ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা | Philosophers role in French Revolution in bengali

ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা (Philosophers role in French Revolution)

কেমন আছো বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভালো আছো। 

ইতিমধ্যেই ফরাসী বিপ্লবের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ নিয়ে এই ওয়েবসাইটে পোস্ট করেছি। 

এবারে আলোচনার বিষয়বস্তু ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা। আশা রাখি তুমি এই পোস্টটি নিশ্চই পড়বে। চাইলে তুমি অন্য পোস্টগুলিও আমার এই ওয়েবসাইটে পড়তে পারো। 

তাহলে মূল আলোচনায় আসা যাক। 

বুরবোঁ রাজতন্ত্রের রাজারা ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল জনগণের প্রতি কর্তব্যের কথা। চাপিয়ে দিয়েছিল তাঁদের ওপর করের বোঝা। মানুষ বাধ্য হয়ে বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিল। 

সাধারণ মানুষদের হয়ে কথা বলেছিলেন ফ্রান্সের কিছু দার্শনিকগণ। তাঁরা ছিলেন যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী। দার্শনিকেরা বিশ্বাস করতেন রাষ্ট্রের তথা সমাজের ভালো তখনই সম্ভব যখন সেখানে সংস্কার ও পরিবর্তন আসবে। ফ্রান্সের জন্য সেইসময় এটি খুব প্রয়োজন ছিল। 

ফরাসী দার্শনিক ও তাঁদের অবদান সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল ——

মন্তেস্কুর (Montesquieu) অবদান : 

ফরাসী দার্শনিকদের মধ্যে মন্তেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য নাম । তিনি ছিলেন একজন যুক্তিবাদী, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক মানুষ।

মন্তেস্কুর কাছে ফ্রান্সের রাজতন্ত্র ও অভিজাত শ্রেণী ছিল গুরুত্বহীন। তিনি ব্রিটিশ সংবিধানকে পছন্দ করতেন। তার কারণ সেখানে রাজা ছিল সংবিধানের অধীন। মন্তেস্কুর দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘পার্সিয়ান লেটার্স’ (Persian Letters) ও ‘স্পিরিট অফ লজ’ (Spirit of Laws) |

এই দুটি গ্রন্থেই মন্তেস্কু ফ্রান্সের সমাজের অন্যায় ও সমগ্র রাষ্ট্রের সৈরাচারী শাসনের দিকগুলি তুলে ধরেছেন। রাজার ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতার দাবীকে তিনি ভর্ৎসনা করেছেন।

স্পিরিট অফ লজ গ্রন্থটির ২২ টি খন্ড ১৮ মাসের মধ্যে বিক্রি হয়েছিল। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে , বইটির জনপ্রিয়তা সেইসময় শিখরে পৌঁছেছিল। 

আরও পড়ুন : ফরাসী বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ

ভলতেয়ারের (Voltaire) অবদান :

মন্তেস্কুর পর ফ্রান্সের অপর বিখ্যাত দার্শনিক ছিলেন ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮)। তাঁর আসল নাম ছিল মারি ফ্রাঁসোয়া আরুয়েৎ। ভলতেয়ার বিখ্যাত ছিলেন ব্যঙ্গ রচনার জন্য।

ভলতেয়ারের ব্যঙ্গধর্মী লেখাগুলি ফ্রান্সের পাঠক সমাজে জনপ্রিয় ছিল। তাঁর লেখার কেন্দ্রে ছিল ফ্রান্সের ক্যাথলিক গীর্জার দুর্নীতিগুলি।

মন্তেস্কুর মতো ভলতেয়ারও ব্রিটিশ সমাজের প্রশংসা করতেন। কারণ সেখানে অভিজাতরা কোনো অধিকার ভোগ করত না। তাঁর মতে , ‘গীর্জা হল কুসংস্কার ও দুর্নীতির ঘাঁটি’।

ভলতেয়ারের অনুসরণকারী লেখকদের ভলতেরিয়ান বলা হত।

ভলতেয়ারের লেখা গ্রন্থ গুলির মধ্যে ‘কাঁদিদ’ ও ‘ফিলসফিক্যাল ডিক্শনারি’ ইতিহাসে বিখ্যাত।

রুশোর (Rousseau) অবদান : 

দার্শনিক রুশোর পুরো নাম ছিল জাঁ জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮)। একজন মৌলিক ও বিপ্লব মতবাদের প্রবক্তা ছিলেন রুশো। তিনি বলেন যে , দেশের জনগণই রাষ্ট্রের উৎস।

তাঁর মতে, প্রতিটি মানুষই স্বাধীন এবং সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। তিনি তাঁর গ্রন্থ ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ (Social Contract)-এ রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা ব্যাখ্যা করেছেন।

অপর গ্রন্থ ‘অসাম্যের কারণ আলোচনা’ (Discourse on the Origin of Inequality) -তে মানুষের সমান অধিকারের ওপর দৃষ্টিপাত করেছেন।

এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন যে, ‘সমাজে অসাম্যই স্বাধীনতার বিনাশ ডেকে নিয়ে আসে’। এছাড়াও তাঁর রচিত আরও দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ হল ‘হেলোইজ’ ও ‘এমিল’।  এই গ্রন্থগুলি ফ্রান্সের সাধারণ মানুষকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। 

দিদেরো-এলেমবার্ট (Didero-Alembert) -র  অবদান :   

ডেনিস দিদেরো ছিলেন ফ্রান্সের একজন বিখ্যাত মনীষী। তিনি ছিলেন দার্শনিক, লেখক, সমালোচক। ‘বিশ্বকোষ’ (Encyclopedia) গ্রন্থটি রচনা করেন দিদেরো।

এক্ষেত্রে তিনি সাহায্য পেয়েছিলেন এলেমবার্ট, দালেমবেয়ার প্রমুখ দার্শনিকদের কাছ থেকে।

জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ উপাদান এই বিশ্বকোষ গ্রন্থটি। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বকোষের প্রায় ৪ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। এই গ্রন্থটির মাধ্যমে দিদেরোর সহজ সরল মতবাদ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছিল। 

ফিজিওক্রাট (Physiocrat) -দের অবদান :

ফিজিওক্রাট ছিল ফ্রান্সের একটি অর্থনৈতিক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁদের মতবাদ প্রচার করত। ফরাসী অর্থনীতিবিদ কুয়েসনে এই গোষ্ঠীর মুখপাত্র ছিলেন।

এঁরা মূলত শুল্ক প্রথা ও বাণিজ্যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের বিরোধী ছিলেন।

এঁরা মুক্ত বাণিজ্য ও খাদ্যের খোলা বাজারে বিক্রির পক্ষে দাবী জানিয়েছিলেন। এঁদের মতে শিল্প-বাণিজ্যের বদলে কৃষিই জাতির সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। 

দার্শনিকদের প্রভাব কতটা যথার্থ ছিল ? :   

ফরাসী বিপ্লব ঘটবার জন্যে দার্শনিকদের অবদান নিয়ে ইতিহাসে বিতর্ক রয়েছে। 

দার্শনিকদের প্রভাবের পক্ষে যাঁরা মত দিয়েছেন তাঁরা হলেন – তেইন, সোতাব্রিয়া, রুস্তা, আবে বারুয়েল প্রমুখরা। 

অন্যদিকে বিপক্ষে যাঁরা মত দিয়েছেন তাঁরা হলেন – জর্জ লেফেভার, মসস্টিফেন্স, গুডউইন প্রমুখরা।  

প্রভাবের পক্ষে মত :

১) দার্শনিকদের লেখাগুলি বুর্জোয়া শ্রেণী পাঠ করে তাঁদের মধ্যে বিপ্লবের চেতনা জেগেছিল। সেকারণেই তাঁরা বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়। 

২) দার্শনিকদের রচনাগুলি সাধারণ মানুষকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করেছিল। উদাহরণ হিসাবে ভলতেয়ারের রচনার কথা বলা যেতে পারে। 

৩) দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা সাধারণ মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। এই চিন্তাধারা তাঁদেরকে বিপ্লব ঘটাতে সাহায্য করেছিল।

প্রভাবের বিপক্ষে মত :

১) বিভিন্ন দার্শনিকদের মত ভিন্ন হওয়ায় তাঁদের প্রভাব অতটা তীব্র হয়নি। 

২) দার্শনিকরা তাঁদের যুক্তিবাদের ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটাতে পারেননি। কারণ দার্শনিকরা ছিলেন তত্ত্ববাদী। 

৩) তাঁরা বিপ্লবে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি। শুধুমাত্র পুরাতনতন্ত্রের সংস্কারের কথা বলেছেন মাত্র। তাই ফরাসী বিপ্লবে তাঁদের প্রভাব উপেক্ষিত ছিল। 

আরও পড়ুন : ফরাসী বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণগুলি

পরিশেষে :

এইসব বিতর্ক সত্ত্বেও শেষে বলা যেতে পারে যে, অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। যাঁরা কিনা সাধারণ মানুষকে সমাজে অন্যায়-অত্যাচার সম্পর্কে সজাগ করতে পারতেন। কিন্তু দার্শনিকদের রচনা সেই অভাব পূরণ করেছিল। মানুষের মনে বিপ্লবের বোধ জাগিয়েছিল।

পোস্টটি পড়ে তোমার কেমন লাগলো তুমি কমেন্টে নিশ্চয়ই জানাবে। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার। ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো  “।

2 thoughts on “ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা | Philosophers role in French Revolution in bengali”

  1. Pingback: নেপোলিয়নের পতনের কারণ গুলি কি ছিল | Napoleon Bonaparte

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!