চিতোরের রাজপুত রানী পদ্মিনী সম্পর্কে জানুন

রানী পদ্মিনী ( Queen Padmini ) চিতোরের বিখ্যাত রাজপুত রানীদের মধ্যে অন্যতম। ভারতের ইতিহাস বেশ রোমাঞ্চকর চরিত্র, ঘটনায় সমৃদ্ধ।

আমরা বরাবরই ভারতের ইতিহাস পড়তে গিয়ে বড় বড় একেকজন রাজাদের কথা জেনেছি। কেন জানিনা ইতিহাসে রাজাদেরই রমরমা যেন বেশি।

রানীদের কথা সেখানে পাত্তাই পায়না। খুব কম সময়েই রাজারা তাঁদের রানীদের সাথে প্রয়োজন হলে শলাপরামর্শ করতেন।

বাকি বেশিরভাগ সময়ে রাজমহিষীদের রাজপ্রাসাদের অন্তরালেই দিন কেটে যেত।

রাজারা রাজ্য শাসন, যুদ্ধ-বিগ্রহ ইত্যাদির দ্বারা ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নাম অমর করেছেন। কিন্তু ইতিহাস কি কেবলমাত্র রাজাদের জন্যই ?

ভারতের ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে বহু রানীদের নাম ঘোরাফেরা করছে। শুধু একটু কান পেতে শুনতে হবে।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে রানীরা কখনো রাজার অবর্তমানে রাজ্যশাসন করেছেন।

আবার প্রয়োজনে রাজ্যের শত্রুর বিরুদ্ধে তরবারি হাতে তুলে নিয়েছেন। রাজাদের বীরত্বকে ছাপিয়ে গেছেন। কোনো রানী আবার ঈশ্বর প্রেমে মজেছেন।

ভারতের রাজপ্রাসাদগুলি কত রাজা-রানীদের অমর প্রেমের সাক্ষী। তাই রাজাদের নিয়ে তো অনেক রোমাঞ্চকর গল্পগাঁথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

যেগুলো আমাদের পড়তে ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু ভারতীয় রানীদের কথা সেটাও তো জানতে হবে।

তাই এই পোস্টে এমন এক রাজপুত রানীর কথা বলবো যিনি কিংবদন্তীতুল্য।

তাই চলুন জেনে নিই তাঁর কিংবদন্তী হওয়ার গল্প।

চিতোরের রানী পদ্মিনী, queen padmini

এক কিংবদন্তী রাজপুত রানী হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছেন তিনি। রাজস্থানের মেওয়ার রাজ্য যার নাম ইতিহাসে বারবার উল্লিখিত হয়েছে।

এখানকার রাজপুতদের সাহস, বীরত্বের কথা সবার জানা। এই মেওয়ার রাজ্যের পাশে আর একটি রাজ্য ছিল। নাম তার সিঙ্ঘাল রাজ্য।

সিঙ্ঘালকে আবার সিংহল বা শ্রীলঙ্কার সাথে গুলিয়ে ফেললে হবে না। এই রাজ্যের অপরুপ সৌন্দর্য, রুপ, গুণের অধিকারী রাজকুমারী হলেন পদ্মাবতী

রাজকুমারী পদ্মাবতীর রুপে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং রাজপুত রাজা রাওয়াল রতন সিংহ।

মেওয়ার রাজ্যের রাজপুত বংশের রাজা হলেন রাওয়াল রতন সিং। মেওয়ারের গুহিলা রাজবংশের রাওয়াল রাজা সমরসিংহের পুত্র ছিলেন তিনি।

প্রচণ্ড পরাক্রমশালী রাজপুত রাজা ছিলেন তিনি। প্রথম রানী নাগমতি থাকা সত্বেও রতন সিংহ দ্বিতীয় রানীরুপে নির্বাচিত করেছিলেন পদ্মাবতীকে।

প্রথম রানী নাগমতি এবং রাজমাতা এক্ষেত্রে বাধা দিলেও পদ্মাবতীর অমন রুপের কাছে রতন সিংহ নতি স্বীকার করেছিলেন।

বহু জ্ঞানীগুণী সভাসদদের নিয়ে তাঁর সভা গঠিত ছিল।

এমনই একজন হলেন রাঘব চেতন। এঁর কথা পরে আলোচনা করা হবে।

১৩০৩ সালে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি মেওয়ারের রাজধানী চিতোর আক্রমণ করলেন।

চিতোরের রূপবতী রানীকে লাভ করার উদ্দেশেই এই আক্রমণ তিনি করেছিলেন। রতন সিংহ এই যুদ্ধে রাজপুত বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেন।

আগেই বলেছি রতন সিংহের রাজসভায় বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁদের মধ্যেই একজন ছিলেন রাঘব চেতন

তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত ভালো বাঁশিবাদক।

সম্ভবত রাজা রাঘব চেতনের এমন গুণের জন্যই রাজসভায় ঠাই দেন।

জানা গেল রাঘব চেতন গোপনে তন্ত্র বিদ্যা চর্চার মাধ্যমে রাজ্যের মানুষের ক্ষতি করে।

রাজার কানে এই খবর যাওয়া মাত্রই তিনি রাঘবকে অপমান করে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

রাঘব চেতন পণ করলেন এমন অপমানের শোধ তাঁকে তুলতেই হবে।

চিতোরের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেবেন। চিতোর থেকে সোজা এসে উপস্থিত হলেন দিল্লীতে। তখন দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি।

চতুর রাঘবের সুরেলা বাঁশির মায়াবী আওয়াজে সুলতান মুগ্ধ হয়ে নিজের কাছে ঠাই দিলেন।

অপমানের বদলা নিতে সুযোগ বুঝে সে সুলতানের কাছে চিতোরের রানীর রুপের গুণকীর্তন আরম্ভ করল।

যাতে সুলতান চিতোর আক্রমণ করে পদ্মাবতীকে নিজের হারেমে রাখতে পারেন।

যেমন কথা তেমনি কাজ, সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি মেওয়ারের রাজধানী চিতোরের দিকে যাত্রা শুরু করেন।

আলোচ্য কাহিনী জানতে গেলে আলাউদ্দিন খিলজিকে জানতেই হবে। এই কাহিনীর খলনায়ক তো তিনিই। আলাউদ্দিন খিলজির উত্থান ১২৯৬ খ্রিস্টাব্দ।

জীবনের প্রথমদিকে কারা-মানিকপুর নামক স্থানের একজন সাধারণ শাসনকর্তা ছিলেন। তবে শুরু থেকে বলা যাক।

দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের মৃত্যুর পর জালালউদ্দিন ফিরোজ নামে এক খিলজি আমীর নিজের প্রভাব দেখাতে থাকেন।

সুযোগ খুঁজছিলেন দিল্লীর সিংহাসন লাভের। সুযোগও পেলেন এবং সেইসময় দিল্লীর সুলতান কায়কোবাদ ও কায়ুমার্সকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।

দিল্লীতে খলজি বংশের প্রথম শাসক জালালউদ্দিন খিলজি-র শাসন শুরু হওয়ার ঘটনা ‘খলজী-বিপ্লব‘ নামে পরিচিত হল। জালালউদ্দিনের বয়স সেইসময় ৭০।

বৃদ্ধ হৃদয়-মন কঠোরতা ভুলে সহনশীল, শান্ত। কিন্তু সুলতানের এমন মনোভাব মালিক গুরসাম্পের ভালো লাগলো না। ভাবছেন মালিক গুরসাম্প কে ?

আসলে ইনিই হলেন আলাউদ্দিন খিলজি। জালালউদ্দিনের ভাইয়ের ছেলে এবং জামাই তিনি। একজন দক্ষ কূটনীতিক খেলোয়াড়, দুর্ধর্ষ সেনানায়ক এবং প্রচণ্ড উচ্চাভিলাষী।

আলাউদ্দিন সিংহাসনের লোভে বৃদ্ধ জালালউদ্দিন খিলজিকে হত্যা করে সিংহাসনের দখল নিলেন। নিজেকে গ্রীকবীর আলেকজান্ডারের সমান ভাবতেন।

নিজের মুদ্রায় নিজেকে ‘সিকান্দার সানি’ বলে অভিহিত করেছেন।

১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে চিতোরের রানীকে লাভের জন্য আলাউদ্দিন খিলজির চিতোর আক্রমণ ইতিহাসে এক রোমাঞ্চকর ঘটনা।

রাঘব চেতনের কথামতো সুলতান আলাউদ্দিন চিতোরে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু চিতোরের প্রকাণ্ড দুর্গ দেখে সুলতানের চোখ কপালে ওঠার যোগাড়।

এমন দুর্ভেদ্য দুর্গ আক্রমণ করে ধ্বংস করা মুখের কথা নয়। আলাউদ্দিন মতলব আঁটলেন।

তিনি দুর্গ দখল করতে নয় বরং চিতোরের রানীকে একবার চোখের দেখা দেখেই চলে যাবেন।

এই বার্তা দূত মারফৎ রাজা রতন সিংহের কাছে পৌঁছে দিলেন। রতন সিং আলাউদ্দিনের শক্তি সম্পর্কে অবগত ছিলেন।

তিনি ভাবলেন যদি কোনো রকমে সুলতান দুর্গ অবরোধ করেন তাহলে যুদ্ধ অনিবার্য।

রানীও কম নন। তিনি শর্ত দিলেন সামনাসামনি সুলতানকে দেখা দেবেন না।

তার পরিবর্তে দুর্গের জলাশয়ে তাঁর মুখের যে ছবি ভেসে উঠবে, তাই দেখে আলাউদ্দিনকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

সুলতান শর্ত মেনে নিয়ে দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করলেন।

যখন জলে রানীর মুখ দেখতে পেলেন তখন সুলতানের মাথা ঘুরে গেল। তিনি একি দেখছেন, রানীর এই রুপ যে কল্পনার অতীত।

রুপের যে বর্ণনা শুনেছেন তার চাইতেও এই রুপ হীরের ছটার মতো ঠিকরে পড়ছে।

কৌশল করে রতন সিংকে বন্দী বানিয়ে আলাউদ্দিন খিলজি নিজের শিবিরে নিয়ে গেলেন।

চিতোরে খবর পাঠালেন পদ্মাবতীকে সুলতানের হাতে তুলে দিলেই রতন সিং মুক্তি পাবে।

রাজা রতন সিং-এর অনুপস্থিতিতে চিতোরের সিংহাসনে সংকট ঘনিয়ে আসে। রাজার প্রাণ একমাত্র তাঁর রানীই রক্ষা করতে পারবে।

বিনিময়ে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির কাছে চিতোরের রানীর নিজেকে সঁপে দিতে হবে। রানী বাহাদুরি দেখালেন। ফন্দি আঁটলেন তিনি সুলতানের ডেরায় যাবেন কিন্তু তাঁর সাথে থাকবে ১৫০জন সখীদের দল।

এই মর্মে সুলতানের কাছে খবর দেওয়া হল। আসলে সেদিন ১৫০ সখী নন পালকির ভেতরে ঘাপটি মেরে বসেছিল বাছাই করা ১৫০জন দুর্ধর্ষ রাজপুত যোদ্ধারা।

এঁদের নেতৃত্ব দিয়েছিল গোরা এবং বাদল নামে দুজন বিশ্বস্ত রাজপুত সেনাপতি। শিবিরে পোঁছে সুলতানের বাহিনীকে প্রস্তুত হওয়ার সময় না দিয়ে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজপুত সেনারা।

রতন সিংকে মুক্ত করে চিতোরের দুর্গে ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

রতন সিং চিতোরগড় দুর্গে ফিরে এলেও রাজ্যের সর্বত্র ভয় দানা বেঁধে ওঠে। আলাউদ্দিন খিলজির চিতোর আক্রমণ-এর ভয়। সুলতান ক্রোধে ফেটে পড়লেন।

নিজের সেনাবাহিনীকে চিতোর দুর্গে হামলা চালাবার হুকুম দিলেন। দিনের পর দিন দুর্ভেদ্য চিতোরগড় কেল্লায় হামলা করে কোনো লাভ হল না।

শুরু হল কেল্লা অবরোধের পালা। রাজপুতরা বীর এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দুর্গের ভিতরে খাদ্যসহ অন্যান্য রসদ ফুরিয়ে আসায় তাঁদের শক্তি কমতে থাকে।

সুলতানের বাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। রাজপুত সৈনিকরা ‘সাকা’ প্রথা পালনের জন্য তৈরি হলেন। সাকা অর্থাৎ যুদ্ধ করতে করতে জীবন দেওয়া।

রণসাজে সজ্জিত হয়ে দুর্গের বাইরে বেরিয়ে আলাউদ্দিনের বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরা। বিরাট পরাজয় হল রাজপুত বাহিনীর। এতক্ষণে আলাউদ্দিন খিলজি দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করেছেন।

কিন্তু কোথায় রাজা রতন সিং-এর সুন্দরী পত্নী ? যাকে লাভ করার জন্য এতকিছু করা। সুলতান দেখলেন কেল্লার ভিতরে অগ্নিকুণ্ডে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।

আর সেখানে পড়ে আছে রাজপুত মহিলাদের পোড়া শরীরের অবশিষ্টাংশ। বুঝতে দেরি হল না আসলে কি ঘটেছে।

রাগে পাগলের মতো তাণ্ডব শুরু করলেন আলাউদ্দিন খিলজি। লুকিয়ে থাকা প্রায় ৩০-৩৫ হাজার রাজপুত নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে হত্যালীলা চালালেন।

রাজপুত রাজপরিবারে তৎকালীন সময়ে একধরণের প্রথা চালু ছিল। প্রথার নাম ‘জওহর‘। এর মানে, বিশাল এক অগ্নিকুণ্ড বানিয়ে রাজপুত মহিলাদের সেই অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া।

কেন এমন করা হত ? আসলে শত্রুদের হাতে নিজের প্রাণ এবং সম্মান বাঁচাতে রাজপুত রমণীরা এই পদক্ষেপ নিতেন। নিজেদের আব্রু শত্রুদের হাতে তুলে দেওয়ার চাইতে আত্মহনন অনেক ভালো।

কিন্তু এই আত্মহনন ভীরুতা বা কাপুরুষতার লক্ষণ নয়। আগুনের পবিত্র লেলিহান শিখায় রাজপুত রমণীরা ঝাঁপ দিয়ে নিজের পবিত্রতা রক্ষা করতেন। তবে এই ঘটনা ভারতে প্রাচীন।

ইতিহাসে এর প্রমাণ আছে। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু আক্রমণ করেন। সিন্ধুর রাজা দাহির যুদ্ধে নিহত হলে তাঁর স্ত্রী জওহর পালন করেছিলেন।

এছাড়া গোয়ালিয়র, রণথম্ভর ইত্যাদি স্থানেও এমন ঘটনা ঘটেছে। চিতোরগড় কেল্লার ইতিহাসে প্রথম জওহর পালনের ঘটনা রানী পদ্মাবতী সহ রাজপুত মহিলাদের আত্মাহুতি।

তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, দিল্লী সালতানাতের আলাউদ্দিন খিলজির হাতে নির্যাতন সইবার চেয়ে শিশু সন্তানসহ অগ্নিকুণ্ডে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া ঢের ভালো।

তাইতো সেদিন নববধূর পোশাক, অলঙ্কারে সেজে আগুনকে গ্রহণ করার মতো চরম পথকে বেছে নেওয়াই যুক্তিসঙ্গত মনে করেছিলেন চিতোরের রাজমহিষী।

সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি চিতোরের দুর্গে বিজেতা হিসেবে প্রবেশ করেছিলেন। কিন্তু যাকে লাভের জন্য এতকিছু সেই পদ্মাবতী তো সুলতানকে অনেক আগেই ফাঁকি দিয়েছেন।

দুর্ভেদ্য চিতোর কেল্লা জিতেও বিফলতা গ্রাস করল আলাউদ্দিনকে। মনস্থ করলেন দিল্লী ফিরে যাবেন।

তবে যাওয়ার আগে নিজের পুত্র খিজির খান-কে চিতোরগড়ের নতুন শাসক হিসেবে বসিয়ে দিয়ে গেলেন। খিজির খানের নাম অনুসারে চিতোরগড়ের নাম হল খিজিরাবাদ

আলাউদ্দিন খিলজি খিজিরাবাদের প্রতিষ্ঠা করলেও ফের ক্ষমতা গিয়ে পড়ে রাজপুতদের হাতে।

এতক্ষণ যে কাহিনী এখানে তুলে ধরা হল তার সত্যতা কতটা তা বলা কঠিন। তবে আলাউদ্দিন খিলজি যে চিতোর আক্রমণ করেছিলেন তা আমীর খসরুর কলমেই ধরা পড়েছে।

কারণ তিনি সুলতানের দরবারের ইতিহাস লেখার কাজ সেইসময় করেছেন। কিন্তু এই কাহিনী ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কবি মালিক মুহাম্মদ জায়েসির লেখা ‘পদ্মাবত‘ কাব্যে স্থান পায়।

সম্পূর্ণ আওয়াধির হিন্দি ভাষায় পদ্মাবত কাব্য রচিত হয়েছিল।

জায়েসি মধ্যযুগের একজন কবি ছিলেন। উত্তরপ্রদেশের সুফি স্থান জায়সে-তে তিনি জন্মান তাই নামের পাশে জায়েসি কথাটি ব্যবহার করা হয়।

তাঁর রচিত এই কাব্যটি কালজয়ী কাব্য। অনেক পরে আবুল ফজল, ফিরিশতা প্রমুখ বিখ্যাত ইতিহাসবিদদের লেখাতেও জায়েসির কাহিনী স্থান পেয়েছে।

রাজা রতন সিং- এর মৃত্যুকে জায়েসি অন্যভাবে দেখিয়েছেন। জায়েসির কাব্যে দেখা যায় আলাউদ্দিন রতন সিং-কে বন্দী করে নিয়ে যান। চিতোরের রানী তখন একাকী।

এই সুযোগে দেবপাল নামে এক রাজা চিতোরের রানীর প্রতি দৃষ্টি দেন। রতন সিং সুলতানের কয়েদ থেকে মুক্ত হয়ে চিতোরে এসে এই খবর পান। তিনি দেবপালের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং তাঁকে হত্যা করেন।

নিজেও কিছুটা আহত হন। পরে রতন সিং-এর মৃত্যু ঘটে। আসলে আলাউদ্দিন খিলজি দ্বারা চিতোর দখলের ঘটনাই পদ্মাবত কাব্যের মূল বিষয়বস্তু। আর সব মিলিয়ে বলা যায় আলাউদ্দিনের চিতোর বিজয় ঐতিহাসিক সত্য।

পদ্মাবতী এবং পদ্মাবত দুটি কাব্যের মধ্যে বুঝতে অসুবিধা হলে জানিয়ে রাখি দুটি কাব্যই প্রায় এক। পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থটি জায়েসির পদ্মাবত কাব্য থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আরাকান রাজসভার কবি সৈয়দ আলাওলপদ্মাবতী‘ কাব্যের রচয়িতা। প্রায় ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মাবতী’ রচিত হয়। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই মুসলমান কবির অনুবাদিত কাব্যগ্রন্থটি এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

আরাকান রাজসভার অমাত্য মাগন ঠাকুরের উৎসাহে কবি আলাওল এটি রচনার কাজে হাত দেন। কাব্যটি মূলত রচিত হয়েছিল সাধুভাষায় এবং ত্রিপদী পয়ার ছন্দে।

রত্নসেন, নাগমতি, পদ্মাবতী, আলাউদ্দিন খিলজি এই রোমান্টিক প্রেমকাব্যের প্রধান চরিত্র। কবির ভাষা ব্যবহার অত্যন্ত সরল ও সাবলীল। তাই গ্রন্থটি আলাদা রুপ পেয়েছে।

কাহিনী রানী পদ্মাবতীকে নিয়েই। পদ্মাবতীর রুপে মুগ্ধ হয়ে আলাউদ্দিন জোর করে তাঁকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় রত্নসেনের চিতোর আক্রমণ করেন।

কিন্তু পদ্মাবতী সুলতানের হাতে নিজেকে ধরা না দিয়ে জওহরের মতো আত্মহননের পথ বেছে নেন। প্রেমকে মুখ্য রেখে বাঙ্গালীর কাব্য পিপাসা মিটিয়েছেন আলাওল।

আসলে প্রেম নিয়ে নায়ক ও খলনায়কের মধ্যেকার যুদ্ধই পদ্মাবতী কাব্যের মূল বিষয়বস্তু। আলাওল এমনভাবে রচনা করেছেন যেখানে বর্ণনা জীবন্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। ধন্য হয়েছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য।

রাজস্থানের একজন বীরাঙ্গনা রাজমহিষীর যে কাহিনী আমরা শুনলাম তা সত্যিই শিহরণ জাগায়। ইতিহাসও হার মানে। ভারতের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে চিতোরগড় কেল্লা। একসময় এই দুর্ভেদ্য কেল্লাকে দিল্লীশ্বর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। আক্রমণের উদ্দেশ্য চিতোরের রানীকে লাভ করা। কিন্তু সুলতান অসফল হন। রানী পদ্মাবতী জওহর প্রথার মাধ্যমে আত্মবলিদান দেন। তাঁর পরাক্রম প্রমাণ করে রাজপুতরা শত্রুর কাছে কখনো মাথা নত করে না। চিতোরের রানীর পরাক্রমে ভারত আজও গর্বিত বোধ করে।

১) মহারাজা রতন সিং কে ছিলেন ?

মেওয়ার রাজ্যের রাজপুত বংশের রাজা হলেন রাওয়াল রতন সিং। মেওয়ারের গুহিলা রাজবংশের রাওয়াল রাজা সমরসিংহের পুত্র ছিলেন তিনি।

২) আলাউদ্দিন খিলজি কেন চিতোর আক্রমণ করেছিলেন ?

১৩০৩ সালে দিল্লীর সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি মেওয়ারের রাজধানী চিতোর আক্রমণ করলেন। চিতোরের রূপবতী রানীকে লাভ করার উদ্দেশেই এই আক্রমণ তিনি করেছিলেন। রতন সিংহ এই যুদ্ধে রাজপুত বীরের ন্যায় মৃত্যুবরণ করেন।

৩) মালিক মুহাম্মদ জায়েসি কবে পদ্মাবত রচনা করেন ?

১৫৪০ খ্রিস্টাব্দে কবি মালিক মুহাম্মদ জায়েসির লেখা ‘পদ্মাবত‘ কাব্যে স্থান পায়। সম্পূর্ণ আওয়াধির হিন্দি ভাষায় পদ্মাবত কাব্য রচিত হয়েছিল।

৪) রানী পদ্মিনী কে ?

সিঙ্ঘাল রাজ্যের অপরুপ সৌন্দর্য, রুপ, গুণের অধিকারী রাজকুমারী হলেন পদ্মাবতী। রাজা রাওয়াল রতন সিং রাজকুমারী পদ্মাবতীকে রানী রুপে গ্রহণ করায় নাম হয় রানী পদ্মিনী।

৫) পদ্মাবতী কত সালে রচিত ?

প্রায় ১৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মাবতী’ রচিত হয়।

৬) পদ্মাবতী কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা কে ?

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের আরাকান রাজসভার কবি সৈয়দ আলাওলপদ্মাবতী‘ কাব্যের রচয়িতা। আরাকান রাজসভার অমাত্য মাগন ঠাকুরের উৎসাহে কবি আলাওল এটি রচনার কাজে হাত দেন। কাব্যটি মূলত রচিত হয়েছিল সাধুভাষায় এবং ত্রিপদী পয়ার ছন্দে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!