রহস্যে ঘেরা মায়া সভ্যতার ইতিহাস । Mayan civilization history

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু সুপ্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। এই সভ্যতাগুলির একেকটি বিষ্ময়ে ভরা। বর্ণ, বৈশিষ্ট্যে আলাদা।

আদিম সমাজ থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে বহু জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটেছে।

জনগোষ্ঠীগুলির ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরিচয়ে স্বতন্ত্র। এককথায় একেই বলা হয় সভ্যতা। সভ্যতার সাথে জড়িয়ে থাকে কতগুলি দিক।

যেমন – ভাষা, জীবনচর্চা, পোশাক, রীতি-নীতি, খাদ্যের অভ্যাস, লোকাচার ইত্যাদি। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ সহ বিভিন্ন মহাদেশে নানারকমের সভ্যতার দেখা মিলেছে।

ভারতবর্ষে ছিল সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল। রোমান, ব্যাবিলন সভ্যতার কথাও বলা যেতে পারে।

পশ্চিম এশিয়ার দেশ সিরিয়াতে গড়ে উঠেছিল ফোয়েনিসিয়া সভ্যতা। মধ্যপ্রাচ্যের শিয়রে ইজরায়েলীয় সভ্যতার দেখা মিলেছিল।

মধ্যপ্রাচ্যের কথাই যখন বলছি মিশরীয় সভ্যতার কথা না বললে হয়তো ভুল করা হবে।

খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দে এই সভ্যতাটির জন্ম হয়েছিল। এই সভ্যতার শাসকরা পরিচিত ছিলেন মেনেশ বা ফ্যারাও নামে। নীল নদীর ধারে গড়ে উঠেছিল মিশরীয় সভ্যতা। 

এই পোস্টে আলোচনার বিষয় রহস্যময় মায়া সভ্যতার ইতিহাসকে জানা। তাই পুরো পোস্টটি পড়বার অনুরোধ রইল।  

mayan civilization মায়া সভ্যতার ইতিহাস

মায়া সভ্যতার ইতিহাস ( Mayan civilization )

১) মায়া সভ্যতার উদ্ভবের স্থান :

মায়া সভ্যতা যেহেতু আলোচনার বিষয় তাই জানবো কোথা থেকে উদ্ভব হয়েছিল মায়া সভ্যতার পত্তনকারীদের। আর কোথাই বা গড়ে উঠেছিল এই সভ্যতা। চলে আসি প্রত্নতত্ববিদদের কথায়।

এঁরা বলছেন, প্রায় কুড়ি হাজার বছর আগে বর্তমান আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের পূর্বপুরুষরা এশিয়া থেকে বেরিং প্রণালী ধরে আমেরিকায় এসে উপস্থিত হয়। স্বাভাবিক ভাবেই এই মানুষেরা ছিল যাযাবর শ্রেণীর মানুষ।

এই মানুষগুলোই উত্তর, মধ্য, দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে বেশকিছু সভ্যতার জন্ম দিল। যেমন, টুক্সলা, কাম্পেচে, ওলমেক, মায়া ইত্যাদি।

এগুলির মধ্যে মায়া সভ্যতা বিরাট অংশ জুড়ে ছড়িয়েছিল। মধ্য আমেরিকা থেকে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল মেক্সিকো, হন্দুরাস, গুয়াতেমালা, বেলিজ, এল সালভাদোর এর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।

মেক্সিকোর ইউকাতান, কাম্পেচে, তাবাস্কো, চিয়াপাস এই শহরগুলি ছিল মায়া সভ্যতার মূল কেন্দ্র। গুয়াতেমালায় মায়া সভ্যতার ইতিহাসও প্রাচীন।

এখানকার মিরাডর, নাকচে, কামিনাল, নেবা, গুয়াতান এই সবমিলিয়ে প্রায় সাতাশটি শহরে গড়ে দেখা মিলেছিল মায়া সভ্যতার।

হন্দুরাস দেশটিও ছোটো একটি দেশ। দেশটিতে মায়া সভ্যতার চিহ্ন রয়েছে।

এখানকার কোপান নামক স্থান এই সভ্যতার প্রত্নস্থল। বর্তমানে স্থানটির সৌন্দর্য পর্যটকদের নিজের কাছে টানে। বেলিজ, এটিও মধ্য আমেরিকার ছোট্টো একটি দেশরূপে পরিচিত। মায়া সংস্কৃতির স্মৃতিচিহ্ন বহন করে নিয়ে চলেছে।

মেক্সিকোতে মায়া সমাজ সংস্কৃতির অন্যতম স্থানরূপে ইউকাতান বিবেচিত হয়। এই ইউকাতানের বিশেষ একটি শহর ছিল মায়াপান। মায়াপান শহরটি মায়াদের সবচেয়ে বড়ো এবং শেষ শহর।

একসময় মায়াপান ইউকাতানের রাজধানী হয়েছিল।

২) মায়া শহর মেক্সিকোর চিয়াপাস :

মায়া সভ্যতার অন্যতম একটি শহর চিয়াপাস। মেক্সিকোতে শহরটি অবস্থিত। মায়া জনজাতি এবং কিচে, মাম, ইক্সিল, জাকালটেক, তোতজিল, তেলতাল এইসমস্ত বহু জনগোষ্ঠী অতীতের চিয়াপাসে বসবাস করতো।

মূলত তাঁত শিল্পী ও মন্দির নির্মাণের সাথে যুক্ত শিল্পীদের বাস ছিল এখানে। চিয়াপাসের মায়া স্থাপত্য সত্যিই যেন এক বিস্ময় জাগায়। মনে করা হয় চিয়াপাসের আদি নাম পালেঙ্কে।

উসুমাসিন্দা নদীর তীরে চিয়াপাস অবস্থিত। বর্তমানে স্থানটি গভীর জঙ্গলে ঢাকা। তবে এই স্থানটির সৌন্দর্য পর্যটকদের খুব পছন্দ।

মায়া সভ্যতার অন্যতম শহর গুয়াতেমালার পেতেন। পেতেনে ইতজা জনজাতিদের বাস ছিল। রাজধানী টায়াসাল। পেতেনকে সাধারণ মানুষ নোজপেতেন বলতো।

এই শব্দের অর্থ করলে দাঁড়ায় বড়ো দ্বীপ। বহু সময় পরে স্প্যানিশ একনায়কদের রোষানলে পড়ে এটি পরিণত হয় স্প্যানিশ উপনিবেশে। 

৩) মায়া সভ্যতার সময়কাল বা পর্যায়ক্রম :

মায়া সভ্যতাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন পন্ডিতসমাজ। একটি গঠনের পর্যায়, দ্বিতীয়টি প্রাক সর্বোত্তম পর্যায় আর তৃতীয়টি সর্বোত্তম পর্যায় বা শেষ পর্যায়।

খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সাল থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ সাল পর্যন্ত মায়া সভ্যতার সময়কাল বা পর্যায়। এরপর শুরু হয় প্রাক সর্বোত্তম পর্যায় এবং গুয়াতেমালার পেতেন থেকে ইউকাতানে এই সভ্যতার বিজয়রথ চলেছিল দশম শতাব্দী পর্যন্ত।

এটিই সর্বোত্তম পর্যায় ছিল। ৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে মায়াদের অন্যতম একটি জনগোষ্ঠী টলটেক-রা মায়া নগররাষ্ট্র চিচেন ইৎজা দখল করে।

মায়া ও টলটেক উভয়ের মিলিত প্রভাবে রেনেসাঁস ঘটে যায়। তবে শেষমেশ ১৪০০ সালের দিকে মায়াদের শেষ শহর মায়াপানে এই সভ্যতার অবসান ঘটেছিল।

আমরা ছবিতে যে মায়া পিরামিড দেখতে পাই তা এই চিচেন ইৎজা-তেই নির্মিত হয়েছিল।

মায়া সভ্যতার নিদর্শন ও স্থাপত্য

মায়া সভ্যতার ইতিহাস আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি না এই সভ্যতার স্থাপত্য ও নিদর্শন সম্পর্কে আলোচনা না করা হয়। স্থাপত্য হিসেবে পিরামিডের নিদর্শনই নজর কাড়ে।

হয়তো মনে হবে পিরামিড শুধু মিশরীয় ইতিহাসেই অবাধ বিচরণ করেছে। গিজার পিরামিড, খুফুর পিরামিড এইরকম আরো কতোই না পিরামিডের নাম।

কিন্তু মায়া সভ্যতার দিকে তাকালে দেখা যায় পিরামিডের অবস্থান এখানেও। সেই আলোচনায় পরে আসছি। মায়া সভ্যতার দুটি উল্লেখযোগ্য নদী উসুমাসিনতা ও গ্রিজালভা।

এই দুটি নদী বয়ে গিয়েছে মেক্সিকো ও গুয়াতেমালার মাঝসীমান্ত দিয়ে। এখানেই অবস্থিত একটি শহর চিয়াপাস। এর নাম আগেও বলা হয়েছে।

এই চিয়াপাসের মধ্যে পালেঙ্কে, ইয়াক্সচিলান, বোনামপাক, তোনিনা ইত্যাদি স্থাপত্যস্থান হিসেবে বিবেচিত।

আরও পড়ুন : মহাবীর ও জৈন ধর্ম

১) পালেঙ্কের মায়া নিদর্শন :

পালেঙ্কে একটি মায়া জনজাতিবহুল শহর। চিয়াপাসের সুন্দর ও সমৃদ্ধ একটি শহর। উসুমাসিনতা নদীর তীরে অবস্থিত। পালেঙ্কের পিরামিড স্থাপত্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

যদি মায়া জনবসতি ও সভ্যতার প্রথম আবিষ্কারের নাম করা হয়, তাহলে তা অবশ্যই পালেঙ্কে। পালেঙ্কেতে অভিযানের কথা প্রথম মাথায় আসে স্পেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের।

অভিযান শুরু ১৭৮৭ সালে। চতুর্থ চার্লস সেনাবাহিনীর কর্নেল ডুপাই-কে পালেঙ্কে অন্বেষণের নির্দেশ দেন।

তিনি ও তাঁর দলবল ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে চুনাপাথরের খাঁজ খাঁজ করা স্থাপত্যের সন্ধান পান। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা নিশ্চিত হন যে এগুলি মায়া সভ্যতারই স্থাপত্য নিদর্শন।

পরবর্তীকালে অনেক গবেষণার পর পালেঙ্কের পিরামিড মন্দিরের দেয়ালচিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়া গেছে।

জানা গেছে ৬১৫-৬৮৩ খ্রিস্টাব্দ-র মধ্যে পাকাল নামে কোনো রাজা এইখানে রাজত্ব করেছিলেন। পালেঙ্কেতে পিরামিডের সংখ্যা তিনটি।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় তৃতীয়টিই। পিরামিডের গায়ে ক্ষমতাশালী রাজার বীরগাঁথা শোভা পাচ্ছে।

২) ইয়াক্সচিলানের মায়া নিদর্শন : 

পালেঙ্কের পর যে পিরামিড স্থাপত্য প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হোলো ইয়াক্সচিলানের পিরামিড। ইয়াক্সচিলান মায়াদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর।

শহরটি অবস্থিত সেই উসুমাসিনতা নদীর তীরে। মায়া সভ্যতার ক্লাসিক পর্বে উসুমাসিনতা নদী যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হয়েছিল। এখানকার পিরামিডের ভাস্কর্য সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

দশম শতকের মাঝামাঝিতে তৈরী ইউকাতানের ‘উক্সমাল’ পিরামিডটি বিখ্যাত।

প্রত্নতত্ব বিদদের মতে, মূলত জাদুবিদ্যা শেখানোর জন্যই পিরামিডটি নির্মিত হয়েছিল। জাদুবিদ্যার দেবতা ইত্জামনাকেই এই পিরামিডটি মায়ারা উৎসর্গ করেছিল।

৩) চিচেন ইৎজার স্থাপত্য নিদর্শন :

মায়া স্থাপত্য ঘরানার আরেক নিদর্শন লুকিয়ে রয়েছে চিচেন ইৎজা শহরে। চিচেন ইৎজা-র পিরামিডকে বলা হয় ‘টেম্পল অফ কুকুলকান’।

চিচেন ইৎজার পিরামিডটির নির্মাণকাল আনুমানিক ১১০০ খ্রিস্টাব্দ। সাপের মতো দেখতে এক বিশেষ প্রাণীর অবস্থান এখানে দেখা যায়। পিরামিডে প্রবেশের সিঁড়ির মোট ধাপ ৩৬৫ টি।

সংখ্যাটিকে বছরের ৩৬৫ দিনের সাথে সমার্থক হিসেবে দেখা হয়েছে। এখন ভাবার বিষয় এইরকম সুন্দর, নজরকাড়া পিরামিড গুলি মায়া সভ্যতার স্থপতিকাররা বানালেন কিভাবে।

এখনকার মতো আধুনিক নির্মাণ প্রযুক্তি যে সেসময়ে গড়ে ওঠেনি তা হলফ করে বলা যায়। তবে সাধারণ মানুষের কাছে এসম্পর্কে কৌতূহল জাগে।

উত্তর মেলে প্রত্নতাত্বিক খননকার্যের থেকে। তথ্য বলছে, চুনাপাথর বা লাইমস্টোন, সুড়কি প্রভৃতি সামগ্রী ব্যবহার করে মন্দিরগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। এরসাথে ছিল অবশ্যই ছিল পাথরের ব্যবহার।

পিরামিডের ভেতরে সূক্ষ্ম কারুকার্য ফুটিয়ে তুলতে পাথরের তৈরী স্টোন চিজেল ব্যবহার করা হোতো। এছাড়াও স্ক্র্যাপার বা শক্ত পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরী হাতুড়িকে যন্ত্রপাতি হিসেবে কাজে লাগাতো মায়ারা। 

৪) মেক্সিকোর মায়া নিদর্শন :

মেক্সিকো ছিল মায়া সভ্যতার বিশেষ ঘাঁটি। মেক্সিকোর পিরামিডের সাথে পরিচিত হতে গেলে প্রথমেই নাম বলতে হয় ‘তুলুম’-র পিরামিডের।

মেক্সিকোর কানকুন শহরের ১৩১ কিলোমিটার দক্ষিণে এই পিরামিডটি অবস্থিত। কঠিন পাথরের দেওয়াল এবং সেখানে বর্ণিত চিত্রসম্ভার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

মেক্সিকোর কিনতানারু প্রদেশের পশ্চিম দিকে কোবা নামক একটি স্থান রয়েছে। কোবার সবচেয়ে উঁচু পিরামিডটির নাম ‘নোহাক মূল’।

গভীর বিস্তৃত জঙ্গলের মধ্যে পিরামিডগুলো অবস্থান করছে। যদিও এগুলি এখন ভগ্নদশাপ্রাপ্ত। তবুও আজও নীরবে অতীতের মায়া সভ্যতার সাক্ষ্য বহন করছে।

আরও পড়ুন : মুঘল যুগের মুদ্রাব্যবস্থা

৫) হন্ডুরাসের মায়া নিদর্শন :

মায়া সভ্যতার স্থাপত্যের স্মৃতি বহন করছে মধ্য আমেরিকার একটি ছোট্ট দ্বীপময় দেশ, নাম হন্ডুরাস। এর রাজধানী তেগুসিগালপা। 

১৮২১ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের কাছ থেকে দেশটি স্বাধীনতা পেয়েছিল। দেশটির বেশিরভাগ মানুষের কথ্য ভাষা স্প্যানিশ।

অন্যদিকে মেসোআমেরিকান বা মায়া সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ আবাস্থল রূপে চিহ্নিত। হন্ডুরাসের অন্যতম পিরামিডটি হোলো কোপান।

হন্ডুরাসের পশ্চিম দিকে কোপানের অবস্থান। অতীতে হন্ডুরাসে মায়াদের অবস্থান ছিল এখানেই।

৬) এল সালভাদোরের মায়া নিদর্শন :

এল সালভাদোর একটি ছোটো মাপের দেশ। সেইসাথে মায়া স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনের একটি কেন্দ্রও। এল সালভাদোরের তাজুমাল নামক একটি স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মায়া প্রাসাদের অবশিষ্টাংশ।

সারি সারি সাজানো, বড়ো নির্মাণবহুল প্রাসাদ এখানে বিস্তীর্ণ প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে। সালআন্দ্রেস, এল সালভাদোরের একটি প্রত্নতাত্বিক কেন্দ্র।

প্রাসাদগুলির কাঠামোর মধ্যে ক্লাসিক মায়া পর্বের শৈলী লক্ষণীয়। এইরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাসাদের স্থাপত্যশৈলীর সাথে ইতালির পম্পেই নগরের তুলনা করা চলে।

পম্পেই, ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন রোমান নগরী হিসেবে পরিচিত।

৭) বেলিজের মায়া নিদর্শন :

বেলিজ মধ্য আমেরিকার একটি রাষ্ট্র। বেলিজে মায়া সভ্যতার সূত্রপাত ঘটে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দে। বেলিজ উত্তর গুয়াতেমালার সীমান্তে অবস্থিত। জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ।

মায়া মন্দির – পিরামিড বেলিজের মূল আকর্ষণ। প্রত্নতাত্বিক তথ্য থেকে জানা যায় বেলিজেই প্রথম দিকের ২০ লক্ষ মায়া জনগোষ্ঠীর বাস ছিল।

ধীরে ধীরে স্পেনীয় আগ্রাসনের কবলে পড়ে এখানকার ছোটো বড়ো শহরগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বেলিজের মায়া পর্বতমালার মধ্যে নীরবে অবস্থান করছে মায়া প্রত্নস্থল কারাকোল।

১৯৩৮ সালে স্থানটি প্রত্নতত্ববিদদের নজরে আসে। এছাড়াও বেলিজের মায়া স্থাপত্যের লোভনীয় দর্শন মেলে লামানাই-তে। এখানে পাওয়া শিলালিপিগুলি মায়া সভ্যতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেয়।

মায়া সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চা ( মায়া সভ্যতার ইতিহাস )

১) মায়াদের গণিতচর্চা : 

মায়া সভ্যতায় বিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য বিষয় হোলো গণিতচর্চা। আজ থেকে চার হাজার বছর পূর্বে গণিতের ধারণা আজকের মতো ছিল না। মায়া সভ্যতায় গণিতের চরম উন্নতি ঘটেছিল।

সেই প্রাচীন সময়কাল থেকেই শূন্যের অস্তিত্ব মায়াদের কাছে অজানা ছিল না। মায়াদের গণিতচর্চায় ২০ সংখ্যাটি বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়েছে।

গবেষকদের মতে, মায়ারা সংখ্যা গণনার কাজে হাত ও পায়ের আঙ্গুল ব্যবহার করতো। বর্তমানে আমরা আধুনিক যে সংখ্যা লিখি, তা দশমিক পদ্ধতিতে নির্মিত। অর্থাৎ দশের পরবর্তী সংখ্যাটি পরবর্তী পংক্তি শ্রেণীতে চলে যায়।

যেমন – ১-৯ একক, ১০-৯৯ দশক, ১০০-৯৯৯ শতক এইভাবে সংখ্যা এগিয়ে চলে। মায়ারা সংখ্যা লেখার ক্ষেত্রে অন্য পদ্ধতির আমদানি ঘটালো।

মায়া পদ্ধতিতে ১-২০ একক, ২০-৩৯৯ দশক, ৪০০-৭৯৯৯ শতক ইত্যাদি। এই পদ্ধতিতে বড়ো সংখ্যা লেখা মায়াদের কাছে সমস্যাই ছিল না।

মায়াদের অঙ্কের গভীর জ্ঞান তাঁদের প্রায় পাঁচ হাজার বছরের হিসাব সম্বলিত ক্যালেন্ডার তৈরিতে সাহায্য করেছিল।

এরফলে সুদূর ভবিষ্যতের বিভিন্ন তারিখের অনুমান নখদর্পণে ছিল মায়াদের। আধুনিক গবেষকদের মতে, মায়া গণিতজ্ঞদের বিভিন্ন কঠিন অঙ্কের নির্ভুল সমাধান তাঁদেরকে এতোবেশি পারদর্শী করে তুলেছিল।

আরও পড়ুন : ভগৎ সিং স্মরণীয় কেন

২) মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডার :

মায়াদের তিনধরণের ক্যালেণ্ডারের প্রচলন ছিল। একটি ক্যালেণ্ডার হোলো দীর্ঘ গণনার পদ্ধতিযুক্ত। পেরিয়ে আসা সময় ও আগামী সময় দুটোকেই তাঁরা এই ক্যালেণ্ডারের মাধ্যমে নির্ণয় করতো।

ক্যালেণ্ডারের আরেকটি রকম ছিল ‘জোলকিন’ ক্যালেণ্ডার। এই ক্যালেণ্ডার ব্যবহার করা হোতো সমাজের বিভিন্ন রীতি-নীতি ও অনুষ্ঠানে। এই ক্যালেণ্ডারে প্রতিটি ভাগ ছিল তেরো দিনের।

মোট কুড়িটি ভাগে ভাগ করে বছর হোতো ২৬৩ দিনের। তিনটি দিন অতিরিক্ত যোগ করা থাকতো।

বিশেষজ্ঞগণ বলছেন গ্রহের কক্ষপথ পরিভ্রমণের সাথে এই ক্যালেণ্ডারের কার্যকারিতা রয়েছে। তবে মায়া ক্যালেণ্ডার নিয়ে এগারো বছর আগে জনমানসে কৌতূহল, আতঙ্ক ছড়িয়েছিল।

সময়টা ২০১২ সালের অক্টোবর মাস। এমনটা বলা হয়েছিল যে, মায়া জ্যোতির্বিদ্যার হিসেব অনুযায়ী ওই নির্দিষ্ট বছরের নির্দিষ্ট মাসের পর সবার সাধের পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।

এক মারাত্মক ভয় সবার মধ্যে দানা বেঁধেছিল। একটি ফোবিয়া এতটাই জাঁকিয়ে বসেছিল যে, পূজা ও যাগযজ্ঞের আয়োজন পর্যন্ত দেখা যায়।

আসলে বিষয়টি ছিল অন্যরকম। মায়া জ্যোতির্বিদ্যার হিসেব অনুযায়ী ২০১২ সালের পর পৃথিবীতে নতুন যুগের শুরুর কথা বলা হয়েছিল।

হয়তো এমনটা হতে পারে মায়া লিপিগুলি ঠিকমতো অনুধাবন করা হয়নি। তবে সেই ভবিষ্যৎবাণী উপেক্ষা করে আমার আপনার সবার সাধের পৃথিবী আজও টিকে আছে।

৩) মায়া জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা :

মায়া সভ্যতার সমৃদ্ধ দিকগুলির মধ্যে অন্যতম জ্যোতির্বিদ্যা। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ – উপগ্রহ ও তাদের অবস্থান, অক্ষরেখা, ছায়াপথ ইত্যাদি নিয়ে যে গবেষণা হয় তাই জ্যোতির্বিদ্যা নামে পরিচিত।

মায়া সভ্যতার বিজ্ঞানীগণ জোতির্বিদ্যা ভালোকরেই রপ্ত করেছিলেন। জ্যোতির্বিদ্যার কাজে তাঁরা গণিতের সাহায্য নিয়েছিলেন।

জ্যোতির্বিদ্যার সাথে গণিতের যোগসূত্র থাকায় মায়াদের এক অসাধারণ পঞ্জিকার সন্ধান পাওয়া যায়। আর পঞ্জিকাটিও ছিল নির্ভুল। সভ্যতার সাথে পঞ্জিকার একটি যোগাযোগ আছে।

কারণ এই পঞ্জিকাতেই লিপিবদ্ধ থাকে তখনকার ঋতু পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত, চাষবাস সম্পর্কিত বিষয়গুলি। মায়া জ্যোতির্বিদরা পঞ্জিকা তৈরিতে গুরুত্ব দিয়েছিলেন আকাশকে।

আকাশের সূর্যের গতিপ্রকৃতি, তারা, গ্রহের অবস্থান এই সবকিছুকে বিশ্লেষণ করে ঘটনাপঞ্জি লিখে রাখতেন। এই ঘটনাপঞ্জি গুলি কালক্রমে পঞ্জিকায় রূপ পায়।

মায়াদের এই জ্যোতির্বিদ্যার উপাদান ছিল সূর্য। সূর্যের সাথে পৃথিবী ও চাঁদের অবস্থান বিশ্লেষণ অনায়াসে দক্ষতার সাথে মায়া জ্যোতির্বিদরা করতে পারতো।

আকাশে সূর্যের অবস্থানকে আরও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য মায়ারা মন্দির পর্যন্ত নির্মাণ করেছিলেন। মায়া সভ্যতার জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে জানবার উৎস আবিষ্কৃত হয়েছে।

এই উৎসের নাম কোডিসেস। কোডিসেস আসলে মায়াদের হাতে লিখিত পুঁথি স্বরূপ। যদিও এই পুঁথির অধিকাংশই স্পেনীয় আক্রমণের জন্যই নষ্ট হয়ে গেছে।

ডেসড্রেন কোডেক্স, মাদ্রিদ কোডেক্স, প্যারিস কোডেক্স এগুলি ছিল মূলত জ্যোতির্বিদ্যার বর্ষপঞ্জি। ডেসড্রেন কোডেক্স জ্যোতির্বিদ্যার বর্ষপঞ্জি।

মাদ্রিদ কোডেক্স হরোস্কোপ বা ঠিকুজির বর্ষপঞ্জি। এই বর্ষপঞ্জি পুরোহিতদের কাজে লাগতো।

কোনো পবিত্র দিনক্ষণ, পূজো-পার্বণ, তিথি ইত্যাদি জানতে এই জাতীয় পঞ্জিকার দরকার হোতো। প্যারিস কোডেক্স ভবিষ্যতবাণী বা জ্যোতিষচর্চার কাজে ব্যবহৃত হোতো। 

মায়া সভ্যতায় লোকাচার ও লৌকিক দেবদেবী 

মায়াদের লোকবিশ্বাসের মধ্যে রোগ-ব্যাধি ও তার চিকিৎসা এক অন্যতম বিষয়। রোগ-ব্যাধিকে শারীরিক কার্যকলাপ হিসেবে মায়ারা দেখতো না।

বরং রোগকে মায়ারা তাঁদের আরাধ্য দেবতার ক্রোধ হিসেবেই মানতো। শরীর এবং আত্মা মায়াদের কাছে একই বিষয়। মায়াদের ধারণা ছিল কোনো অপদেবতার কারণেই শরীরে রোগ বাসা বাঁধে।

মুক্তির উপায় হিসেবে জানা ছিল নিজেদের পূর্বপুরুষদের আত্মাকে যেকোনো ভাবে সন্তুষ্ট করা। তাই কোনো ভেষজ, ওষুধ মায়াদের কাজে আসতো না।

আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়েছে যে, মায়ারা পরজীবী রোগে আক্রান্ত হোতো বেশি। এমনকি পরজীবী আক্রান্ত হয়ে মায়া জনজাতির বহু মানুষের মৃত্যুও ঘটেছিল।

আসা যাক মায়াদের লৌকিক দেবদেবীদের প্রসঙ্গে। মায়াদের ধর্মীয় বিশ্বাস খুবই অটুট ছিল। সেইকারণে দেবদেবীদের আশ্রয় করে লৌকিক গল্পগাঁথারও জন্ম হয়েছে।

ভারতীয় সমাজ জীবনের দিকে তাকালেও এইরকম লৌকিক দেবদেবীদের খোঁজ মেলে। যাক সেই আলোচনায় এখন যাচ্ছি না। মায়া সমাজের এক বিশেষ দেবতা ছিলেন ‘ইক্সচেল’।

দেবতা ইক্সচেল মূলত বিপদের থেকে উদ্ধারকারী দেবতা হিসেবেই পরিগণিত হতেন। মায়া জনসমাজকে প্রায়ই বিপদের মুখোমুখি হতে হোতো।

সেই বিপদ দৈনন্দিন প্রাকৃতিক বিপদ। বন্যা, ঝড়-ঝঞ্ঝা ইত্যাদি।

মায়ারা আরাধ্য ইক্সচেলকে খুশি রাখতে তৎপর থাকতেন। ইক্সচেল-এর বর্ণনা অনেকটা এইরকম, তাঁর মাথায় থাকতো সাপ এবং সাপকে আড়াআড়িভাবে থাকতো দুটি হাড়।

‘ইৎজাপালটেক’ হলেন আত্মত্যাগ ও প্রায়শ্চিত্তের দেবতা। এনার বাঁহাতে ছুরি ও ডানহাতে শঙ্খ অবস্থায় দেখা গেছে। মায়াদের কাছে তাঁদের জলের দেবতা হিসেবে পূজিত হতেন ‘তালোক’।

তালোক জলের দেবতা হলেও বাস ছিল তাঁর পাহাড়ে। মুখে মুখোশ পরিহিত ও সেইসাথে নাকে নাকছাবির মতো সুন্দর অলংকার।

এছাড়াও ছিলেন ‘আকান’ যিনি ছিলেন মদ সেবনের দেবতা। ‘আহ পুচ’ মৃত্যুর দেবতা, ‘আহ পিকু’ বজ্র-বিদ্যুৎ দেবতা, ‘এক চুয়াক’ যুদ্ধের দেবতা, ‘সিজিন’ ভূমিকম্পের দেবতা ইত্যাদি।

উপসংহার 

মায়া সভ্যতার বিভিন্ন দিক এখনো সারা বিশ্বের কাছে আকর্ষণীয়। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষকরা মায়াদের সম্বন্ধে প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য আবিষ্কার করে চলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় গুলির আলাদা বিভাগ তৈরী করা হয়েছে এই সভ্যতা সম্পর্কে গবেষণার জন্য। তাই এই সভ্যতার বাস্তবতার অস্বীকারের কোনো জায়গা নেই। রহস্যে ঘেরা মায়া সভ্যতার ইতিহাসের মায়াবী আকর্ষণ আগামী দিনে ইতিহাস পিপাসু প্রতিটি মানুষকে কাছে টানবে। মানুষের চিন্তন ও দর্শন স্পৃহাকে চমকিত করবে।

আরও পড়ুন : ভারতীয় রাজ নর্তকীদের ইতিহাস

আশা করি ‘রহস্যে ঘেরা মায়া সভ্যতার ইতিহাস’ সম্পর্কিত পোস্টটি পড়ে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে নিজেদের মতামত জানাতে পারো। সম্ভব হলে পোস্টটি শেয়ার কোরো। তোমাদের মূল্যবান মতামত অনুপ্রেরণা জোগাতে সাহায্য করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!