মগধের উত্থানের ইতিহাস । The rise of Magadha

মগধের উত্থানের ইতিহাস ( Magadha ) আলোচনায় খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মগধের উত্থানের কারণ বিবিধ। 

আসলে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ভারতের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কাল। সেইসাথে এইসময়কালে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য সবকিছুর প্রসার ঘটে।

সবমিলিয়ে এই সময় এক যুগান্তকারী সময়।

ষষ্ঠ শতকে ভারতে কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি না থাকায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ষোলোটি মহাজনপদে বিভক্ত ছিল।

এই ষোলোটি মহাজনপদের মধ্যে কয়েকটি ছিল রাজতান্ত্রিক শক্তি এবং কয়েকটি ছিল গণতান্ত্রিক শক্তি। 

কোসল, বৎস, অবন্তী ও মগধ এই চারটি হোলো ষোড়শ মহাজনপদের প্রধান রাজতান্ত্রিক শক্তি।

অপরদিকে একটি গণতান্ত্রিক শক্তি ছিল বজ্জি বা বৃজি। এটি অবস্থিত ছিল উত্তর বিহারে। 

এইসবকটি শক্তি মিলে দীর্ঘ প্রতিদ্বন্ধিতায় লিপ্ত হয়। অবশেষে এগুলির মধ্যে শক্তিশালী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মগধ।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না কোসল, বৎস, অবন্তী, বৃজি-র মতো শক্তিগুলিও কিন্তু বেশ শক্তিশালী ছিল।

কিন্তু তা সত্বেও শেষপর্যন্ত মগধ কিভাবে এই লড়াইয়ে জয়ী হোলো সে সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক।

ধীরে ধীরে মগধ সাম্রাজ্য স্থাপনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

এখন আমাদের লক্ষ্য হোলো মগধের উত্থানের ইতিহাসকে জানা ও উত্থানের জন্য দায়ী কারণগুলোকে খুঁজে বের করা।

The rise of Magadha,মগধের উত্থানের ইতিহাস  

Table of Contents

মগধের উত্থানের কারণসমূহ ( মগধের উত্থানের ইতিহাস )

মগধের অবস্থান ছিল বিহারের দক্ষিণে পাটনা ও গয়া জেলাকে নিয়ে। ষোড়শ মহাজনপদের অন্যতম শক্তি ছিল এটি। মগধকে ঘিরে রেখেছিল গঙ্গা, শোন ও চম্পা নদী।

এই নদীগুলির থেকে মগধ পেয়েছিল প্রাকৃতিক নিরাপত্তা। মগধ নামটির উল্লেখ প্রথম পাওয়া গেছে অথর্ববেদে। চারটি বেদের মধ্যে এটি একটি।

পরে বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থতেও মগধের নাম পাওয়া যায়। প্রথমে মগধের রাজধানী ছিল রাজগৃহ বা গিরিব্রজ

এরপর বহু সময় পরে পাটলিপুত্র হয়েছিল মগধের রাজধানী। যা বর্তমানে পাটনা নামে পরিচিত। কালক্রমে এই মগধ হয়ে ওঠে শক্তিশালী। সাম্রাজ্য স্থাপনের পথে অগ্রসর হতে থাকে।

এখানে মগধের উত্থানের প্রাকৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কারণগুলি উল্লেখ করা হোলো। 

ক) মগধের উত্থানের প্রাকৃতিক কারণ –  

১) ভৌগোলিক অবস্থান

মগধের ভৌগোলিক অবস্থান মগধের উত্থানের উপযোগী ছিল। প্রকৃতি নিজেই মগধ ও তার রাজধানী রাজগৃহকে নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টন করে রেখেছিল।

গঙ্গা, শোন, গণ্ডক এই তিন নদী পরিবৃত ছিল মগধ। এই নদীগুলি পেরিয়ে মগধ আক্রমণ শত্রুদের পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। 

রাজধানী রাজগৃহও পঞ্চপাহাড় পরিবেষ্টিত থাকায় মগধের পক্ষে আত্মরক্ষার পথ সহজ হয়ে গিয়েছিল।

তাই দেখা যাচ্ছে যে, মগধের এই ভৌগোলিক অবস্থান মগধের উত্থানে খুবই সহায়ক হয়।

২) প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ 

মগধ রাজ্য সমৃদ্ধ ছিল প্রাকৃতিক সম্পদে। প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতূলতা মগধের অভ্যুত্থানের পথকে সুগম করে দেয়।

এর ফলে মগধের আর্থিক অবস্থায় স্বচ্ছলতা আসে। রাজ্যটির অরণ্য পরিপূর্ণ ছিল দামী কাঠের ভাণ্ডারে। যা মগধের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে সাহায্য করে।

এছাড়াও মগধের অন্তর্গত ধলভূম, সিংভূম, গয়া প্রভৃতি স্থানে উৎকৃষ্ট লোহা খনির উপস্থিতি ছিল।

খনিগুলি থেকে প্রাপ্ত উৎকৃষ্ট লোহা দিয়ে বানানো হোতো উন্নত অস্ত্রশস্ত্র।

মগধের একের পর এক যুদ্ধজয়ে এই অস্ত্রগুলি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল।

শুধু তাই নয়, মগধে প্রাপ্ত লোহা বৈদেশিক ক্ষেত্রে রপ্তানী করে তা থেকে আসা প্রচূর অর্থ মগধের রাজকোষে জমা হয়। সমৃদ্ধ হতে থাকে মগধের অর্থনীতি।

খ ) মগধের উত্থানের অর্থনৈতিক কারণ ( মগধের উত্থানের ইতিহাস )

১) কৃষি নির্ভর অর্থনীতি

সুদূর অতীত থেকেই ভারত কৃষিভিত্তিক দেশ। ভারতের অর্থনীতি কৃষির ওপরই নির্ভরশীল।

মগধও ভারতেরই অংশ ছিল তাই এক্ষেত্রে সেও ব্যতিক্রম নয়। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি মগধের মাথা তুলে দাঁড়ানোতে সহায়ক হয়েছিল।

মগধ গঙ্গা, শোন নদী পরিবৃত হওয়ায় এই নদীগুলির উর্বর পলিমাটিতে ভালো ফসল ফলতো।

এরফলে একই জমিতে বছরে দুবার করে ফসল ফলানোর সুবাদে কৃষি অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

কৃষকরাও নিয়মিত শুল্ক রাজকোষে জমা করায় রাজকোষ সমৃদ্ধ হয়। কৃষি থেকে আসা শুল্ক সামরিক খাতে খরচ করে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে মগধ।

যা মগধের সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবে সাহায্য করেছিল। 

২) নদীপথের নিয়ন্ত্রণ

গঙ্গা নদীর ওপর মগধের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যারফলে নৌবাণিজ্যের ওপর মগধের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।

বাণিজ্য থেকে নিয়মিত শুল্ক আসার ফলে মগধের বাণিজ্যিক উন্নতিলাভ ঘটে।

মগধের সিংহাসনে হর্ষঙ্ক বংশের রাজা বিম্বিসার আরোহণ করার পর তিনি অঙ্গ জয় করেন। অঙ্গ রাজ্য জয়ের সাথে চম্পা নদী ও চম্পা বন্দর মগধের অন্তর্ভুক্ত হয়।

চম্পা বন্দর মগধের হাতে আসায় দূর দেশের সাথে মগধ বৈদেশিক বাণিজ্যে লিপ্ত হয়।

রোমিলা থাপারের মতে, মগধের এই বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ ছিল রীতিমতো লাভজনক।

এরপর মগধ তার প্রতিদ্বন্ধী শক্তি কোসলকে পরাজিত করে সাম্রাজ্যবাদ গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

আরও পড়ুনকুষাণ যুগের শিল্পকলা

গ) মগধের উত্থানের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণ – 

১) ধর্মীয় তথা সাংস্কৃতিক জাগরণ

ধর্মীয় জাগরণ মগধের উত্থানের পক্ষে লাভজনক হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মগধে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটে।

উভয় সংস্কৃতি মিশে যাওয়ায় এক নতুন চিন্তাধারার জন্ম নেয়। যা মগধকে সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে প্রেরণা জুগিয়েছিল।

এরসাথে যুক্ত হয় গৌতম বুদ্ধের নেতৃত্বে বৌদ্ধ ধর্ম ও মহাবীরের নেতৃত্বে জৈন ধর্মের প্রসারতা।

এই দুই মতবাদের প্রসারলাভ মগধের জয়যাত্রাকে আরও গতিশীল করে তোলে।

২) যোগ্য শাসকদের আবির্ভাব

যোগ্য শাসকের বিচক্ষণতার ওপর নির্ভর করেই যে কোনো রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদের জয়যাত্রা সফল হয়। ঠিক এমনটাই হয়েছিল মগধের ক্ষেত্রেও। 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত মগধে আবির্ভাব ঘটে দক্ষ, প্রতিভাবান শাসকদের।

এই শাসকরা ছিলেন যেমন- বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ, মহাপদ্মনন্দ, ধননন্দ

এঁদের প্রত্যেকের দূরদৃষ্টি, বুদ্ধি, বিচক্ষণতাই অন্যান্য মহাজনপদ গুলিকে জয় করার স্বপ্নকে সফল করেছিল।

সবচাইতে অবাকের বিষয় হোলো যে, মগধের সিংহাসনে সবসময়ই প্রতিভাবান, প্রতাপশালী শাসকরাই থেকেছেন। কোনো অযোগ্য শাসক মগধের সিংহাসনে বেশিদিন টেকেননি।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় হর্ষঙ্ক বংশীয় নাগদশককে সরিয়ে দিয়ে প্রতাপশালী শিশুনাগ কর্তৃক শৈশুনাগ বংশের প্রতিষ্ঠা।

এছাড়াও শৈশুনাগ বংশের কালাশোককে হটিয়ে মহাপদ্মনন্দের মগধের সিংহাসন লাভের কথাও এখানে বলা যেতে পারে।

মগধের উত্থানের ইতিহাসে রাজবংশগুলির ভূমিকা

মগধের উত্থানের ইতিহাস পর্যালোচনায় রাজবংশগুলির প্রধান ভূমিকা ছিল। মগধের সিংহাসন আলোকিত করেছে একের পর এক রাজবংশ। প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য উপাদান থেকে জানা যায় বারহদ্রথ নামে রাজবংশ গোড়ার দিকে মগধ শাসন করতো। এই বংশের শেষ শাসক রিপুঞ্জয়ের মৃত্যু হলে সেই সুযোগে বিম্বিসার মগধের দখল নেন। এখান থেকেই শুরু হয় বৃহত্তর মগধের উত্থানপর্ব। মগধের রাজবংশগুলির তালিকাসহ পরিচয় নীচে তুলে ধরা হোলো। 

ক) হর্ষঙ্ক বংশ –

১) বিম্বিসার ( খ্রিস্টপূর্ব ৫৪৫-৪৯৪ খ্রিস্টপূর্ব )
  • মগধ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা করেন বিম্বিসার ( Bimbisara )। বিম্বিসার ছিলেন এই হর্ষঙ্ক বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ৫৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিম্বিসার শ্রেণিক উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
  • মগধ সাম্রাজ্যের প্রথম শক্তিশালী রাজা হলেন রাজা বিম্বিসার। 
  • বিম্বিসার ছিলেন মহামানব বুদ্ধদেবের সমসাময়িক। মগধের রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় বিবাহ সম্পর্কের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন। বিবাহের সূত্রেই তিনি বিভিন্ন রাজ্যের সাথে মৈত্রী বন্ধন ঘটিয়েছিলেন। কোসল, বৈশালী, বিদেহ ও মদ্র রাজ্যের সাথে বিম্বিসার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। 
  • কোসল রাজ প্রসেনজিতের বোন কোসলাদেবী, লিচ্ছবি বা বৈশালীর প্রধান চেতকের কন্যা চেল্লনা যথাক্রমে তাঁর প্রথমা ও দ্বিতীয়া স্ত্রী ছিলেন। তৃতীয়া স্ত্রী ছিলেন বিদেহ রাজকন্যা বাসবী ও চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন মদ্র রাজকন্যা ক্ষেমা। কোসলাদেবীকে বিবাহ করে যৌতুক হিসেবে বিম্বিসার প্রসেনজিতের কাছ থেকে কাশী রাজ্যটি পেয়েছিলেন।
  • রাজা ব্রহ্মদত্তকে পরাজিত করে তিনি অঙ্গ রাজ্য ও সেইসাথে চম্পা নদী বন্দর নিজের দখলে আনেন। অঙ্গ জয়ের দ্বারা মগধের নৌ-বাণিজ্যের উন্নতি ঘটান বিম্বিসার। গান্ধার রাজ পুস্করসারিন ও অবন্তীরাজ প্রদ্যোতের সাথে বিম্বিসারের সম্পর্ক ছিল মিত্রতাপূর্ণ। 
  • বিম্বিসারের রাজত্বকাল রাজ্যজয়ের পাশাপাশি দক্ষ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যও খ্যাত। তাঁর আমলে মগধের রাজধানী রাজগৃহতে স্থানান্তরিত হয়। বিম্বিসারের আমলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মমত প্রচারিত হয়েছিল। বুদ্ধের সমসাময়িক হওয়ায় তিনি বুদ্ধের কৃপালাভ করেছিলেন। 
  • জৈন গ্রন্থ ‘আবশ্যক সূত্র’ অনুসারে নিজের পুত্র অজাতশত্রুর দ্বারা বিষ প্রয়োগে বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে।
২) অজাতশত্রু ( খ্রিস্টপূর্ব ৪৯৪-৪৬২ অব্দ )
  • মগধে হর্ষঙ্ক বংশের দ্বিতীয় শাসক ছিলেন বিম্বিসারের দ্বিতীয়া স্ত্রী চেল্লনার গর্ভজাত সন্তান অজাতশত্রু। অজাতশত্রু ( Ajatashatru ) কুণিক উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। প্রথম দিকে চম্পার শাসক থাকলেও পরে পিতা বিম্বিসারের মতোই তিনিও মগধের সম্প্রসারণের নীতি নিয়েছিলেন। হর্ষঙ্ক বংশের গৌরব ও প্রভাব প্রতিপত্তি অজাতশত্রুর সময়ই উচ্চশিখরে ওঠে। 
  • প্রথম থেকেই সেইসময়কার দুটো বৃহৎ শক্তি কোসল ও বৃজির সাথে অজাতশত্রু সংঘর্ষে জড়ান। পিতা বিম্বিসারের সময় থেকে কাশী গ্রামের রাজস্ব ভোগ দখল করলেও কোসলরাজ প্রসেনজিত কাশী গ্রামটি ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। কারণ পিতার হত্যাকারী ও নিষ্ঠূর স্বভাবের জন্যই প্রসেনজিত এমনটা করেছিলেন। 
  • যুদ্ধে কোসলরাজ প্রসেনজিতকে পরাজিত করে অজাতশত্রু প্রসেনজিত কন্যা বজিরাকে বিবাহ করেন। উভয়ের মধ্যে মিত্রতা স্থাপিত হয়। 
  • অজাতশত্রুর আমলে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ৩৬ টি গণরাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘ সংঘর্ষ। গণরাজ্যগুলি লিচ্ছবিরাজ চেতকের নেতৃত্বে এই সংগ্রামে অংশ নিয়েছিল। অজাতশত্রু এই গণরাজ্যগুলিকে পরাজিত করেন। গঙ্গার তীরে পাটলিগ্রামে দুর্গ নির্মাণ করে মগধের পরবর্তী রাজধানী পাটলিপুত্রের সূচনা করেন।
  • তাঁর আমলেই সামরিক শক্তিতে যুদ্ধাস্ত্র রূপে ব্যবহৃত হয়েছিল মহাশিলাকণ্টকরথমুশল। মহাশিলাকণ্টক যন্ত্রের মাধ্যমে যুদ্ধের সময় বড়ো পাথরের টুকরো শত্রুপক্ষের দিকে ছোড়া হোতো। আর রথমুশল ছিল ধারালো ও তীক্ষ্ন ছুরি দিয়ে তৈরী একধরণের রথ। শত্রুদের ওপর এই রথ চালিয়ে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হোতো।
  •  বৌদ্ধ ধর্মের অনুরাগী ছিলেন অজাতশত্রু। প্রথম বৌদ্ধ সংগীতির অধিবেশন রাজগৃহে আহ্বান হয়েছিল অজাতশত্রুর সময়কালেই। প্রায় ৫০০ বৌদ্ধ ভিক্ষু এই অধিবেশনে যোগ দেন। আর এই বৌদ্ধ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছিলেন মহাকাশ্যপ। বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাসে একারণেই অজাতশত্রু বিখ্যাত হয়ে আছেন। 
  • খ্রিস্টপূর্ব ৪৬২ অব্দে অজাতশত্রুর মৃত্যু হয়।
৩) উদয়িন বা উদয়ভদ্র ( খ্রিস্টপূর্ব ৪৬২-৪৪৬ অব্দ )
  • অজাতশত্রুর পর মগধের সিংহাসনে আসীন হন তাঁর পুত্র উদয়িন ( Udayin ) বা উদয়ভদ্র। উদয়িন ছিলেন কোসলরাজ প্রসেনজিতের কন্যা বজিরার গর্ভজাত সন্তান। পিতা অজাতশত্রুর পাটলিগ্রামে নতুন রাজধানী স্থাপনের কর্মকান্ডকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন উদয়িন। 
  • গঙ্গা ও শোন নদীর তীরে পাটলিপুত্রে উদয়িন মগধের রাজধানী নিয়ে যান। ‘পরিশিষ্টপর্বণ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় উদয়িন মগধের সিংহাসনে প্রায় ১৬ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন। 
  • অবন্তী রাজ্যের সাথে সংঘাত ও অবন্তীকে পরাজিত করা উদয়িনের শাসনকালের অন্যতম ঘটনা। 
  • উদয়িন ছিলেন মনেপ্রাণে একজন জৈন ধর্মাবলম্বী।

খ) শিশুনাগ বংশ ( খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০-৩৬৪ অব্দ )

১) শিশুনাগ
  • উদয়িনের পরবর্তী তিন হর্ষঙ্ক বংশীয় শাসক ছিলেন অনুরুদ্ধ, মুন্ড, নাগদশক। শেষ শাসক নাগদশকের দুর্বলতার সুযোগে জনপ্রিয় মন্ত্রী শিশুনাগ ( Shishunaga ) মগধের সিংহাসন দখল করেন। হর্ষঙ্ক বংশের উচ্ছেদ ঘটে। 
  • ৪৩০ খ্রিস্টপূর্বে মগধে শিশুনাগ প্রতিষ্ঠিত বংশই শিশুনাগ বংশ নামেই পরিচিত। শিশুনাগের রাজত্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হোলো অবন্তী রাজ্য জয়। 
  • শিশুনাগ মগধের রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন বৈশালীতে। রাজধানী স্থানান্তরের যুক্তি ছিল যে তিনি নাকি পিতৃসূত্রে ছিলেন বৈশালীর অধিবাসী। 
  • পরবর্তীকালে শিশুনাগের পুত্র কাকবর্ণ বা কালাশোক মগধের সিংহাসনে বসেন। কালাশোক এই বংশের একজন খ্যাতনামা শাসক ছিলেন। কালাশোকের সময় মগধের রাজধানী বৈশালী থেকে আবার পাটলিপুত্রে চলে আসে। 
  • কাকবর্ণ বা কালাশোকের সময়েই দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতির সম্মেলন হয়েছিল বৈশালীতে। পাটলিপুত্রে মগধের রাজধানী পুনরায় ফিরিয়ে আনা কালাশোকের অন্যতম কীর্তি।

গ) নন্দবংশ ( খ্রিস্টপূর্ব ৩৬৪-৩২৪ অব্দ ) – 

১) মহাপদ্মনন্দ 
  • মগধে শিশুনাগ বংশের পতন হয়ে নন্দ বংশের উত্থান ঘটে। ভয়াবহ রক্তপাতের মাধ্যমে নন্দবংশের প্রতিষ্ঠা করেন মহাপদ্মনন্দ ( Mahapadma Nanda )। বিভিন্ন বিবরণ অনুযায়ী নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্মনন্দ ছিলেন শূদ্র বংশজাত। 
  • ভারতে অ-ক্ষত্রিয় রাজাদের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম। মহাপদ্মনন্দকে জৈনগ্রন্থ ‘আবশ্যক সূত্র’, বৌদ্ধগ্রন্থ ‘মহাবংশটীকায়’ অজ্ঞাতকুলশীল বলে অভিহিত করা হয়েছে। 
  • শূদ্র বংশে জন্মে মহাপদ্মনন্দের সিংহাসনলাভ ক্ষত্রিয়দের দীর্ঘ প্রাধান্য প্রতিপত্তির ওপর আঘাত হেনেছিল। এইকারণে তাঁর সিংহাসন আরোহণ ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। 
  • মহাপদ্মনন্দ ‘একরাট’ অর্থাৎ অদ্বিতীয় শাসক, ‘সর্বক্ষত্রান্তক’ অর্থাৎ সমস্ত ক্ষত্রিয়দের উচ্ছেদকারী ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
  • পাঞ্চাল, কাশী, কলিঙ্গ, অশ্মক, কুরু, মৈথিল প্রভৃতি ক্ষত্রিয় বংশগুলির উচ্ছেদ সাধন করেন তিনি। সুদূর দাক্ষিণাত্যে মহাপদ্মনন্দের আমলে মগধের সাম্রাজ্য বিস্তার ঘটে। বিভিন্ন শিলালেখ থেকে এর প্রমাণ মেলে। 
  • মহাপদ্মনন্দের মৃত্যুর পর তাঁর আটজন পুত্র মগধে রাজত্ব করেন। এঁরা সবাই একসাথে ‘নবনন্দ‘ নামে পরিচিত। 
২) ধননন্দ 
  • ‘নবনন্দের’ শেষ নন্দরাজা হলেন ধননন্দ ( Dhana nanda )। ধননন্দ ছিলেন বিখ্যাত গ্রীকবীর আলেকজান্ডারের সমসাময়িক।
  • গ্রীক লেখকদের লেখায় ধননন্দের নামকরণ হয়েছিল এগ্রামেস বা জান্দ্রামেস নামে।
  • বিশাল শক্তিশালী সামরিক শক্তির ওপর ভর করে তিনি বৃহত্তর সাম্রাজ্য শাসন করতেন। ধননন্দের সামরিক বাহিনীর ভয়ে গ্রীক সৈন্যরা ভারতে বেশিদূর এগোতে পারেনি। 
  • ধননন্দের আমলেও নন্দবংশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বহমান ছিল। এই সমৃদ্ধ অর্থনীতির মূলমন্ত্র ছিল জমি থেকে প্রাপ্ত কর বা খাজনা।     
  • কিন্তু ধননন্দ ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী নন্দসম্রাট। রাজ্যের প্রজাদের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। নিষ্ঠূরভাবে অত্যধিক কর আদায়ের জন্যই মগধের জনগণ তাঁর প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়েছিল।
  • অত্যাচারী ধননন্দের প্রতি বিক্ষোভের জেরে মগধের সিংহাসনে সংকটের সৃষ্টি হয়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগান ব্রাহ্মণ চাণক্যের সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। 
  • অবশেষে ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বে মগধে নন্দবংশের ধ্বংসস্তুপের ওপর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। মগধের নতুন অধ্যায় শুরু হোলো।
উপসংহার

মগধের উত্থান ভারত ইতিহাসের এক তাৎপর্যময় ঘটনা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতে ছিল না কোনো কেন্দ্রীয় শক্তি।

ষোলোটি মহাজনপদের মধ্যে রাজতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে মগধকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয় সাম্রাজ্যবাদ।

বিম্বিসারের অঙ্গ জয়ের মাধ্যমে মগধের জয়যাত্রা আরম্ভ হয়ে তা নন্দ আমল পর্যন্ত চলেছিল।

পরে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই মগধকে কেন্দ্র করেই সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য গড়েছিলেন।

কিন্তু মগধের উত্থানের ইতিহাসে চোখ রাখলে বিম্বিসার, অজাতশত্রু, মহাপদ্মনন্দ প্রমুখ রাজাদের অবদান খুব মূল্যবান বলেই মনে হয়।

এছাড়া মগধের উর্বর কৃষিভূমি, খনি, নদী, পাহাড় প্রভৃতি প্রাকৃতিক অবদান  মগধের জন্য ছিল আশীর্বাদস্বরূপ।

সবদিক থেকেই মগধকে উন্নত করে তুলেছিল। এইসব কারণে মগধের উত্থান ইতিহাসের এক অন্যতম ঘটনা।

আরও পড়ুনহিউয়েন সাং কে ছিলেন

আশা করি ‘মগধের উত্থানের ইতিহাস’ পোস্টটি পড়ে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই তোমরা শেয়ার ও কমেন্ট করে তোমাদের মূল্যবান মতামত জানিও। তোমাদের মূল্যবান মতামত আমাকে ভীষণ অনুপ্রেরণা জোগায়। ভালো থেকো বন্ধুরা।      

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!