( Bhakti Movement )।

bhakti movement,ভক্তি আন্দোলন
ভক্তি আন্দোলন

ভক্তি আন্দোলন ( bhakti movement ) :

১) ভক্তিবাদ কি ( bhakti movement ) :-

ভক্তিবাদ হোলো প্রেম, ভক্তি, ভালোবাসার মাধ্যমে জাতি-ধর্ম-বর্ণ- নির্বিশেষে সকলকে জয় করে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ। এটাই ভক্তিবাদের ( bhakti movement ) মূল কথা। মানুষ ও ঈশ্বরের অতীন্দ্রীয় মিলনে মুক্তিলাভ বা মোক্ষলাভ ভক্তিবাদের মূল উদ্দেশ্য। ভারতীয় বেদ ও উপনিষদে উল্লিখিত ভক্তিবাদের সারমর্মই হোলো মানুষকে ভালোবাসা। জীবে প্রেম ; জীবের সেবা করাই যথার্থ অর্থে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের পূজা করা। ভক্তিবাদ বলছে, ঈশ্বর মন্দির-মসজিদে নেই তিনি আছেন প্রতিটি মানুষের মনের মধ্যে। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। ভক্তিবাদ জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, বহুঈশ্বরবাদ, লোক দেখানো আড়ম্বরে বিশ্বাসী নয়। বরং প্রেম, ভালোবাসা, জীবে দয়া এবং ঈশ্বরের প্রতি আত্মনিবেদনে ভক্তিবাদ বিশ্বাস করে।

২) ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তক :-

ভক্তিবাদ কি তা আমরা জানলাম। এবারে ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তকের নাম জানা যাক। ভক্তি আন্দোলনের প্রথম প্রবর্তক ছিলেন সাধক রামানুজাচার্য ( Ramanujacharya )। রামানুজাচার্য ছিলেন একজন হিন্দু দার্শনিক। দক্ষিণ ভারতই ছিল রামানুজের সাধনাস্থল। ভক্তিবাদের আদি প্রবক্তা রামানুজ ভক্তিবাদের ঢেউকে বিভিন্ন সাধকের মাধ্যমে ভারতের সর্বত্র ছড়িয়ে দেন। রামানুজের প্রিয় শিষ্য সাধক রামানন্দ ( Ramanand ) ছিলেন উত্তর ভারতে ভক্তি আন্দোলনের প্রবর্তক। এরপর ধীরে ধীরে কবীর, সুরদাস প্রমূখ সাধক ভক্তি আন্দোলনে প্লাবন ঘটান।

৩) ভক্তি আন্দোলনের সাধক :-

ভক্তি আন্দোলনের সাধকরা ভক্তিবাদকে সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ভক্তি আন্দোলনের সাধকেরা হলেন রামানুজ, রামানন্দ, কবীর, গুরুনানক, শ্রীচৈতন্যদেব, মীরাবাঈ প্রমূখরা। এইসমস্ত ভক্তিবাদী ধর্মপ্রচারক-সংস্কারকগণ ধর্মীয়, সামাজিক সাম্যের কথা শোষিত বঞ্চিত মানুষের মধ্যে প্রচার করেন। সাধারণ মানুষ খুব সহজেই ভক্তিবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

৪) ভক্তি আন্দোলনের কারণ :-

ভক্তি আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে কিছু বলা যাক। মুসলমানেরা ভারতে প্রবেশ করায় ইসলামধর্ম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে বিভেদরেখা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছিল। ফলে হিন্দুসমাজে রক্ষণশীলতা বৃদ্ধি পায়। হিন্দু ধর্মের ব্যাখ্যাকারেরা ধর্ম ও সমাজের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। নারীর মান বাঁচাতে সহমরণ ও জৌহর ব্রত পালনেও তাঁরা নির্দেশ দেন। এসব ছিল মুসলমান সংস্কৃতির থেকে দূরত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা। কিন্তু এই দূরত্ব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। একসাথে বসবাস করার ফলে হিন্দু-মুসলমান একে অন্যের সংস্কৃতি সম্পর্কে জেনে যায়। মানসিকতার পরিবর্তন হয়ে হিন্দু ও ইসলাম পরস্পরের কাছাকাছি আসে।

এখন প্রশ্ন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই সমন্বয় হোলো কিভাবে ? বিরোধ হিন্দু-মুসলমান সমাজের নীচের তলায় ছিল না, ছিল ওপরতলায়। জাতিভেদের বদলে ইসলামের সামাজিক সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে টেনে নিয়েছিল। এদিকে মুসলমান শাসকরাও এদেশে শাসন পরিচালনার কাজে হিন্দুদেরকেই প্রাধান্য দেয়। ফলে হিন্দুদের কাছে ইসলামের শাসন বিধর্মীর শাসন হয়ে থাকে না। সুলতানদের সহোযোগিতায় মহাভারত, শ্রীমদ্ভাগবত গীতা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বাংলা, ফার্সি ভাষায় অনুবাদ হয়। হোসেন শাহের আমলে বাংলায় বৈষ্ণব ধর্মে জোয়ার আসে। মুসলমান পন্ডিতবর্গ হিন্দু দর্শন শাস্ত্রের ওপর অনেক বই রচনা করেন। সমৃদ্ধ হয় জ্ঞানের ভান্ডার। হিন্দু-মুসলমান একে অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবান হয়ে ওঠে। আর এভাবেই দুই ধর্মের মেলবন্ধন আদর্শ থেকেই জন্ম নেয় ভক্তিবাদ আন্দোলনের।

আরও পড়ুন : ফ্রান্স ও জার্মানির শিল্পবিপ্লব

ভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ :

অনেকের হয়তো ধারণা ভক্তিবাদ তথা ভক্তি আন্দোলনের উদ্ভব হয়েছে ইসলাম থেকে। এধারণা যুক্তিযুক্ত নয়। হিন্দু ধর্মের বেদ, উপনিষদে ভক্তির কথা বলা আছে। হিন্দু পবিত্র ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবত গীতা-তে মুক্তির পথ হিসেবে ভক্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। একইসাথে জ্ঞান ও কর্মের কথাও বলা হয়েছে। অর্থাৎ জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম মিলে মুক্তিলাভের তিনটি মার্গ বা পথ। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে ভক্তির জোয়ার এনেছিল। ইসলাম ধর্মের জন্ম তখন হয়নি। চলে যাই দক্ষিণ ভারতে, সেখানে শৈব নায়নার গোষ্ঠী ও বৈষ্ণব আলভার গোষ্ঠীর দেখা মেলে। সময়কাল সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী। এই দুই গোষ্ঠী এইসময়কালে ভারতে ভক্তিবাদের বন্যা বইয়ে দিয়ে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা করে। তাই ভক্তিবাদ ভারতের আদি ধর্ম চেতনা। শাখাপ্রশাখার মতো ছড়িয়ে আছে সেই কোন আদি কাল থেকেই। তবে ইসলাম ধর্মের সাম্য, উদার নীতির মধ্যে ভক্তিবাদের মিল পাওয়া যায়। ইসলামের গণতান্ত্রিক আদর্শের সামনে হিন্দু ধর্মের অগণতান্ত্রিক শোষণ, নিপীড়নের রূপটি প্রকট হয়। হিন্দু ধর্ম নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বিবাদ ভুলে উদারতা, ভক্তির পথ বেছে নেয়। এরপর ভক্তিবাদের মশাল প্রজ্বলিত করলেন বেশকিছু সাধকবৃন্দ। ভক্তি আন্দোলনের বিকাশে তাঁরা জোয়ার আনলেন।

i) রামানুজ –

দক্ষিণ ভারতের সাধক রামানুজ, যাঁকে রামানুজাচার্যও ( Ramanujacharya ) বলা হয়। জন্ম দক্ষিণ ভারতের পেরুমবুদুরে। ব্রাহ্মণ, ধর্মতত্ত্ববিদ, দার্শনিক এবং হিন্দু ধর্মের একজন প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ছিলেন রামানুজ। ভক্তিবাদের আদি প্রচারক ছিলেন সাধক রামানুজ। দক্ষিণ ভারতের শ্রীরঙ্গমে ভক্তির মতবাদ প্রচারের জন্য কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। এখান থেকেই ভক্তিমূলক উপাসনা বা অনুশীলনের জন্য তিনটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেন। যথা- বেদার্থ সমগ্র, শ্রীভাষ্য বা ব্রহ্মসূত্র এবং শ্রীমদ্ভাগবত গীতা। ধর্মকে ভক্তির মাধ্যমে চিনতে শিখিয়েছিলেন তিনি। আসলে ভক্তি হিন্দুধর্মের প্রধান শক্তি। রামানুজ দেখিয়েছেন পরিত্রাণের পথ হিসেবে ভক্তিমূলক উপাসনাই একমাত্র পথ। পরে রামানুজের পরিচালিত ভক্তিবাদ উত্তর ভারতে প্রবেশ করে। সেখানে ধর্মীয় চিন্তার ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলে। রামানুজের মতে, মানব আত্মার লক্ষ্য হবে ঈশ্বরের সেবা করা। আর এই ঈশ্বর উপাসনার মাধ্যমে মানুষ প্রেমময় চিন্তায় ডুবে যাবে। সমস্ত বিরোধ ধুয়ে মুছে সাফ হবে।

ii) রামানন্দ –

রামানুজের শিষ্য ছিলেন রামানন্দ বা রামদত্ত ( Ramanand )। ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভারতের প্রয়াগে রামানন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন কনৌজী ব্রাহ্মণ। রামানুজের ভক্তিবাদের ভাবধারা দ্রাবিড় ভূমি থেকে উত্তর ভারতে নিয়ে আসার অন্যতম পথিকৃৎ হলেন রামানন্দ। বৈদিক গ্রন্থ ও গুরু রামানুজের দর্শন ভালোভাবে অধ্যয়ন করে বারাণসীতে ছাত্রদের শিক্ষা দিতে থাকেন। জানা যায় যে, কোনো বর্ণের বাছবিচার না করে প্রায়শই রামানন্দ তাঁর ছাত্রদের সাথে খাদ্য গ্রহণ করতেন। এই ঘটনা তৎকালীন ব্রাহ্মণদের ক্ষুব্ধ করে। সাধক রামানন্দ ‘রামানন্দী’ নামে নিজের এক সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। হুবহু রামানুজের মতোই ছিল রামানন্দের শিক্ষা প্রণালী। শিক্ষাদানকালে হিন্দি ও স্থানীয় ভাষা তিনি ব্যবহার করতেন। তাইতো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই তাঁর শিষ্যত্বে ঠাঁই পেয়েছিলেন। মুচি রুইদাস, জোলা কবীর প্রভৃতির মতো নিম্নবর্গের মানুষই ছিল রামানন্দের প্রধান শিষ্য।

iii) কবীর –

ভক্তিবাদী আন্দোলনের এক অসাধারণ পথপ্রদর্শক ছিলেন কবীর ( Kabir )। কবীর ছিলেন রামানন্দের শিষ্য। গুরু রামানন্দের দুঃসাহসী শিষ্য তিনি। কবীর নিজের অন্তরের প্রেমপেয়ালা থেকে প্রেম উজাড় করে দিয়েছিলেন হিন্দু -মুসলমান নির্বিশেষে। ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে কবীরের জন্ম হয় কাশীর এক বিধবা ব্রাহ্মণ কন্যার গর্ভে। জন্মের পরই তিনি পরিত্যক্ত। এক মুসলমান তাঁতি দম্পতি পরিত্যক্ত এই শিশুকে তুলে এনেছিলেন আস্তাকুঁড় থেকে। তাঁরা নাম রাখলেন কবীর। শৈশব থেকেই কবীর ছিলেন ভক্তির ভাবে ঋদ্ধ। বারাণসীর মণিকর্ণিকা ঘাটে রামানন্দ কর্তৃক কবীর রামনামে দীক্ষা পেলেন। সকল মানবের মাঝে প্রেম ছড়ালেন। কবীর প্রচার করলেন, ‘রাম ও রহিম, আল্লাহ ও ঈশ্বর এক ও অভিন্ন‘। সেই পরমেশ্বরকে লাভ করার জন্য মন্দির মসজিদের দরকার নেই। ঈশ্বর সাধনার জন্য দরকার নেই মূর্তিপূজা বা নামাজের। দরকার জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে ভালোবাসা, শ্রদ্ধার। শুধু একটু অন্তরের প্রেমের বিনিময়ে মানুষকে অন্ধকার থেকে ঝলমল আলোয় নিয়ে আসা এই ছিল কবীরের উদ্দেশ্য। দেবভাষা সংস্কৃতে নয়, নিজের কথ্যভাষা হিন্দিতেই প্রেমের কথা, ভক্তির কথা, ভাবের কথা মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিলেন।

কবীরের দোঁহা :-

কবীরের দোঁহা হোলো হিন্দি ভাষায় কবীর রচিত ছোটো ছোটো কবিতা বা শ্লোক। দোঁহার মাধ্যমে নিজের বক্তব্যকে সুন্দরভাবে প্রকাশ করতেন তিনি। কবীরের দোঁহাগুলি হিন্দি সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ রূপে পরিগণিত। দোঁহাগুলি হোলো যেমন –

প্রেম গহৌ নির্ভয় রহৌ তনিক ন আবৈ পীর, যহ লীলা হৈ মুক্তিকী গাবত দাস কবীর“- প্রেমকে গ্রহণ করে নির্ভয়ে থাকবো, আসবে না কোনো কষ্ট, পীড়া। কবীর দাসের মতে, এইটিই মুক্তির লীলা।

জাকি জিভ্যা বংধ নহি হৃদয়া নহি সাঁচ, তাকে সংগ ন লাগিয়ে ঘলৈ বটিয়া মাঝ“- যার জিভ সংযত নয়, হৃদয়ে সত্যের লেশমাত্র নেই তার সাথে সঙ্গত কোরো না। সে ব্যক্তি সর্বনাশ করতে পারে।

চরণন ধ্যান লগায় কে রহৌ নাম লৌ লায়, তনিক ন তোহি বিসারি হৌ য়হ তন রহে কি যায়“- তোমার চরণে ধ্যানে মগ্ন থাকবো। তাতে দেহ হয় থাকবে, নয় যাবে। কিন্তু এক পলকের জন্যও তোমাকে বিস্মৃত হব না।

মন রে রতন কাগজ কা পুতলা, লাগৈ বুঁদ বিনসি জাই ছিল মৈ গরব করৈ ক্যা ইতনা“- মন রত্ন কাগজের পুতুল খেলনা। বুদবুদের মতো, হঠাৎ উঠে ফেটে যায়। তাহলে সেই মনের এতো গর্ব কিসের ?

iv) শ্রী চৈতন্যদেব –

বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবক্তা ছিলেন মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেব ( Shri Chaitanya dev )। শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মস্থান বাংলার নদীয়া জেলার নবদ্বীপে। ব্রাহ্মণ দম্পতি জগন্নাথ মিশ্র ও শচী দেবীর সন্তান তিনি। বাল্যকালে চৈতন্যদেবের নাম ছিল নিমাই। বিষ্ণুপ্রিয়া দেবী ছিলেন শ্রী চৈতন্যদেবের স্ত্রী। চব্বিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস নেন। গুরু কেশব ভারতীর মন্ত্র শিষ্য হন শ্রী চৈতন্যদেব। শাস্ত্র, দর্শনে ছিলেন সুপন্ডিত। বিষ্ণুর অবতার বলেই তাঁকে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নামে ডাকা হোতো। শ্রী চৈতন্যদেব ছিলেন প্রেমের অবতার ; ক্ষমার প্রতীক। জাতিভেদ প্রথাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মানুষের মধ্যে ভক্তির তত্ত্ব প্রচার করেন। চৈতন্যদেবের প্রচারিত ভক্তি তত্ত্বের সারমর্ম ছিল- জীবে দয়া, পরমেশ্বরের প্রতি নিবিড় ভক্তি ও ঈশ্বরের নাম সংকীর্তন। নাম সংকীর্তন ও প্রেমের বন্যায় ব্রাহ্মণ থেকে চণ্ডাল সবাইকে প্লাবিত করেন তিনি। প্রেম দিয়ে বুকে টেনে নেন। শ্রী চৈতন্যদেবের ভক্তি, বৈরাগ্য, প্রেম, নম্র স্বভাব, নিরহংকার সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর মানুষকে আকৃষ্ট করে। পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের অনুগামীরা গৌড়ীয় বৈষ্ণব নামে সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটান। তাঁর অগণিত শিষ্যদের মধ্যে ছিলেন যবন হরিদাস, রূপ-সনাতন, নিত্যানন্দ, জগাই-মাধাই প্রমুখ সর্বস্তরের মানুষ।

v) মীরাবাঈ –

ভক্তি আন্দোলনের আর এক স্মরণীয় প্রচারক হলেন মীরাবাঈ ( Mirabai )। একজন অভিজাত রাজপুত বংশীয়, হিন্দু, কৃষ্ণভক্ত ছিলেন মীরাবাঈ। ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে রাজস্থানের যোধপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন মীরাবাঈ। শৈশব থেকেই কৃষ্ণপ্রেমে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তিনি। তাই উপাস্য দেবতা রূপে কৃষ্ণকেই বেছে নিয়েছিলেন মীরাবাঈ। যোধপুরের প্রতিষ্ঠাতা রাও যোধা রাঠোরের পুত্র রতন সিংহ রাঠোরের পিতৃস্নেহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। নির্দিষ্ট বয়সে চিতোরের বীর প্রতাপশালী রাজপুত রাজা রাণা সঙ্গের পুত্র ভোজ রাজ শিশোদিয়ার সাথে মীরার বিবাহ হয়। কিন্ত জন্মের পর থেকেই যে মীরা নিজের মন সপে বসে আছেন কৃষ্ণের চরণে। রাজমহিষী হয়েও সাধারণ বেশভুষায় কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে মীরার দিন কাটে। ঐশ্বর্যের দিকে নেই কোনো ভ্রূক্ষেপ। মুঘলদের সাথে যুদ্ধে স্বামীর মৃত্যু ঘটে। শোক মীরাবাঈকে গ্রাস করলেও কৃষ্ণ প্রেম অটুট থাকে। রাজপ্রাসাদ, সংসার ত্যাগ করে সাধন-ভজনের দ্বারা কৃষ্ণলাভের পথকেই বেছে নেন মীরা। কৃষ্ণের প্রতি ভক্তি, প্রেম নিবেদন করতে ব্রজবুলি ভাষায় রচনা করলেন ভজনগান। এই ভজনগান গুলি ‘মীরার ভজন‘ নামে পরিচিত। মথুরা-বৃন্দাবনের প্রতিটি ধুলার কণায় মিশে আছে মীরাবাঈয়ের কৃষ্ণ ভক্তিগীতিগুলি। এই গানগুলি ভারতীয় সঙ্গীতের অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।

vi) গুরুনানক –

মধ্যযুগে পশ্চিমভারতের ভক্তি আন্দোলনের এক শ্রেষ্ঠ প্রবক্তা গুরু নানক। ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে লাহোরের তালবন্দী-তে গুরু নানক জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শৈশব অবস্থা থেকেই ভগবৎচিন্তায় মনোনিবেশ করেছিলেন নানক। শিক্ষালাভ করে জীবিকা অর্জনের পথে পা দেন তিনি। এরপর বিবাহ করে সংসারী হন। ভগবৎচিন্তায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করার দরুন দিব্যজ্ঞান লাভ হয় তাঁর। স্ত্রী পুত্রসহ সংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন প্রেম, ভক্তি ও সেবার আদর্শ প্রচারে। বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করলেন। লক্ষ্য একটাই একেশ্বরবাদ, নিরাকার উপাসনার কথা প্রচার। নিন্দা করলেন জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, পৌত্তলিকতার। গুরু নানকের মতে, সৎ শ্রী-অকাল বা সত্যস্বরূপ ভগবানকে লাভের একমাত্র উপায় নামজপ, দান ও অন্তরের পবিত্রতা। এক্ষেত্রে গুরুর ভূমিকাকেও নানক বড়ো করে দেখিয়েছেন। নানকের মতে, গুরু সমুদ্র সমান। অর্থাৎ জ্ঞানসমুদ্র। সেই সমুদ্রে শিষ্য নদী হয়ে ডুব দিয়ে জ্ঞানের স্বাদ চেটেপুটে নেবে। শিষ্য গুরুতে বিলীন হয়ে যাবে। গুরু নানকের ভগবৎ প্রেমের শিক্ষায় আকৃষ্ট হয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। গুরুনানকের এই শিষ্যরাই পরিচিত হয় শিখ নামে।

ভক্তি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য :

১) ভক্তি আন্দোলন মধ্যযুগের ভারতবর্ষে সৃষ্ট হিন্দু ধর্মে এক উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল এক আন্দোলন।

২) ধর্মীয় আঘাত, সংকীর্ণতা, জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে ভক্তি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।

৩) প্রেম, ভক্তি ও ভালোবাসার মাধ্যমে সকলকে জয় করে ঈশ্বর লাভই হোলো ভক্তিবাদের মূল কথা।

৪) ভক্তিবাদী আন্দোলনের আদি প্রবক্তা হলেন রামানুজ।

৫) ভক্তি আন্দোলনে যেসমস্ত সাধকরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের মাতৃভাষায় ধর্ম প্রচার করেছিলেন।

৬) কবীর, শ্রীচৈতন্যদেব, মীরাবাঈ প্রমূখ সাধকরা ভক্তি আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!