গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম । Goutam Buddha and Buddhist Religion in bengali

আমরা সবাই জানি যে, বৌদ্ধধর্মের প্রচারক ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। গৌতম বুদ্ধের সময় চীন ও পারস্যের দুইজন প্রখ্যাত ধর্মপ্রচারক ছিলেন কনফুসিয়াস এবং জরাথুরষ্টা। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের ধর্মমত যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, তা কিন্তু এনাদের ধর্মমত সেই জনপ্রিয়তা পায়নি। গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহাসিক এ. এল. বাসাম বলেছিলেন, “বুদ্ধ ছিলেন এই কালের  ভারতের শ্রেষ্ঠ সন্তান “ 

আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ৫৬৬ অব্দে নেপালের তরাই অঞ্চলে কপিলাবস্তু নগরের কাছে লুম্বিনী উদ্যানে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হয়। বুদ্ধের বাবা শুদ্ধোধন ছিলেন ক্ষত্রিয় শাক্য জাতির নেতা। আর বুদ্ধের জন্মদাত্রী মা ছিলেন মায়াদেবী। বুদ্ধের শৈশবে নাম ছিল সিদ্ধার্থ। খুব ছোটোবয়সে তার মা মারা গেলে তার মাসি গৌতমী তাকে লালন -পালন করেন। তাই তার মাসির নাম অনুসারে তাকে গৌতম বলে ডাকা হয়। 

এইরকম বলা হয়ে থাকে যে, তিনি যখন মাতৃগর্ভে ছিলেন তখন তার মা মায়াদেবী ঘুমের মধ্যে একটি সাদাহাতি ও পদ্মফুলের স্বপ্ন দেখেছিলেন। রাজপরিবারের জ্যোতিষী সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে এই  গর্ভজাত সন্তানটি একদিন মহান শাসক অথবা মহান ধর্মপ্রচারক হবেন। এবং সত্যিই তিনি গোটা বিশ্বে একজন মহান ধর্মপ্রচারকই  হয়েছিলেন।

ক্ষত্রিয় শাক্যবংশের রীতি নীতি অনুযায়ী গৌতমও শৈশবে অস্ত্রশিক্ষা ,রথ চালনা ইত্যাদি নিয়মকানুন গুলি রপ্ত করেছিলেন। সাংসারিক জীবনও তার শুরু হয়েছিল। যতদূর জানা যায় ষোলো বছর বয়সে যশোধরা নামে এক রাজকন্যার সাথে গৌতমের বিবাহ হয়। এমনকি তাদের রাহুল নামে একটি পুত্র সন্তানেরও জন্ম হয়। কিন্তু কালের নিয়মে কোনো সাংসারিক বন্ধন গৌতম কে আটকে রাখতে পারেনি।

বৌদ্ধ দের কিছু ধর্মগ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, একদিন নগর ভ্রমণ করার সময় তার নজরে আসে  একটি বৃদ্ধ  লোক, এক রোগে জর্জরিত ব্যাক্তির যন্ত্রনার ছবি  এবং একটি মৃতদেহ। এই দৃশ্য দেখামাত্রই গৌতমের মন মুক্তির পথ খোঁজার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তিনি সেই দিন বুঝেছিলেন জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর হাত থেকে মানুষের নিস্তার নেই। কিন্তু এই দুঃখের হাত থেকে বাঁচতে মুক্তির পথ আছে। 

অবশেষে এই মুক্তির পথ খুঁজে পেতে একদিন গভীর রাত্রে গৌতম সংসার তথা গৃহ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েন। ইতিহাসে এই দিনটি বৌদ্ধদের কাছে “মহাভিনিষ্ক্রমণ” নামে পরিচিত। মাত্র ২৯ বছর বয়স ছিল তার সেইদিন। এমনকি বলা হয় থাকে যে, সেইদিন তার পুত্র রাহুলের জন্ম হয়। এরপর একজন সাধক তপস্বী হিসাবে তার জীবন শুরু হয়। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়ানোর পর তিনি বৈশালী তে গিয়ে পৌছান। বর্তমানে এই বৈশালী বিহারে অবস্থিত। সেখানে আলার কালাম নামে এক সন্ন্যাসীর সাথে গৌতমের আলাপ হয়। 

গৌতম তার কাছে ধ্যান সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। কিন্তু আলার কালামের শিক্ষাও গৌতমের মনঃপুত হয়নি। এইভাবে বেশ কিছুদিন চলার পর দুঃখের হাত থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে না পেয়ে গৌতম হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি তার লক্ষ্য থেকে একটুকুও সরে যাননি। বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি একদিন গয়ার কাছে (যা বর্তমানে বিহার রাজ্যে অবস্থিত ) উরুবিল্ব গ্রামে এক প্রকান্ড পিপুল গাছের তলায় বসেন। বলা হয়ে থাকে যে, সুজাতা নামে কোনো একটি মেয়ে গৌতম কে এক বাটি পায়েস দিয়ে সেইসময় তার ক্ষুধা মিটিয়ে ছিলেন। 

এরপর দীর্ঘ ৪৯ দিন ওই গাছটির তলায় গৌতম ধ্যানাসনে বসে থাকেন। তার প্রতিজ্ঞা ছিল দেহের শেষ রক্তবিন্দুও যদি শুকিয়ে যায় তবু তিনি ধ্যান ছেড়ে উঠবেন না। অবশেষে একদিন তার দিব্যজ্ঞান লাভ হয়। তার প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে পান। জগতের দুঃখ কষ্টের কারণ গুলি কি তা তিনি বুঝতে পারেন। যেহেতু গৌতম বোধি বা দিব্যজ্ঞান লাভ করেছিলেন, তাই তিনি বুদ্ধ নামে পরিচিত হতে থাকেন। বুদ্ধ কথাটির অর্থ জ্ঞানী। গৌতম বুদ্ধের আর এক নাম তথাগততথাগত কথাটির অর্থ, যিনি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। 

পরম জ্ঞান লাভ করার পর বুদ্ধ বারাণসীর (যা বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত ) কাছে সারনাথে আসেন। এখানে পাঁচজন সন্ন্যাসীর মধ্যে তার জ্ঞান বিতরণ করেন। এই প্রথম উপদেশ দান ইতিহাসের পাতায় “ধর্মচক্র প্রবর্তন” নামে পরিচিতি লাভ করে।  পরবর্তী কালে তার ধর্ম মগধরাজ বিম্বিসার, অজাতশত্রূ গ্রহণ করেছিলেন। এরপর তিনি কপিলাবস্তুতে যান এবং সেখানে তার বাবা শুদ্ধোধন ,মাসি গৌতমী, স্ত্রী যশোধরা, পুত্র রাহুল কে তার ধর্মে দীক্ষিত করেন। জানা যায় যে, শাক্যবংশের সাথে কলিও নামে একটি রাজবংশের দীর্ঘদিনের বিবাদ ছিল। আর সেই বিবাদ বুদ্ধের উপস্থিতিতে মিটে গিয়েছিলো। 

শুধু বারানসীতেই বুদ্ধ থেমে থাকেননি। তার ধর্মমত গয়া, নালন্দা,মগধ, কোশল এইসমস্ত বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি কোশলরাজা প্রসেনজিৎ বুদ্ধের খুব ভালো একজন শ্রোতা ছিলেন। বুদ্ধের ধর্মে প্রভাবিত হয়ে আম্রপালী নাম একজন পতিতা নারী তার আমের বাগানটি বৌদ্ধ সংঘে দান করেছিলেন। 

৩৫ বছর বয়সে দিব্য জ্ঞান লাভ করার পর দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বুদ্ধ তার ধর্মপ্রচার শান্তিপূর্ণ ভাবে চালিয়েছিলেন। শেষপর্যন্ত রাজগীর থেকে শ্রাবস্তী যাওয়ার পথে মল্লদের রাজধানী কুশীনগরে তার দেহাবসান ঘটে। আনুমানিক বয়স হয়েছিল ৮০। আনুমানিক সময়টা ছিল খ্রীষ্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ।    

বৌদ্ধধর্মের চারটি আর্যসত্য :-   

বুদ্ধদেব অতি সহজ সরল ভাষায় তার ধর্মমত প্রচার করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের মূল লক্ষ্য ছিল সত্যকে জানা। বুদ্ধদেব বলেছেন, “সমুদ্রের একটাই স্বাদ তা যেমন লবণ, ঠিক তেমনই আমার ধর্মেরও একটি মাত্র লক্ষ্য তা হল দুঃখের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করা”

এখন জেনে নেবো বুদ্ধদেব যে চারটি আর্যসত্য উপলব্ধি করার কথা বলেছেন, সেইগুলি।  

এইগুলি হল – ১) এই পৃথিবী দুঃখময়। 

                     ২) মানুষের মধ্যেকার কামনা, বাসনা ও আসক্তি থেকে এই দুঃখ জন্মায়।

 

                     ৩)  কামনা, বাসনা কে দমন করতে পারলেই এই দুঃখ থেকে মুক্তি সম্ভব।  

                      ৪) আর এই মুক্তি লাভের একটি পথ বা মার্গ আছে। 

এই মুক্তিকেই বুদ্ধদেব নির্বাণ বলে বোঝাতে চেয়েছেন।

বৌদ্ধধর্মের আটটি পথ বা মার্গ :- 

এই নির্বাণ বা মুক্তি লাভের জন্য বুদ্ধদেব আটটি পথ বা মার্গ এর কথা বলেছেন। সেগুলি জেনে নিই। 

এগুলি হল – সৎ বাক্য , সৎ কর্ম , সৎ সংকল্প , সৎ চেষ্টা , সৎ জীবিকা , সৎ চিন্তা , সৎ চেতনা , সৎ দৃষ্টি। অর্থাৎ এর অর্থ হল সততার সঙ্গে চলা। সৎ পথে থেকে হিংসা না করে সত্যকে জানা। 

গৌতম বুদ্ধ যতদিন জীবিত ছিলেন তার উপদেশ গুলি লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়নি। বুদ্ধের দেহ ত্যাগের পর রাজগৃহে (যার বর্তমানে নাম রাজগীর, বিহার রাজ্যে অবস্থিত ) প্রথম বৌদ্ধ সম্মেলন ডাকা হয়েছিলো। এই সম্মেলনেই বুদ্ধের উপদেশ গুলি তিনটি ভাগে লেখা হয়েছিল ; বিনয়পিটক , সুত্তপিটক , অভিধর্মপিটক।  বিনয়পিটকে ধর্মীয় আচার ,সুত্তপিটকে বুদ্ধের উপদেশ , অভিধর্মপিটকে বৌদ্ধদর্শনের কথা বলা আছে। এগুলিকেই একসাথে ত্রিপিটক নামে ডাকা হয়।   

এই সম্মেলনে বুদ্ধের দুই প্রধান শিষ্য উপালিআনন্দ অংশ নিয়েছিলেন। উপালি বিনয়পিটক আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। এবং আনন্দ সুত্তপিটক আবৃত্তি করে শোনান। 

বৌদ্ধ সংঘের সন্ন্যাসীরা ভিক্ষু এবং সন্ন্যাসিনীরা ভিক্ষুণী নাম পরিচিত ছিলেন। এরা সবাই ছিলেন খুবই সাধাসিধে। এরা প্রত্যেকেই হলুদ রঙের পোষাক পড়তেন। ভিক্ষার মাধ্যমে খাদ্য জোগাড় করতেন বলে এদের জীবন ছিল খুব কঠোর।

পরবর্তীকালে এই সমস্ত বৌদ্ধরা দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। একটি ভাগ হীনযান আর অপরটি মহাযান  

সব শেষে বলা যায় বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম শুধু ভারতবর্ষের মধ্যে আটকে ছিল না। তা ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। আজও পৃথিবীর বহু দেশে বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী বহু মানুষ বসবাস করেন। আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিতেও বৌদ্ধ আদর্শের প্রভাব আজও কিন্তু রয়ে গেছে। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!