সাঁওতাল বিদ্রোহ | The Santal Rebellion in bengali

সাঁওতাল বিদ্রোহ (The Santal Rebellion)

নমস্কার বন্ধু কেমন আছো, আশা করি খুব ভালো আছো। এই পোস্টে আলোচনা করবো সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে। ইতিহাসে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা নিশ্চই পড়েছ।

যদি না পড়ে থাকো তাহলে এই পোস্টটি অবশ্যই পড়ে নাও।

আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তুমি উপকৃত হবে। আগের পোস্টটি তিতুমীর ও তাঁর আন্দোলন  -এর ওপর করা হয়েছে , চাইলে এটিও তুমি পড়তে পারো।

সাঁওতাল কারা :

সাঁওতাল হল ভারতের প্রাচীনতম এক আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাঁরা শ্রমের বিনিময়ে জীবনধারণ করত।

চাষবাস ও বনের থেকে শিকার করে তাঁদের জীবন চলত। সাঁওতালরা বিশ্বাস করত যে, শ্রমের বিনিময়ে যে ফসল ফলাবে জমি তারই হবে।

লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ভারতে সাঁওতালরা জমিহারা হয়।  

বিদ্রোহের পূর্বে সাঁওতালদের বাসস্থান :

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে সাঁওতালরা তাঁদের জমি হারিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে রাজমহল পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়-জঙ্গল অঞ্চলে নতুন বসতি গড়ে তুলেছিল।

পাহাড়ী জমি পরিষ্কার করে চাষের কাজ ও বসতি শুরু করে।

এই স্থানটিকে তাঁরা নাম দিয়েছিল ‘দামিন-ই-কোহ’ বা মুক্তাঞ্চল। এই দামিন-ই-কোহ তে প্রায় ৮৫ হাজার সাঁওতাল বসবাস করত। 

সাঁওতাল বিদ্রোহের সময়কাল :

সাঁওতাল বিদ্রোহ ১৮৫৫-৫৬ সালে সংঘটিত হয়েছিল। ভারত ইতিহাসে এই সাল এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। 

সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা :

সাঁওতাল বিদ্রোহকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছিল প্রধান দুই নেতা সিদো মুর্মুকানহু মুর্মু নামে দুই ভাই।

এছাড়াও বীর সিংহ, কালা প্রামাণিক, ডোমন মাঝি প্রমুখ নেতারাও এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল।

হুল গঠন :

১৮৫৫ সালে জুলাই মাসে সাঁওতালরা তাঁদের সংগঠন হুল গঠন করে।

হুল ছিল তাঁদের তীব্র প্রতিশোধস্পৃহার ফসল। সিধু ও কানুর নেতৃত্বে মুর্শিদাবাদ ও ভাগলপুর জেলায় হুলের সূচনা হয়েছিল। হুল গঠনের মাধ্যমেই শুরু হয় সাঁওতাল বিদ্রোহ।

আজও প্রতিবছর ৩০ শে জুন হুল দিবস পালন করা হয়। 

সাঁওতাল বিদ্রোহের কারণ :  

বাসস্থানে হস্তক্ষেপ

সাঁওতালরা পরিশ্রম করে সাঁওতাল পরগনা অঞ্চলকে বাস করার যোগ্য করে তুলেছিল। তাঁরা এই অঞ্চলের নাম দিয়েছিল দামিন-ই-কোহ

কিন্তু এখানেও বহিরাগত ইংরেজ, জমিদার, বণিক ও মহাজনদের নজর পড়ে। সাঁওতালরা এই বহিরাগতদের বলতেন দিখু বা বিদেশি। সাঁওতালদের এই মুক্ত অঞ্চল জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়।

জমিদারি রাজস্বের কোপ পড়ে তাঁদের উপর। শুরু হয় সাঁওতালদের ওপর অত্যাচারী জমিদারদের শোষণ।

বাসস্থানে হস্তক্ষেপের ফলে সাঁওতালরা ক্ষুব্ধ হয় ও বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।

মহাজনী শোষণ

সাঁওতালদের ক্ষোভের একটি বড় কারণ ছিল মহাজনদের শোষণ।

এই মহাজন সম্প্রদায় ছিল অত্যন্ত ধুর্ত ও সুবিধাবাদী। মহাজনেরা সরল সাধাসিধে সাঁওতালদের শোষণ করত। সাঁওতালদের আর্থিক দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে তাঁদেরকে চড়া সুদে ঋণ দিত।

বহু সাঁওতাল ঋণ মেটাতে না পেরে তাঁদের বসত জমিটুকু শেষে মহাজনদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হত।

তাই দীর্ঘদিন দিন ধরে মহাজনী শোষণ সহ্য করতে না পেরে সাঁওতালরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল।

আরও পড়ো : ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ আন্দোলন 

নীলকরদের শোষণ ও অত্যাচার – 

নীলকরদের শোষণও সাঁওতাল বিদ্রোহের পিছনে দায়ী ছিল। নীলকর সাহেবরা জোর করে সাঁওতালদের দিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত।

নীলচাষ করার ফলে সেই জমিতে আর অন্য কোনো ফসল চাষ করা যেত না।

এর ফলে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল। নীলকর সাহেবদের অমানুষিক অত্যাচার থেকে মুক্তিলাভের জন্য সাঁওতালরা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। 

রেলকর্মীদের অত্যাচার – 

সেইসময় তিলা পাহাড়, ভাগলপুর ইত্যাদি অঞ্চলে রেললাইন পাতার কাজ শুরু হয়েছিল। রেলের ঠিকাদাররা একাজে সাঁওতালদের ব্যবহার করে।

সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও সাঁওতালরা প্রাপ্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হত।

রেলকর্মী ও ঠিকাদারদের এই শোষণ সাঁওতালদের বিদ্রোহমুখী করে তোলে। 

সাঁওতাল নারীদের সম্মানহানি –  

বহু সাঁওতাল নারীদের সম্মান ইংরেজরা নষ্ট করে।

তাঁদের নারীদের প্রতি এই অসম্মান স্বাধীনতা প্রিয় সাঁওতালরা মেনে নিতে না পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। 

সিধু ও কানুর ভূমিকা :

সাঁওতাল বিদ্রোহকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সবথেকে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন সিদো/সিধু মুর্মুকানহু/কানু মুর্মু নামে দুই ভাই।

এঁরা ছিলেন সাঁওতাল পরগনার ভাগনাডিহি গ্রামের চাঁদ মুর্মুর যমজ পুত্র। এঁরা দুজনেই ছিলেন প্রচন্ড সাহসী ও দৃঢ় চরিত্রের মানুষ।

সিধু ও কানু ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁদের দেবতা তাঁদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন ‘দিখুদের খুন কর, তাহলে ন্যায়বিচার পাবে ‘। গোটা সাঁওতাল সমাজ দুই ভাইয়ের ঘোষণাকে সত্যি বলে ধরে নেয়।

সিধু ও কানুর ডাকে সাঁওতাল সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে শালগাছের ডাল নিয়ে ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন দশ হাজার সাঁওতাল ভাগনাডিহির মাঠে মিলিত হয়।

অস্ত্র হিসেবে হাতে ছিল বিষ মাখানো তীর,ধনুক, কুঠার। সিধু -কানুর নেতৃত্বে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে।

সাঁওতাল বিদ্রোহের প্রকৃতি : 

১) সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ভারতের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহ। তাঁরা তীর, ধনুক, কুঠার নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। 

২) সাঁওতাল বিদ্রোহ শুধুমাত্র সরল, স্বাধীনতা প্রিয় সাঁওতালদের ছিল না। এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিল সমাজের কামার, ছুতোর, কুমোর, তেলি এইরকম বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষেরা। ইংরেজ আমলা শেরউইল বর্ণনা দিয়েছেন যে, গোয়ালারা বিদ্রোহীদের তথ্য সরবরাহ করত।   

৩) এই বিদ্রোহ ছিল ভারতের এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের সশস্ত্র বিদ্রোহ। 

৪) শুধু ইংরেজরা নয় সুদখোর মহাজন, জমিদার, রেলের ঠিকাদার, নীলকরসাহেবদের শোষণের বিরুদ্ধে এক তীব্র কৃষক সংগ্রাম ছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। 

সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলাফল :

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সাঁওতাল বিদ্রোহের অবসান ঘটে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই বিদ্রোহের ফল ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। 

১) সাঁওতাল বিদ্রোহের ফলে সাঁওতালদের জন্য পৃথক সাঁওতাল পরগনা তৈরি হয়েছিল। আর এই সাঁওতাল পরগনায়  কোনো সরকারি হস্তক্ষেপ যাতে না করা হয় তার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল।  

২) সাঁওতালদের ওপর মহাজনী শোষণ যে মাত্রায় পৌঁছেছিল , এই বিদ্রোহের ফলে তা দমিত হয়। 

৩) সরকার চাপে পড়ে সাঁওতাল পরগনায় চড়া সুদের হার কমাতে বাধ্য হয়েছিল। 

৪) এই আন্দোলনের ফলে সাঁওতালরা ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে এক ঐক্যবদ্ধ লড়াই গড়ে তুলেছিল। বিশিষ্ট লেখক সুপ্রকাশ রায়ের মতে, ‘সাঁওতালদের এই বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তিমূলে আঘাত করেছিল ‘। 

৫) সাঁওতাল অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পথ প্রশস্ত হয়। 

মূল্যায়ন : 

১৮৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল ব্যাপক ও তীব্র বিদ্রোহ। অশিক্ষিত ও দরিদ্র সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ইংরেজ সরকারকে বিচলিত করতে সক্ষম হয়েছিল।

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “১৮৫৭ সালের বিদ্রোহকে যদি ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা হয়, তাহলে সাঁওতাল বিদ্রোহের সেই মর্যাদা পাওয়া উচিত।

আরও পড়ো : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তোমার ভালো লেগেছে। যদি তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি কমেন্ট করে আমাকে জানাতে পারো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। ভালো থেকো বন্ধু , আর ইতিহাস পড়তে থেকো।

 

   

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!