kadambini ganguly কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ও ডাক্তার

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ( গ্র্যাজুয়েট ) ও ডাক্তার ( Dr. Kadambini Ganguly ) হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসে। 

এক মহিয়সী নারী রূপে স্বমহিমায় উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বিরাজ করছেন কাদম্বিনী দেবী। আজ আমরা তাঁকে কতটা মনে রেখেছি তা হয়তো জোর দিয়ে বলা যাবে না।

তবে কোনো মানদণ্ডতেই কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে মাপা যায় না। সত্যিই এক আশ্চর্য নারী। নারী হয়েও কাদম্বিনীকে ‘নায়ক নারী’ আখ্যা দেওয়া যায়।

আঠেরোশো শতাব্দীর শেষ ভাগ যেসময়ে নারীরা ছিল চূড়ান্ত অবহেলিত।

শিক্ষালাভ করা থেকেও বঞ্চিত। ঠিক এইসময়ে সমাজের এইসমস্ত বেড়াজাল অতিক্রম করে প্রতিকূলতাকে জয় করলেন কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়।

অদম্য জেদ, সাহস আর নিজের ওপর আত্মবিশ্বাসের মন্ত্রবলে অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনি। ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে মেলে ধরেছিলেন কাদম্বিনী।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ভারতের প্রথম গ্র্যাজুয়েট ও ডাক্তার dr. kadambini ganguly
ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায় ১৮৬১ সালের ১৮ই জুলাই বিহারের ভাগলপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ভাগলপুরে জন্মালেও কাদম্বিনীর পরিবারের পৈতৃক বাসস্থান ছিল বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদশীতে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতে ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলনে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা ছিল প্রবল। এমনই একজন ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসু ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর বাবা। পেশায় ব্রজকিশোর বসু ছিলেন ভাগলপুর স্কুলের হেডমাস্টার। নারী অধিকার আদায়ে নিবেদিত প্রাণ ব্রজকিশোর বসু ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা সমিতি।

পিতা ব্রজকিশোর কাদম্বিনীকে শিক্ষাদানের জন্য নিয়ে এলেন কলকাতায়। কিন্তু সে যুগে নারীশিক্ষা অত সহজ ছিল না। এ পথে প্রধান বাধা ছিল তৎকালীন সমাজ।

কিন্তু কাদম্বিনী দমে যাওয়ার পাত্রী ছিলেন না। সমাজের বাধাকে তোয়াক্কা না করে ভর্তি হলেন কলকাতার বালিগঞ্জের হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে। সময়টা ছিল ১৮৭৩ সাল।

পরে অবশ্য এই স্কুলটির নাম হয়েছিল ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়‘। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন স্ত্রীশিক্ষায় অনুরাগী, ব্রাহ্ম সমাজনেতা ‘দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী‘।

পরবর্তীকালে এই স্কুলটি তৎকালীন বেথুন স্কুলের সাথে জুড়ে যায়। ১৮৭৭ সালে একটি ছাত্রবৃত্তির পরীক্ষায় কাদম্বিনী প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।

দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন আর এক ব্রাহ্মনেতা দুর্গামোহন দাসের কন্যা সরলা দাস। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ( University of Calcutta ) এন্ট্রাস পরীক্ষায় বসার ক্ষেত্রে।

সেইসময় নিয়ম ছিল যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় মেয়েরা বসতে পারবে না। কিন্তু শেষমেশ দ্বারকানাথের তৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পরীক্ষায় বসার অনুমতি দিয়েই দিলেন।

১৮৭৮ সালের সেই এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কাদম্বিনী বসু দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ওই এন্ট্রান্স পরীক্ষায় কাদম্বিনীর সঙ্গে একইসাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী বসু।

ইতিমধ্যেই বেথুন স্কুল ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষাঙ্গনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সেখানে চালু হল এফ.এ বা ফার্স্ট আর্টস।

১৮৮০ সালে বেথুন থেকেই কাদম্বিনী ও তাঁর সহপাঠী চন্দ্রমুখী বসু এফ.এ পাস করেন।

ঠিক তিন বছর পর অর্থাৎ ১৮৮৩ সালে কাদম্বিনী বসু এবং চন্দ্রমুখী বসু কৃতিত্বের সাথে বি.এ ( B.A ) পাস করলেন। ইতিহাস গড়লেন এই দুজন তনয়া।

কাদম্বিনী বসু ও চন্দ্রমুখী বসু ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক বা গ্র্যাজুয়েট হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করলেন। সেইসাথে এঁদের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হল।

বহু বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক হয়েছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। সমাজে নারীদের প্রতি রক্ষণশীলতা কাদম্বিনীকে আটকে রাখতে পারেনি।

কিন্তু গ্র্যাজুয়েট হয়ে থেমে গেলেই তো চলবে না ! অতএব কাদম্বিনী ঠিক করলেন ডাক্তারি পড়বেন। তবে ডাক্তার হওয়া তো মুখের কথা নয়।

তাও আবার মহিলা ডাক্তার। কস্মিনকালেও কোনো নারী একথা ভাবার সাহস পায়নি। বাংলায় তখন ব্রিটিশ শাসন কায়েম হয়েছে।

বাড়ির অন্দরমহলে মেয়েরা অসুস্থ হলে সাহেব ডাক্তারের প্রবেশ ছিল নৈব চ। এইভাবে জাত-পাতের যাঁতাকলে পড়ে বহু মেয়েরাই শেষে প্রাণটাই খোয়াতেন।

কাদম্বিনীর মনে এই ঘটনা গভীরভাবে দাগ কেটে যায়। মনে মনে শপথ নেয় মেয়ে হয়ে মেয়েদের চিকিৎসার কাজে ব্রতী হবে।

প্রতিজ্ঞা করে, যেমন করেই হোক ডাক্তার সে হবেই। পিতা ব্রজকিশোর বসু মেয়ের ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করলেন।

কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির আবেদন করলে কাদম্বিনীর সেই আবেদন নাকচ করা হয়।

কারণ সেইসময় নারীদের মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষালাভের কোনো অনুমতি ছিল না।

এর কারণ ডাক্তারি পড়ার ক্লাসে অধ্যাপকরা মানব দেহের যে বর্ণনা দিতেন তাতে নারীদের সম্ভ্রমহানি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তারওপর সামাজিক বিধিনিষেধ তো ছিলই।

কিন্তু কাদম্বিনীর যোগ্যতা, দৃঢ়তা, পরিশ্রম বিধিনিষেধের গন্ডিকে অতিক্রম করে যায়। আবারও এগিয়ে এলেন দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী।

কাদম্বিনীর হয়ে সংগ্রাম শুরু করলেন। সরকারের কাছে জানতে চাইলেন যোগ্যতা থাকা সত্বেও মহিলারা কেন ডাক্তারি পড়তে পারবেনা ?

শেষপর্যন্ত মেডিক্যাল কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বাতিল করে ১৮৮৩ সালের ২৯শে জুন কাদম্বিনী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ছাড়পত্র পেলেন।

চিকিৎসা ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। সমস্ত নিয়মের বেড়াজাল ভেঙ্গে কাদম্বিনী মেডিক্যাল কলেজের প্রথম ছাত্রী হিসেবে পড়াশোনা শুরু করলেন।

১৮৮৩ সালে যখন কাদম্বিনী সবেমাত্র ডাক্তারি পড়া শুরু করবেন ঠিক সেইসময়ই দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর সাথে বিবাহ হয়। দ্বারকানাথ বিপত্নীক ছিলেন।

প্রথম স্ত্রী ভবসুন্দরী দেবী মারা যাওয়ার পর কাদম্বিনীকে দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা দেন দ্বারকানাথ। জানা যায় ব্রজকিশোর বসু এই বিয়েতে প্রথমে অমত হলেও পরে মত দিয়েছিলেন।

কারণ দুজনেরই বয়সের বিস্তর ফারাক ছিল। দ্বারকানাথের বয়স তখন উনচল্লিশ, আর কাদম্বিনীর মাত্র একুশ।

দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ঢাকার বিক্রমপুরের মাগুরখন্ডে জন্মেছিলেন। বাবার নাম ছিল কৃষ্ণপ্রাণ গাঙ্গুলী। পরবর্তীকালে দ্বারকানাথ কাদম্বিনীর স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।

বিপত্নীক, দুই সন্তানের পিতা, স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে আগ্রহী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী ছিলেন কাদম্বিনীর সফলতার অন্যতম কারিগর।

যদিও এই বিবাহ সেসময়কার সমাজ মেনে নেয়নি। সৎ মা হয়েও কাদম্বিনী দ্বারকানাথের দুই সন্তানের প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব নিতে পিছপা হননি।

কাদম্বিনী বসু থেকে পরিচয় বদলে হয়ে উঠলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী

চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার সংগ্রাম জয় করলেও কাদম্বিনীর জন্য অপেক্ষা করছিল মেডিকেল কলেজের ছাত্র, অধ্যাপকদের তিক্ত মন্তব্য ও বিরোধিতা।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলির ডাক্তারি পড়ার সিদ্ধান্তকে মনেপ্রাণে মেনে নেননি মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক অধ্যাপকরা।

এই অধ্যাপকদের মধ্যে রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র কাদম্বিনীর বিরোধিতা বেশি করেছিলেন। ডাক্তারি পড়ার তিন বছরের মাথায় কাদম্বিনী মাত্র এক নম্বরের জন্য পরীক্ষায় ফেল করেন।

কিন্তু তাঁকে ইচ্ছা করে নাকি ফেল করানো হয়েছিল। আর এর পিছনে প্রধান অবদান ছিল রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র-র।

কারণ এম বি বা ব্যাচেলর অফ মেডিসিন-র ফাইনাল পরীক্ষায় পরীক্ষক ছিলেন ডঃ রাজেন্দ্রচন্দ্র চন্দ্র। কাদম্বিনীর ওপর এমন অবিচার দেখে এগিয়ে এলেন অধ্যক্ষ ডঃ কোটস্।

তিনি তাঁর বিশেষ অধিকারবলে কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অফ বেঙ্গল’ ডিগ্রী প্রদান করলেন। ১৮৮৬ সালে কাদম্বিনী গাঙ্গুলি ডাক্তারি পাস করলেন।

এখন তিনি ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলি। বহু লড়াই লড়ে তিনি নিজেকে এই স্তরে উন্নীত করেছিলেন।

ডাক্তারি ডিগ্রী লাভের সাথে ওয়েস্টার্ন মেডিসিন নিয়ে প্র্যাকটিস করার যোগ্যতাও লাভ করলেন।

ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট কাদম্বিনী গাঙ্গুলী স্বীকৃতি পেলেন ইউরোপিও চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক রুপে।

এরপর কলকাতার লেডী ডাফরিন হাসপাতালে মাসিক তিনশো টাকা বেতনে মহিলা রোগী বিভাগে প্রধান ডাক্তার হিসেবে কাজে যোগ দেন।

এতকিছুর পরেও কাদম্বিনীর প্রতি সমাজের বিদ্রুপ এতটুকু কম হয়নি। জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁকে সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। কিন্তু এতকিছু সত্বেও কাদম্বিনী হার মানেননি।

আসলে ‘হার’ শব্দটাই যেন কাদম্বিনীর অভিধানে নেই। জীবনের প্রতিটি সংকটের মুহূর্তে পাশে পেয়েছিলেন স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে নিজের দক্ষতাকে তীক্ষ্ণ করে তুলতে কাদম্বিনী পাশ্চাত্য ডিগ্রী লাভে সচেষ্ট হলেন।

দ্বারকানাথের উৎসাহ ও তৎপরতায় ১৮৯৩ সালে কাদম্বিনী একা লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। বিলেতে গিয়েও ভারতীয় নারীর পোশাকের সংজ্ঞা তিনি ভোলেননি।

পরনে শাড়ি, ফুলহাতা ব্লাউজ পরিধান করে ক্লাস করেছেন তিনি।

এরপর এডিনবরা থেকে LRCP, গ্লাসগো থেকে LRCS এবং ডাবলিন থেকে LFPS এমন তিন তিনটে ডিগ্রী অর্জন করেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।

ভারতে ফিরে এসে ডাফরিন হাসপাতালের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পুরোপুরি প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন তিনি। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অল্পসময়ের মধ্যে মহিলা চিকিৎসক হিসেবে কাদম্বিনীর খ্যাতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সেইসময় দেশীয় মহিলা ডাক্তারের সত্যিই বড় প্রয়োজন ছিল, আর সেই অভাব পূরণ করলেন কাদম্বিনী।

কোনো নারীর অসুস্থতার খবর পাওয়া মাত্রই সেখানে ছুটে গিয়ে নিপুণ হাতের দক্ষতায় তাঁদের রোগের উপশম ঘটিয়েছেন। গর্ভবতী মহিলাদের প্রসবে তাঁর অসামান্য হাতযশ ছিল।

একটি ঘটনার কথা বলা যাক। সেইসময় কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে এক ধনী বাবু তাঁর পুত্রবধুর পেটের ব্যাথার অসুস্থতায় এক সাহেব ডাক্তারের শরণাপন্ন হন।

পুত্রবধুর নাম ছিল হরিপ্রিয়া। সাহেব ডাক্তার হরিপ্রিয়াকে পরীক্ষা করার পর তাঁর পেটে মারণ টিউমার আছে এমন কথা জানান।

পরিবারসুদ্ধ লোক এমন কথায় ভয় পেয়ে শেষমেশ ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলিকে দিয়ে একবার পরীক্ষা করান। ফলও মেলে হাতেনাতে।

কাদম্বিনী ভালভাবে পরীক্ষা করে জানান টিউমার নয় বরং হরিপ্রিয়া সন্তানসম্ভবা। পরবর্তী সময়ে নির্বিঘ্নে নিজের হাতে তিনি হরিপ্রিয়ার সন্তান প্রসব করিয়েছিলেন।

‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’- বাংলা প্রবাদ বাক্যটিকে অক্ষরে অক্ষরে সত্যি করেছিলেন কাদম্বিনী। মেয়ে হয়ে সে কিনা শিখবে লেখাপড়া ! তাও হবে আবার ডাক্তার !

এমন কতই না সামাজিক ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছিল কাদম্বিনীকে।

থেমে যাননি বরং ব্যাঙ্গ বিদ্রুপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তৎকালীন বাঙালি মহিলা চিকিৎসক রুপে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

চিকিৎসাক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন কাদম্বিনী। কত অসুস্থ রোগিণীকে সুস্থ করেছেন। নিপুণ হাতে সন্তান প্রসবিনী নারীর সন্তান প্রসবে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন তিনি।

আবার ১৮৯৫ সালে কলকাতা থেকে সুদূর নেপালে ছুটে গিয়েছিলেন অসুস্থ নেপাল রাজমাতাকে চিকিৎসা করতে। এতটুকু কুণ্ঠাবোধ ছিল না তাঁর।

নেপালের রাজমাতাকে সুস্থ করতে নেপালরাজ ভারত থেকে কাদম্বিনীকে ডেকে আনলেন। কয়েকদিনের চিকিৎসাতেই রাজমাতা সুস্থ হলেন।

জানা যায় নেপাল রাজমাতা পুরস্কার স্বরূপ কাদম্বিনীকে মূল্যবান গয়না, রুপোর বাসনপত্র, হাতির দাঁতের তৈরি দ্রব্য উপহার দেন।

এমনও জানা যায় এই দীর্ঘ যাত্রাপথে কাদম্বিনী দক্ষতার সাথে লেস বুনেছেন। কাপড়ের ওপর ফুটিয়ে তুলেছেন অপূর্ব সব নকশা। বলতে গেলে সত্যিই সর্বগুণ সম্পন্না ছিলেন ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।

দ্বারকানাথের প্রথম স্ত্রী ভবসুন্দরি দেবীর দুই সন্তান এবং দ্বারকানাথ-কাদম্বিনীর মোট আট সন্তানসহ পরিবার ছিল।

কাদম্বিনীর সন্তানদের মধ্যে জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী ও প্রভাতচন্দ্র গাঙ্গুলীর নাম বিশেষভাবে জানা যায়। জ্যোতির্ময়ী ছিলেন একজন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী।

প্রভাতচন্দ্র যিনি জংলু গাঙ্গুলী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, তাঁর পুত্র ধিরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী ছিলেন প্রখ্যাত চিকিৎসক।

এছাড়াও কাদম্বিনীর সৎ মেয়ে বিধুমুখীর সাথে বিখ্যাত সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়ের বিবাহ হয়েছিল। উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা।

পরবর্তী সময়ে তাঁর পুত্র ‘আবোল তাবোলের‘ স্রস্টা সুকুমার রায় পত্রিকাটিকে এগিয়ে নিয়ে যান। সুতরাং কাদম্বিনী সম্পর্কে সুকুমার রায়ের দিদিমা ছিলেন।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর এই বিশাল কর্মকাণ্ড শুধু চিকিৎসাক্ষেত্রে আটকে থাকেনি। সমাজসংস্কার ও রাজনীতির অঙ্গনেও এসে পৌঁছয়।

দ্বারকানাথ গাঙ্গুলী একজন রাজনীতিজ্ঞ মানুষ ছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। কংগ্রেসে নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে দ্বারকানাথ দাবী তোলেন।

এই দাবীর সৌজন্যে ১৮৮৯ সালে কাদম্বিনীর সুযোগ হয় বম্বেতে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে যোগ দেওয়ার।

এখানে কাদম্বিনীর সঙ্গী হয়েছিলেন সরলা দেবী চৌধুরানী।

ইনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে।

এই অধিবেশনে কাদম্বিনী সাজিয়ে গুছিয়ে সাবলীলভাবে বাংলায় বক্তব্য রাখার জন্য প্রশংসিত হন।

কলকাতায় অনুষ্ঠিত হওয়া কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনেও কাদম্বিনী বক্তব্য রেখেছিলেন। তদানীন্তন আসামে ইংরেজ চা-বাগান মালিকেরা চা শ্রমিকদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করত।

কাদম্বিনী নিজে সেখানে গিয়ে এই ঘটনা চাক্ষুষ করেন। চা শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আন্দোলনের পাশে দাঁড়ান কাদম্বিনী।

এর পাশাপাশি বিহার ও ওড়িশার খনিতে কাজ করা নারীশ্রমিকদের দুর্দশার দিনেও কাদম্বিনী তাঁদের পাশে থেকেছেন।

এই সমস্ত নারীশ্রমিকদের অবস্থা খতিয়ে দেখতে সরকার একটি কমিটি গড়েছিল। কাদম্বিনী সেই কমিটির সদস্য ছিলেন।

১৮৯৮ সালে কাদম্বিনীর স্বামী দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীর মৃত্যু হয়। কাদম্বিনীর স্কুলের শিক্ষক থাকাকালীন তাঁর সাথে পরিচয় শুরু।

এরপর কাদম্বিনীর জীবনের প্রতিটি যুদ্ধ দক্ষ সেনাপতি হিসেবে দ্বারকানাথ সামলেছেন। দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর কাদম্বিনী নিজের কর্মযজ্ঞে ছেদ পরতে দেননি।

নিজের ছেলেমেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করে তোলেন। স্বামীর মৃত্যুর দিনেও একজন চিকিৎসক হিসেবে প্রসব করাতে ছুটে গিয়েছেন।

নিজের কর্তব্যে অবিচল থেকেছেন তিনি। অবশেষে একটা সময় শরীর আর সাথ দেয়নি।

১৯২৩ সালের ৩রা অক্টোবর ৬২ বছর বয়সে কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর মৃত্যু ঘটে। জীবনের একটা দীর্ঘ ইনিংসের পরিসমাপ্তি হয়।

একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী জ্ঞানের মশাল জ্বালিয়ে নতুন পথচলার শুভসূচনা করেছিলেন।

সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়ি ভেঙ্গে সফলতার শিখরে আরোহণ করেছেন। একজন মহীয়সী নারী হিসেবে ডঃ কাদম্বিনী গাঙ্গুলী সমগ্র ভারতীয়দের কাছে অনুপ্রেরণার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রইলেন।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী কি জন্য বিখ্যাত ছিলেন ?

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক এবং ইউরোপিয়ো চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা চিকিৎসক।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক কে?

১৮৮২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা স্নাতক হন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং চন্দ্রমুখী বসু। কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং চন্দ্রমুখী বসু এই দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পাস করে ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট হন।

ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার কে?

ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার হলেন আনন্দিবাই গোপালরাও জোশী। সেইসাথে কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর নামও ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তারের তালিকাতে রাখা হয়।

কাদম্বিনী বসুর বাবার নাম কি?

ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসু ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর বাবা।

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী স্মরণীয় কেন?

কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ( গ্র্যাজুয়েট ) ও ডাক্তার ( Dr. Kadambini Ganguly ) হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছেন ইতিহাসে। 

2 thoughts on “কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ও ডাক্তার”

  1. Pingback: চিতোরের রাজপুত রানী পদ্মিনী সম্পর্কে জানুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!