Napoleon Bonaparte নেপোলিয়নের পতনের কারণ

নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি কি ছিল | Napoleon Bonaparte

নেপোলিয়নের পতনের কারণ ( reasons napoleons fall ) নেপোলিয়নের কার্যকলাপের মধ্যেই নিহিত ছিল। নেপোলিয়ন যে অজেয় নন তা তাঁর পতনের মধ্যে দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে।

একথা সত্যি যে, তিনি নিজের অসামান্য প্রতিভাবলে এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু নেপোলিয়ন তা শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারেননি।

জীবনের প্রথমদিকে একজন সেনাপতি হিসেবে থাকলেও পরবর্তীকালে প্রতিভার জোরে নেপোলিয়ন নিজের উন্নতির পথ প্রশস্ত করেন।

এক্ষেত্রে প্রতিভার সঙ্গে অবশ্য সৌভাগ্যও জড়িত ছিল। ফরাসী বিপ্লবের হাওয়ায় নিজের বিজয় নৌকো এগিয়ে নিয়ে ফরাসী সিংহাসনে আরোহণ করেন নেপোলিয়ন।

ইউরোপের বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলি নেপোলিয়নের কাছে নিজেদের সমর্পণ করে। কিন্তু এই জয় বেশিদিন টেকসই হয়নি।

মাত্র এক দশকের মধ্যে নেপোলিয়নের সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে চতুর্থ শক্তিজোটের হানা আঘাতেই নেপোলিয়ন ধরাশায়ী হন।

ইতিহাস প্রসিদ্ধ লাইপজিগের যুদ্ধ এবং ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়ন চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়ে সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসনে চলে যান।

মাত্র এইটুকুতেই নেপোলিয়নের পতনের কারণ আটকে নেই। এই পতনের কারণ বিবিধ। সেই কারণগুলি নীচে বিশদে তুলে ধরা হল।

নেপোলিয়নের পতনের কারণ নেপোলিয়নের উত্থান Napoleon Bonaparte
Napoleon Bonaparte : নেপোলিয়নের পতনের কারণ

নেপোলিয়নের উত্থান ও উত্থানের কারণ ইতিহাসে বেশ চর্চিত। ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই অগাস্ট ভূমধ্যসাগরের করসিকা দ্বীপে এজাসিও নামক একটি স্থানে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জন্ম হয়।

ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সে দেখা দিয়েছিল বিশৃঙ্খলা। ফরাসী বাসীর সেইসময় প্রয়োজন ছিল একজন প্রতিভাবান নেতার। একারণেই উত্থান ঘটে নেপোলিয়নের।

পিতার নাম কার্লো বোনাপার্ট ও মাতার নাম লেটিজিয়া বোনাপার্ট। ছোটো থেকেই প্রবল দৃঢ়তা, উচ্চাকাঙ্খি, ইচ্ছাশক্তির অধিকারী ছিলেন নেপোলিয়ন।

এরপর সামরিক শক্তির জোরে ইউরোপ জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন। দর্শনীয় ভাবে উত্থান হলেও পতনও হয় চমকপ্রদ ভাবে।

নেপোলিয়নের পতনের কারণ স্পেনীয় ক্ষত, মহাদেশীয় অবরোধ প্রথা এবং রাশিয়া অভিযানের মতো মারাত্মক ভুলগুলি।

নেপোলিয়ন তাঁর শক্তিকে অজেয় বলে মনে করতেন। নেপোলিয়নের পতনের কারণগুলির মধ্যে তাঁর উচ্চাভিলাষ একটি অন্যতম কারণ।

একের পর এক ইউরোপীয় শক্তির আত্মসমর্পণ নেপোলিয়নের আত্মবিশ্বাসকে তুঙ্গে পৌঁছে দেয়। তাঁর মধ্যে জন্ম দেয় হার না মানার মনোভাব।

নিজের রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি হারিয়ে জেদী ও হঠকারী হয়ে ওঠেন। কূটনৈতিক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র অহমিকার বশে ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হন।

তাই এই উচ্চাভিলাষের ফলে নিজেই নিজের পতন ডেকে আনেন নেপোলিয়ন।

ফরাসী বিপ্লবের মূল কথা ছিল সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা।

কিন্তু নেপোলিয়নের সামরিক একনায়কতন্ত্রের প্রভাবে ফরাসী বিপ্লবের এই ধারণা তলিয়ে যায়। আসলে নেপোলিয়ন বংশগত ভাবে ফ্রান্সের রাজা ছিলেন না।

তিনি ছিলেন একজন ফরাসী সেনাপতি। অস্ত্রের ক্ষমতায় তিনি ফ্রান্সসহ ইউরোপে নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন।

অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে সামরিক সাফল্য ব্যতীত তাঁর সাম্রাজ্যের ভিত্তি ছিল দুর্বল।

একসময়ে জনগণ নেপোলিয়নের একনায়ক শাসনের বিরোধিতায় মুখর হয়ে ওঠে এবং নিজেদের ঘৃণা উগড়ে দেয়।

নেপোলিয়ন তাঁর ভাই জোসেফকে বলেছিলেন, “আমি যতদিন শক্তিশালী থাকব ততদিন আমার সাম্রাজ্য টিকে থাকবে”।

সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন হয় অভিজ্ঞ ও যুদ্ধপটু সেনাদলের। নেপোলিয়ন ইউরোপ জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে বিশাল সৈন্যদল ব্যবহার করেছিলেন।

কিন্তু বোধহয় সেনাদলের সাংগঠনিক দুর্বলতার দিকে নজর দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। নিরন্তর যুদ্ধ চলার জন্য নেপোলিয়নের বহু সৈন্য নিহত হয়ে সেনাদলের সংখ্যা কমতে থাকে।

সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে যখন সেনার দরকার হয় তখন নেপোলিয়ন তাঁর অধিনস্ত ইতালি, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশ থেকে সেনা সংগ্রহ করতে থাকেন।

কিন্তু সেখানে অনভিজ্ঞ সৈন্যের সংখ্যাই বৃদ্ধি পেয়েছিল। এতে সৈন্যের অভাব পূরণ হলেও সেনাদলে ঐক্য নষ্ট হয়।

সৈন্যরাও ক্রমে নেপোলিয়নের প্রতি আনুগত্য হারায়। এরপর নেপোলিয়নের যুদ্ধে হার আরম্ভ হলে সেনাবাহিনী মনোবল হারিয়ে ফেলে। এরফলে নেপোলিয়নের পতনের পথ সুগম হয়।

নেপোলিয়নের পতনের জন্য তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্নিহিত স্ববিরোধকেই দায়ী করা হয়। নেপোলিয়ন ইউরোপ জয়কালীন স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের আদর্শ প্রচার করেন।

সেইসাথে ইউরোপীয় রাজাদের স্বৈরশাসন এবং তাঁদের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হন।

কিন্তু দেখা গেল নেপোলিয়ন নিজেই অন্য জাতির ওপর স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চাপিয়ে দিলেন। মুখে স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের আদর্শের কথা বললেও আদতে তিনি তা পালন করেননি।

ইউরোপের দেশগুলির বুঝতে বাকি রইল না যে, নেপোলিয়ন স্বৈরাচারী মুখোশ পড়ে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ চালিয়েছেন। নেপোলিয়ন জয় করা স্থানগুলি থেকে যুদ্ধ কর, সম্পদ লুঠ করার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুথান দেখা দেয়।

স্পেনীয় ক্ষত ( Spanish ulcer ) নেপোলিয়নের পতনের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। শরীরের কোনো স্থানে ক্ষত থাকলে যেমন তা শরীরের ক্ষতিসাধন করে।

ঠিক তেমনি স্পেন আক্রমণ নেপোলিয়নের জন্য ক্ষতের সমান ছিল। এরফলে নেপোলিয়নের সবদিক থেকেই ক্ষতি হয়।

কিন্তু স্পেনের মতো একটি ক্ষুদ্র দেশকে হারাতে না পেরে নেপোলিয়নের সামরিক মর্যাদা নষ্ট হয়েছিল। নেপোলিয়নের কয়েক হাজার সেনা স্পেনে বন্দী হয়।

তারওপর স্পেনের এই জাতীয়তাবাদী যুদ্ধে ব্রিটেনের মুক্তহস্তে সাহায্য আগুনে ঘি ঢালে।

ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অফ ওয়েলিংটন স্পেনবাসীদের নিয়ে গেরিলা যুদ্ধে ফরাসী বাহিনীকে একেবারে পর্যুদস্ত করে।

স্পেনের যুদ্ধ শেষ না করে নেপোলিয়ন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে গিয়ে আরেকটি ভুল করে বসেন। তাই স্পেনে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ গ্রহণ করে নেপোলিয়ন বলেছিলেন, “স্পেনের ক্ষতই আমাকে ধ্বংস করে”।

১৮০৬ সালে নেপোলিয়নের বার্লিন ডিক্রি দ্বারা মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা ঘোষণা ( Continental system ) করা হয়। এই ব্যবস্থায় ইংল্যান্ডের জাহাজ ও পণ্য বাজেয়াপ্ত করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

ইউরোপে ইংল্যান্ডই ছিল নেপোলিয়নের অপরাজিত শত্রু।

সামরিক শক্তিতে না পেরে ইংল্যান্ডকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করার মতলবেই নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা চালু করেন।

কিন্তু ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক শক্তিকে নষ্ট করতে গিয়ে এই ব্যবস্থা নেপোলিয়নের দিকেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে।

স্পেন, রাশিয়া মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অরাজি হলে নেপোলিয়ন তাঁদের সাথে যুদ্ধে জড়ান। নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে সর্বত্র গণবিদ্রোহ ঘটে।

উলটোদিকে ইংল্যান্ড নিজের উন্নত নৌশক্তি দ্বারা মহাদেশীয় অবরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলে। ফ্রান্সে মালের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে ইংল্যান্ড কার্যত ফ্রান্সকেই অবরুদ্ধ করে দেয়।

নেপোলিয়ন রাশিয়াকেও নিজের সাম্রাজ্য ব্যবস্থার অধীনে আনতে চান। আর এইকারনেই নেপোলিয়ন রাশিয়া আক্রমণ করেন।

নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা।

কিন্তু ঐতিহাসিকদের কাছে নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান ছিল প্রকাণ্ড ভুল পদক্ষেপ। ইংল্যান্ডকে তখনও পর্যন্ত নেপোলিয়ন জিততে পারেননি।

কিন্তু তিনি রাশিয়ার মতো একটি বৃহৎ জনবহুল দেশ আক্রমণ করে বসেন। বরং রাশিয়ার সাথে মিত্রতা করাই তাঁর উচিৎ ছিল।

একদিকে তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, তারওপর সাম্রাজ্যের দুর্বল ভিত্তি এইসকল দিক অগ্রাহ্য করে মস্কো অভিযান করেন।

রাশিয়ার জারের সেনাপতি কুটুজফের অভিজ্ঞ রণনীতিই নেপোলিয়নকে নাস্তানাবুদ করে দেয়। নেপোলিয়ন রাশিয়ার গভীরে প্রবেশ করলে কুটুজফের আঘাতে বিভ্রান্ত হয়ে যান।

নেপোলিয়নের প্রায় ৬ লক্ষ সেনার গ্র্যান্ড আর্মি সেনাপতি কুটুজফ ও রুশ সেনার হানায় কার্যত দিশেহারা হয়ে পড়ে।

এছাড়া রাশিয়ার প্রচণ্ড শীতের দাপট, রোগের মহামারী, খাদ্যাভাবের কারণে ফরাসী সেনাদের মৃত্যু ঘটে।

রাশিয়ার নেপোলিয়নের বিরাট পরাজয়ের ফলে নেপোলিয়নের অপরাজেয় তকমা ঘুচে যায়। তাই রাশিয়া তথা মস্কো অভিযান ছিল নেপোলিয়নের পতনের অন্যতম কারণ।

নেপোলিয়নের মস্কো অভিযান বিফল হলে ইউরোপীয় শক্তিগুলি উদ্যম ফিরে পায়। রাশিয়া, প্রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জার্মানি চতুর্থ শক্তিজোট বা কোয়ালিশন গঠন করে।

এরা নেপোলিয়নের পতন ঘটাতে প্রতিজ্ঞা নেয়। এই চতুর্থ শক্তিজোট নেপোলিয়নকে চতুর্দিক দিক থেকে ঘিরে আক্রমণ চালায়।

জার্মানির লাইপজিগের যুদ্ধে শক্তিজোট নেপোলিয়নকে বিধ্বস্ত করে দেওয়ায় তিনি সেখান থেকে সেনাসহ পিছু হঠেন। এদিকে জার্মানিও নেপোলিয়নের শাসনের থেকে মুক্তি পায়।

ধীরে ধীরে শক্তিজোট ফ্রান্সের ভিতরে দখল নেওয়া শুরু করলে নেপোলিয়ন অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

এরপর নেপোলিয়ন একটি সন্ধি স্বাক্ষর করে এলবা দ্বীপে নির্বাসনে চলে যান। কিন্তু নেপোলিয়নের মনে তখনও ফ্রান্সের সিংহাসন লাভের আকাঙ্খা থেকে যায়।

ইতিমধ্যেই নেপোলিয়নের অনুপস্থিতে শক্তিজোট ফ্রান্সের সিংহাসনে অষ্টাদশ লুইকে বসায়।

এলবা দ্বীপ থেকে পুনরায় নেপোলিয়ন ফ্রান্সে সেনাসহ প্রবেশ করতে চাইলে ইংরেজ সেনাপতি ডিউক অফ ওয়েলিংটনের ইংরেজ ফৌজের মুখোমুখি হন।

স্থানটি ছিল বেলজিয়ামের ওয়াটারলু নামক একটি গ্রাম। আর এই ওয়াটারলুর যুদ্ধই নেপোলিয়নের জীবনের শেষ যুদ্ধ হয়।

১৮১৫ খ্রিঃ ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। ওয়াটারলুর যুদ্ধ ছিল নেপোলিয়নের পতনের প্রত্যক্ষ কারণ।

ওয়াটারলুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নেপোলিয়ন হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সেনা নেপোলিয়নের পালাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে।

একপ্রকার বাধ্য হয়ে ব্রিটিশ সেনার কাছে নেপোলিয়নকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। ব্রিটিশ সরকার নেপোলিয়নকে ভূমধ্যসাগরের সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসন দেয়।

সেন্ট হেলেনা দ্বীপে একটানা জীবন অতিবাহিত করার সময় অন্ত্রের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে নেপোলিয়ন মারা যান।

মৃত্যুকাল ছিল ১৮২১ খ্রিঃ ৫ই মে। এই সেন্ট হেলেনা দ্বীপেই নেপোলিয়ন নিজের আত্মজীবনী লিখেছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!