মহাবীর ও জৈন ধর্ম । Mahavira and Jain religion

মহাবীর ও তাঁর জৈন ধর্ম ভারতীয় জগৎকে যে প্রভাবিত করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বৈদিক যুগের শেষদিকে ধর্মব্যবস্থা জটিল হয়ে পড়েছিল।

ব্রাহ্মণ্য শ্রেণী ধর্মকে সম্পূর্ণ নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসে।

যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠানে নির্বিচারে পশুবলি দিতে থাকে। যার ফলে গরুর চাহিদা এইসময়ে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এইরকম ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের মাধ্যমে ব্রাহ্মণ্য সমাজ আসলে অর্থ উপার্জনের দিকেই ঝুঁকেছিল।

স্বাভাবিকভাবেই সমাজে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে ধর্ম আন্দোলন। এই ধর্ম আন্দোলনকেই প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন বলা হয়।

এইসময় বহু ধর্মের উৎপত্তি হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে প্রতিবাদী ধর্মমত হিসেবে জৈন ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মই বেশি জনপ্রিয়তা পায়।

জৈন ও বৌদ্ধ দুই ধর্মেরই প্রতিষ্ঠাতারা ছিলেন বংশে ক্ষত্রিয়। অ-ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হাতে জন্ম নিল এই দুটি ধর্মমতের। 

জৈন ধর্মের প্রবর্তক হলেন মহাবীর। আর বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ। 

মহাবীরের সময়েই এই ধর্ম প্রতিষ্ঠিত ও সম্প্রসারিত হয়েছিল। তবে জৈন ধর্ম ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের মতো ভারতের বাইরে ছড়াতে পারেনি।

ভারতে আজও বহু জৈন অনুরাগী আছেন যাঁরা জৈন ধর্মের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে এই অনুরাগীরা বেশিরভাগই অবস্থাসম্পন্ন বণিকগণ।

Mahavira & jain religion,মহাবীর ও জৈন ধর্ম

মহাবীর জৈন ও জৈন ধর্ম  ( Mahavira )

১) জন্ম ও বংশপরিচয়

জৈন ধর্মের প্রধান প্রচারক ছিলেন মহাবীর। জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা না হলেও জৈন ধর্মকে প্রকৃত অর্থে তিনিই এগিয়ে নিয়ে যান।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৪০ অব্দ নাগাদ বৈশালীর কুণ্ডগ্রাম বা বর্তমান বিহারের বসকুন্ড-তে মহাবীর জন্মগ্রহণ করেন।

মহাবীরের পিতা সিদ্ধার্থ গ্রামের জ্ঞাতৃক নামে একটি গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন। আর মাতা ত্রিশলা ছিলেন লিচ্ছবী রাজা চেতকের বোন।

জীবনের প্রথমদিকে একজন ক্ষত্রিয় যুবরাজ হিসেবেই শিক্ষালাভ হয়েছিল মহাবীরের।

এরপর জীবনের যথাসময়ে যশোদা নামে একটি মেয়ের সাথে মহাবীরের বিবাহ হয়। এমনকি প্রিয়দর্শনা নামে একটি কন্যা সন্তানেরও জনক হন মহাবীর। 

২) মহাবীরের বিভিন্ন নামগুলি ( Mahavira )

মহাবীর ছাড়াও বর্ধমান, জ্ঞাতপুত্র, ন্যায়পুত্ত, বেসালিয়, বেদেহদিন্ন এইসকল নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। প্রথম তিনটি নামের অর্থ জানা যায়।

মহাবীর নামের মধ্যে বীরত্ব, নির্ভীকতা প্রকাশ পায়।

জানা যায় যে, দুঃখকষ্টকে বীরত্বের সাথে অতিক্রমের মানসিকতা ছিল তাঁর। তাই নাম রাখা হয় মহাবীর।

অপর নাম বর্ধমান অর্থাৎ যা বেড়ে চলে।

মনে করা হয় মহাবীরের জন্মের পর রাজ্যের ধন সম্পদ, মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাই এইরূপ নামকরণ করা হয়। আর জ্ঞাতপুত্র নাম হয় জ্ঞাতৃক বংশে জন্মের কারণে।

৩) মহাবীরের গৃহত্যাগ

পিতা মাতার অনুরোধে মহাবীর সাংসারিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এমনটাই মত শেতাম্বর জৈন সম্প্রদায়ের।

কিন্তু দিগম্বর নামে জৈনদের অন্য সম্প্রদায়গণ মনে করেন মহাবীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি।

এসব সত্বেও বলা যায় সাংসারিক সুখ, বিলাসিতা, মোহ তাঁকে আকর্ষিত করতে পারেনি। তাই মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মুক্তির পথের খোঁজে গৃহত্যাগ করেন।

বেছে নেন কঠোর তপস্যার জীবন।

তপস্যা জীবনের প্রথমদিকে সামান্য একখণ্ড কাপড়ে কাটালেও পরবর্তী জীবদ্দশায় পুরোপুরি নগ্ন অবস্থা ধারণ করেছিলেন।

গৃহত্যাগের পর বারো বছর বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে কাটান মহাবীর। লক্ষ্য ছিল একটাই জীবের মুক্তির পথ অনুসন্ধান। কঠোর তপস্যার ফল মিললো তেরোতম বছরে।

মহাবীর কৈবল্য বা বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভ করলেন। এই জ্ঞানলাভের মাধ্যমে জয় করে নিলেন সমস্ত সুখদুঃখকে।

মহাবীরের নাম হোলো জিন অর্থাৎ বিজেতা। জিন নামের কারণ মহাবীর জগতের সুখদুঃখকে জয় করেছেন বলে। 

আর এই জিন নাম থেকেই মহাবীরের ধর্মঅনুগামীদের নাম হোলো জৈন।

৪) মহাবীরের জৈন ধর্মপ্রচার

একবস্ত্রে কঠোর তপশ্চর্যায় রত থেকে গৃহত্যাগের তেরোতম বছরে মহাবীর কৈবল্য লাভ করেন। ‘কেবলিন’, ‘জিন’ প্রভৃতি নামে তিনি পরিচিত হন।

সুখদুঃখকে তিনি জয় করেন। কৈবল্য বা বিশুদ্ধ জ্ঞানলাভের পর মহাবীরের খ্যাতি আরো বেড়ে যায়।

বৃদ্ধি পায় অনুরাগীদের সংখ্যা। কৈবল্য লাভের পর দীর্ঘ ত্রিশ বছর ধরে গঙ্গার তীরবর্তী স্থানগুলিতে তিনি তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন।

আরও পড়ুন : গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম

যেহেতু গাঙ্গেয় উপত্যকায় বৈশালীতেই মহাবীরের জন্ম, তাই এখান থেকেই এই ধর্মমত প্রচারিত হয়। 

সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক রাজারাও এইসময় জৈন ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট হন। যেমন তাঁরা হলেন – বিম্বিসার, অজাতশত্রু, উদয়িন প্রমুখ।

এমনটা জানা যায় যে, এইসব শাসকদের সাথে মহাবীরের ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল।

শুধু শাসকশ্রেণী নয়, সমাজের তথাকথিত চণ্ডাল, শূদ্র প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষজনও জৈনধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

মহাবীর দেখান যে, মহিলারাও পুরুষদের মতো মোক্ষলাভের অধিকারী হতে পারে। তাই চন্দনবালা নামে এক মহিলার জৈনধর্মে দীক্ষালাভ হোলো এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

৫) মহাবীরের দেহত্যাগ

ত্রিশ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে এরপর দীর্ঘ তেরোবছর কঠিন তপস্যার মাধ্যমে জ্ঞান ও নির্বাণ লাভ করেছিলেন মহাবীর। জৈন ধর্মের প্রধান প্রচারক ছিলেন তিনি।

কিন্তু জীব মাত্রেই জন্ম ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভ বা মোক্ষলাভ ঘটে।

মহাবীর ৭২ বছর বয়সে মোক্ষলাভ করেন। সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৮ অব্দ।

রাজগৃহের কাছে পাবাপুরীতেই মহাবীরের দেহত্যাগ ঘটেছিল। বর্তমানে পাবাপুরীতে মহাবীরের দেহত্যাগের স্থানে স্মারক হিসেবে একটি জল মন্দির গড়ে তোলা হয়েছে।

জৈন ধর্মমত ( Mahavira )

মহাবীর, জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা না হয়েও তিনিই ছিলেন এই ধর্মের প্রধান প্রচারক।

জৈন ঐতিহ্য অনুসারে মহাবীরের আগে মোট ২৩ জন তীর্থঙ্কর আবির্ভূত হয়েছিলেন। ঋষভদেব বা আদিনাথ হলেন জৈন ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর।

আর পার্শ্বনাথ ছিলেন জৈনদের তেইশতম তীর্থঙ্কর। এই তীর্থঙ্করগণরা তাঁদের সময়কালে জৈন ধর্ম প্রচার করেছেন।

তবে এঁদের সময় জৈন ধর্মমত ততটা জনপ্রিয়তা পায়নি। মহাবীর ২৪তম এবং শেষ জৈন তীর্থঙ্কর রূপে আবির্ভূত হলেন।

জৈন ঐতিহ্য অনুযায়ী, তেইশতম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মৃত্যুর ২৫০ বছর পর নাকি মহাবীরের জন্ম হয়। 

মহাবীরের আবির্ভাব জৈন ধর্মের প্রচারে এক ঐতিহাসিক দিকরূপে চিহ্নিত হোলো। তিনি সম্প্রসারিত করলেন জৈন ধর্মমতকে।

(১) তীর্থঙ্কর কারা 

জৈন ধর্মের সাথে তীর্থঙ্কর কথাটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবার প্রশ্ন এই তীর্থঙ্কর কারা ? বা এই তীর্থঙ্কর কথার অর্থ কি ?

জৈন ধর্মমতে একজন তীর্থঙ্কর হলেন রক্ষাকর্তা বা ত্রাণকর্তা। সেই ত্রাণকর্তা যিনি কিনা পুনর্জন্মের জীবনের স্রোত অতিক্রম করতে সফল হয়েছেন।

অর্থাৎ তিনি মোক্ষলাভে সমর্থ হয়েছেন।

এবং তাঁর সেই সফলতার পথ যাতে অন্যরা অনুসরণ করতে পারে তার জন্য একটি সুগম পথ তিনি তৈরী করেছেন।

এক্ষেত্রে তীর্থঙ্কর হয়ে উঠেছেন একজন শিক্ষক। সেই শিক্ষক যিনি তাঁর শিষ্যদের জীবনের মুক্তিলাভের উপায় বাতলেছেন।

(২) জৈন তীর্থঙ্করদের তালিকা 

জৈন ধর্মে তীর্থঙ্কর-এর সংখ্যা মোট চব্বিশ জন। এই সকল তীর্থঙ্করদের নামের তালিকা ও তাদেরকে চিনবার প্রতীক চিহ্নগুলি সম্পর্কে নীচে দেওয়া হোলো। এঁরা হলেন যথাক্রমে –

  • ১) ঋষভদেব বা আদিনাথ ( প্রতীক – ষাঁড় )
  • ২) অজিতনাথ ( প্রতীক – হাতি )
  • ৩) সম্ভব নাথ ( প্রতীক – ঘোড়া )
  • ৪) অভিনন্দনাথ ( প্রতীক – বানর )
  • ৫) সুমতিনাথ ( প্রতীক – রাজহংস )
  • ৬) পদ্মপ্রভ ( প্রতীক – পদ্ম )
  • ৭) সুপার্শ্বনাথ ( প্রতীক – স্বস্তিক )
  • ৮) চন্দ্রপ্রভ ( প্রতীক – চাঁদ )
  • ৯) সুবিধিনাথ ( প্রতীক – শুশুক বা মকর )
  • ১০) শীতলানাথ ( প্রতীক – শ্রীবৎস / কল্পতরু বৃক্ষ )
  • ১১) শ্রেয়ংসনাথ ( প্রতীক – গন্ডার )
  • ১২) বাসুপূজ্য ( প্রতীক – মহিষ )
  • ১৩) বিমলনাথ ( প্রতীক – শূকর )
  • ১৪) অনন্তনাথ ( প্রতীক – বাজপাখি / ভাল্লুক )
  • ১৫) ধর্মনাথ ( প্রতীক – বজ্রদন্ড )
  • ১৬) শান্তিনাথ ( প্রতীক – হরিণ )
  • ১৭) কুণ্ঠনাথ ( প্রতীক – ছাগল )
  • ১৮) অরনাথ ( প্রতীক – বৃহৎ স্বস্তিকা / মাছ )
  • ১৯) মল্লিনাথ ( প্রতীক – কলসী / ঘট )
  • ২০) মুনিসুব্রত ( প্রতীক – কচ্ছপ )
  • ২১) নেমিনাথ ( প্রতীক – নীলপদ্ম )
  • ২২) অরিষ্টনেমিনাথ ( প্রতীক – শঙ্খ )
  • ২৩) পার্শ্বনাথ ( প্রতীক – সাপ )
  • ২৪) মহাবীর ( প্রতীক – সিংহ )

আরও পড়ুন : মগধের উত্থানের ইতিহাস

(৩) জৈন ধর্মের নীতি

মহাবীরের মৃত্যুর পর জৈন ধর্মের প্রচার থেমে থাকেনি। মহাবীরের উপদেশ গুলিকে বা শিক্ষাকে জৈন ধর্মনীতির মূল ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে নেওয়া হয়। 

মহাবীরের আগে তেইশতম তীর্থঙ্কর ছিলেন পার্শ্বনাথ। ইনি একশো বছরেরও বেশি বয়সে বাংলার সম্মেত পর্বতে দেহত্যাগ করেছিলেন।

পার্শ্বনাথ জৈন ধর্মে চারটি মূল শিক্ষা বা নীতিকে সংযুক্ত করেছিলেন।

জৈন ধর্মের এই চারটি মূল নীতি ছিল – হিংসা না করা, মিথ্যে না বলা, চুরি বৃত্তি থেকে বিরত থাকা, সম্পত্তি অর্জন না করা

পরবর্তী সময়ে মহাবীর এই চারটি নীতি বা উপদেশের সাথে যুক্ত করলেন ব্রহ্মচর্য বা সংযম রক্ষার নীতিকে।

এর উদ্দেশ্য অনুগামীদের কঠোর সংযমের সাথে পবিত্র সাদামাটা জীবনযাপনে যুক্ত করা। এই পাঁচটি নীতি পঞ্চমহাব্রত নামে পরিচিত।

আসলে এগুলিই জৈনধর্মের সারকথা।

(৪) জৈন ধর্মমতে ঈশ্বর ও জীবের অস্তিত্ব

জৈনধর্মে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পুরোপুরি মেনে নেওয়া হয়নি। কারণ জৈনরা মনে করেন এই বিশ্বব্রহ্মান্ড তৈরিতে ঈশ্বরের কোনো অবদান নেই।

তাঁদের বিশ্বাস এই গোটা বিশ্বই অনন্ত। জগৎ সৃষ্টি ও ধ্বংসের পিছনে একটি চিরন্তন শাশ্বত নিয়ম দায়ী।

মানুষ, জন্তুদের মতোই ঈশ্বরের শরীরেও আত্মা বিদ্যমান। এমনটাই মনে করেন জৈন ধর্মানুরাগীরা।

জৈন ধর্মের অনুগামীদের মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উত্থানের মতো পতনও ঘটবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরে। এই পতনের দিনক্ষণ শুরু হয়েছে শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের নির্বাণ লাভের পর থেকেই।

যা নাকি চলবে অন্তত চল্লিশ হাজার বছর ধরে। তারপর আবার শুরু হবে নতুন করে উত্থানের পর্ব।

এবার আসা যাক জৈনধর্মে  জীবের অস্তিত্বের প্রশ্নে। জৈনরা কিন্তু জীবের অস্তিত্বে ব্যাপক বিশ্বাসী।

মানুষ ও জন্তু জানোয়ার ছাড়াও প্রাণ আছে মাটি, জল, পাথর, বায়ু, আগুন এই সবেতেই।

জৈনদের ভাষায় এগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই আত্মা রয়েছে। কিন্তু এরা আলাদা কর্ম নামক বস্তুতে।

কর্মের বন্ধনেই মানুষ আবদ্ধ। কর্ম বন্ধন সাংসারিক বন্ধনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। জৈনধর্ম এই বন্ধন থেকেই মুক্তিলাভের কথা বলছে।

জৈনরা মনে করেন এই মুক্তিলাভ সম্ভব বিশুদ্ধ কর্মের মাধ্যমে। অর্থাৎ কর্মের দ্বারাই কর্মের খণ্ডন।

তাই এই কর্মবন্ধন ছিন্ন করে জীবনের মুক্তিলাভ বা নির্বাণ লাভকেই জৈনধর্মে পরম সুখলাভ বলা হয়েছে।

(৫) জৈন ধর্মের ত্রিরত্ন নীতি

জৈনধর্মে পুনর্জন্মের বিষয়টিকে নস্যাৎ করা হয়েছে। জৈনরা কর্ম বন্ধনকে ছিন্ন করে মোক্ষ বা মুক্তিলাভের কথা বারেবারে বলেছেন।

পুনর্জন্মের দ্বারা জীব কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই জৈন বিশ্বাস অনুযায়ী কর্মবন্ধন ছিন্ন করলেই মুক্তিলাভ হবে।

তবে এই মুক্তিলাভের পথ ততটা সহজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর সংযম ও নিয়মানুবর্তিতা।

তাই মহাবীর এই মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে তিনটি পথের হদিশ দিয়েছেন। এগুলি হোলো – সৎ বিশ্বাস, সৎ আচরণ, সৎ জ্ঞান

এই তিনটি নীতি একত্রে ‘ত্রিরত্ন নীতি‘ নামে পরিচিত।

(৬) জৈনধর্মে অহিংসা নীতি

‘অহিংসা পরম ধর্ম’ – এই বাণীটি আমাদের মজ্জায় গেঁথে রয়েছে। সেই অহিংসার ওপরই জৈনধর্মে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

অহিংসা নীতির ওপর জৈনদের কঠোর বিশ্বাস অন্য ধর্মের থেকে জৈনধর্মকে আলাদা করেছে। 

যেকোনো জীবের প্রতি হিংসা প্রদর্শন করাকে এই ধর্মে পাপাচারের সমান বলা হয়েছে।

জৈনদের ধারণা, মানুষ ও অন্য জীবেরা অহিংসা নীতির দ্বারাই পাপকর্ম থেকে পরিত্রান পেতে পারে। একটি ক্ষুদ্র পিঁপড়েকেও মেরে ফেলা জৈনধর্ম অনুযায়ী অপরাধ।

যেহেতু জৈনরা বিশ্বাস করে জল, পাথর ইত্যাদিতে প্রাণ আছে সেহেতু জলে পাথর ছুঁড়ে ফেলাও অপরাধের মধ্যে পড়ে।

কারণ জৈন অনুরাগীদের মতে অজীব বস্তুর মধ্যেও আত্মা বিদ্যমান। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় কোনো কীট যাতে শ্বাসের মাধ্যমে বিনষ্ট নাহয় সেবিষয়েও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

জমিতে চাষ করার সময় কীটপতঙ্গকে নষ্ট করাও ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ হিসেবে এই ধর্মে দেখা হোতো। তাই জৈনরা পেশা হিসেবে ব্যবসাকে বেছে নিয়েছিল।

কারণ ব্যবসার দ্বারা না ছিল জীবকে আঘাতের সম্ভাবনা, আবার অন্যদিকে মিতব্যয়িতাকেও উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল এই ধর্মে।

তাই দেখা গেছে বণিকরাই জৈনধর্ম গ্রহণ করেছিল। সেই ট্র্যাডিশন আজও বজায় আছে।

আরও পড়ুন : শঙ্করাচার্য

জৈনধর্মের দুটি ভাগ 

  • মহাবীরের মৃত্যুর পর তাঁর উপদেশ বা শিক্ষার কিন্তু মৃত্যু ঘটেনি। কিন্তু জৈনধর্মের ইতিহাসে একটি ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার সূত্রপাত চতুর্থ শতকের শেষদিকে। এইসময় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেওয়ায় জৈন ধর্মাবলম্বীরা গঙ্গা উপত্যকার অঞ্চল ছেড়ে দাক্ষিণাত্যে চলে যায়। 
  • দক্ষিণ ভারতে চলে আসা জৈন সন্ন্যাসীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ভদ্রবাহু। মহাবীরের নগ্নদেহে তপস্যার নীতির সমর্থক ছিলেন ভদ্রবাহু। তাই ভদ্রবাহুর জৈন অনুগামীরা পরিচিত হন ‘দিগম্বর‘ নামে। এই দিগম্বর গোষ্ঠীর অনুগামীরা জৈন ধর্মের প্রথম ভাগ। 
  • যে জৈন সন্ন্যাসীরা দক্ষিণ ভারতে না এসে গঙ্গা উপত্যকার অঞ্চলেই থেকে গেলেন তাঁদের নেতৃত্ব দিলেন স্থুলভদ্র। স্থুলভদ্রের নেতৃত্বাধীন এইসকল জৈন অনুগামীরা পরিচিত হন ‘শেতাম্বর‘ নামে। এই শেতাম্বর গোষ্ঠীর অনুগামীরা স্থুলভদ্রের নির্দেশে ছোট্টো একখণ্ড কাপড় শরীরে পরিধান করতেন। শেতাম্বর গোষ্ঠী জৈন ধর্মের দ্বিতীয় ভাগ।
জৈনধর্মের ধর্মগ্রন্থ

প্রথমদিকে জৈনধর্মের উপদেশগুলি মুখে মুখেই থাকতো। পরে উপদেশগুলির লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

তৃতীয় শতাব্দী থেকে শুরু হয় উপদেশগুলির লেখার কাজ। ইতিমধ্যেই মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে।

মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তিনিও জৈনধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর ওপর জৈন উপদেশ লিপিকরণের দায়িত্ব এসে পড়ে।

জৈন আচার্য ভদ্রবাহু ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের ধর্মীয় শিক্ষাগুরু। ভদ্রবাহু ‘কল্পসূত্র‘ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

এই গ্রন্থটিকে জৈনদের প্রথম লিখিত ধর্মগ্রন্থ বলে মানা হয়।

কল্পসূত্র গ্রন্থে ১৪টি জৈন অনুশাসন যা মহাবীরের বাণী হিসেবে পরিচিত সেটিকেই সংকলিত করা হয়েছিল।

ভদ্রবাহু মারা গেলে তাঁর ও সম্ভূতবিজয়ের শিষ্য স্থুলভদ্র পাটলিপুত্রে ( বর্তমান পাটনা ) প্রথম জৈন সংগীতির অধিবেশন ডাকেন।

এই জৈন অধিবেশনে ১৪টি জৈন অনুশাসনের পরিবর্তে ১২টি অনুশাসনকে মর্যাদা দেওয়া হয়।

অনুশাসন বা মহাবীরের বাণীগুলি বারোটি খন্ডে সংকলিত হয়ে রচিত হয় ‘দ্বাদশ অঙ্গ’

প্রাকৃত ভাষায় রচিত হওয়া এই দ্বাদশ অঙ্গই জৈন ধর্মগ্রন্থ নামে পরিচিত। পরে দ্বাদশ অঙ্গ চার ভাগে বিভক্ত হয়েছিল। অঙ্গ, উপাঙ্গ, মূল ও সূত্র।

উপসংহার

ক্ষত্রিয় বংশজাত মহাবীর ছিলেন এই ধর্মের প্রবক্তা। মহাবীরের সময়েই জৈনধর্ম প্রসারলাভ করেছিল।

বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে যে ধর্মআন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার পরিণতি হিসেবে জৈনধর্মের সৃষ্টি হয়।

যদিও বৌদ্ধ ধর্মের মতো জৈনধর্ম ভারতের বাইরে ততটা প্রচারিত হয়নি। ভারতের মধ্যে থেকেই মানুষকে দেখিয়েছিল মুক্তির পথ।

সমাজের উচ্চ-নীচ ভেদাভেদহীন, সহজ সরল এই ধর্মমত সেইসময় ভারতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

আজও ভারতের নির্দিষ্ট কিছু অংশে যেমন, গুজরাত, রাজস্থান প্রভৃতি স্থানে বহু জৈন অনুগামীরা এই ধর্মের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। 

আরও পড়ুন : নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

আশা করি ‘মহাবীর ও জৈন ধর্ম’ সম্পর্কিত এই পোস্টটি পড়ে অনেককিছু জানতে পেরেছো। যদি পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে তোমাদের মতামত জানিও। পোস্টটি অন্যদের সাথে শেয়ার কোরো। তোমাদের মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে সাহায্য করে।

2 thoughts on “মহাবীর ও জৈন ধর্ম । Mahavira and Jain religion”

  1. এখানে অনেক ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে ,সেগুলো ঠিক এভাবে হবে যেমন…….1. মহাবীর জৈন ধর্ম এর প্রতিষ্ঠাতা নন,তিনি 24 তম তীর্থঙ্কর…এই কালের প্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন আদিনাথ বা ঋষাভনাথ 2. পাথর এর মধ্যে জৈন ধর্ম প্রাণ আছে বলে মনে না 3. সম্মেত শিখর পাহাড় বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত 4. জৈন ধর্ম প্রথমে নিগ্রন্থ সম্প্রদায় বা শ্রমণ সম্প্রদায় হিসেবেও জানা যেতো যার বর্ণনা অনেক প্রাচীন শাস্ত্রে বহু ভাষা তে পাওয়া যায়

    1. জন্ম ও বংশ পরিচয় সম্পর্কিত প্রথম প্যারাগ্রাফেই স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে মহাবীর জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নন। তিনি জৈন ধর্মকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। সেকারণেই তাঁর নামের সাথে বর্ধমান কথাটি ব্যবহার করা হয়। তীর্থঙ্করদের নামের তালিকাতে মহাবীরকে ২৪ তম তীর্থঙ্কর হিসেবেই দেখানো হয়েছে। আর জৈন ধর্মের ইতিহাস এতটাই প্রাচীন যে, সেই সময়কালে স্থান নিরূপণ সম্ভব ছিল না। তথ্য বলছে, সম্মেত পর্বত তৎকালীন সময়ে বঙ্গদেশের সীমানাতেই অবস্থিত ছিল। আজকের সময়ে এসে তা ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অবশ্যই জৈন ধর্ম শ্রমণ সম্প্রদায়। মহাবীরের মৃত্যুর পর জৈনরা দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!