ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ আন্দোলন । Derozio and Young Bengal Movement in bengali

ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ আন্দোলন (Derozio and Young Bengal Movement)

কেমন আছো বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভালো আছো। তুমি রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর প্রমুখ সংস্কারকদের নাম আশা করি শুনেছ। হয়তো এঁদের সম্পর্কে পড়েও থাকবে। এঁদের পাশাপাশি ইতিহাসে আরও একজন সংস্কারক বেশ জনপ্রিয়। তাঁর নাম হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (Derozio)।

এবারের আলোচনা ডিরোজিও ও তাঁর নব্যবঙ্গ বা Young Bengal গোষ্ঠী কে নিয়ে। এর আগে রামমোহন রায় ও তাঁর সংস্কার সম্পর্কে পোস্ট করেছি চাইলে তুমি এই ওয়েবসাইটে পড়তে পারো। 

জন্ম ও শিক্ষা :

হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ডিরোজিও ছিলেন একজন ইউরেশিয়ান। চলতি ভাষায় যাঁদের ফিরিঙ্গি বলা হত। 

ধর্মে তিনি ছিলেন খ্রিস্টান। জাতিতে ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এবং মাতৃভাষা ছিল ইংরেজি। তবুও  ডিরোজিও ভারতবর্ষকে নিজের মাতৃভূমি রূপে গ্রহণ করেছিলেন। 

কলকাতার ধর্মতলা একাডেমিতে পড়ার সময় স্কটিশ শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। 

এই পরিচয় ডিরোজিওর মধ্যে চরমপন্থী-যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। 

ফরাসী বিপ্লবের আদর্শ দ্বারা তিনি অনুপ্রাণিত হন। এছাড়াও ভলতেয়ার, হিউম, লক, বেকন, টম পেইন প্রমুখ পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দার্শনিকদের প্রতি ডিরোজিও আকৃষ্ট হন। 

১৮২৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি হিন্দু কলেজের সাহিত্য ও ইতিহাসের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেছিলেন।

নব্যবঙ্গ কী ? : 

উনিশ শতকের প্রথম দিকে অধ্যাপক হেনরী লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর নেতৃত্বে ও পাশ্চাত্য দার্শনিকদের যুক্তিবাদের প্রভাবে একদল যুবসমাজকে নিয়ে যে প্রগতিশীল দল গড়ে উঠেছিল, তাই নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল নামে পরিচিত। এঁদের দ্বারা পরিচালিত আন্দোলনই নব্যবঙ্গ আন্দোলন বা ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্ট নামে পরিচিত। 

এই তরুণ যুবসমাজ সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। 

আরও পড়ুন : গৌতম বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম

নব্যবঙ্গের সদস্যগণ : 

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর তালিকায় যে উল্লেখযোগ্য সদস্যরা ছিলেন তাঁরা হলেন – কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জ্জী, মহেশচন্দ্র ঘোষ, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, রামগোপাল ঘোষ, রাধানাথ শিকদার, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, দক্ষিণারঞ্জন মুখার্জী,প্যারীচাঁদ মিত্র, শিবচন্দ্র দেব, হরচন্দ্র ঘোষ, কাশীপ্রসাদ ঘোষ, রামতনু লাহিড়ী।

যৌথভাবে এঁদের নব্যবঙ্গ নামে ডাকা হত। 

এঁরা প্রত্যেকেই হিন্দু কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ডিরোজিয়ান পন্থী নামেও এঁদেরকে অভিহিত করা হয়।

নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর লক্ষ্য : 

তৎকালীন হিন্দুসমাজ ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী চেয়েছিল এই গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের অবসান ঘটাতে। 

এর পরিবর্তে তাঁরা আনতে চেয়েছিল হিন্দু সমাজে আমূল পরিবর্তন।

তাঁদের লক্ষ্য ছিল জাতিভেদ, অস্পৃশ্যতা, মূর্তিপূজা ইত্যাদি দূর করে এক সহজ সরল সমাজ ও ধর্ম গড়ে তোলা। 

স্ত্রী শিক্ষা, নারী স্বাধীনতা, সতীদাহ প্রথার অবসান ইত্যাদির মাধ্যমে নারী জাতির সংস্কার সাধন করাও ছিল নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর লক্ষ্য। 

ডিরোজিও তাঁর ছাত্রদের শেখাতেন যে, “সবসময় সত্যের জন্য বাঁচবে ও মরবে। সদগুণকে গ্রহণ করবে। সমস্ত দুর্নীতি থেকে দূরে থাকবে”। 

ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর কার্যকলাপ কেমন ছিল ? :

ডিরোজিওর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর ছাত্ররা হিন্দু সমাজ ব্যবস্থাকে তীব্র আক্রমণ করেছিল। ডিরোজিয়ানরা পুরোহিতদের চোর, ভন্ড, মূর্খ বলে আক্রমণ করতেন। 

ডিরোজিওর এক অনুগামী মাধবচন্দ্র বলেছিলেন, ‘তিনি হিন্দুধর্মকে ঘৃণার চোখে দেখেন’। 

অন্য এক ডিরোজিয়ান কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জ্জীর মতে, ‘সংস্কার ও উদারপন্থা এক ছাদের নীচে থাকতে পারে না , তাদের মধ্যে সংঘাত ঘটবেই’। 

নব্যবঙ্গদের এই ক্ষোভ সেসময়কার হিন্দু সমাজ ও হিন্দু ধর্মের প্রতি বিদ্রোহ করতে প্রেরণা জুগিয়েছিল। 

১৮৩০ সালের ১০ ই ডিসেম্বর নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীরা কলকাতার টাউন হলে ফ্রান্সের জুলাই বিপ্লবের বিজয় উৎসব পালন করেছিল। এমনকি কলকাতার মনুমেন্টের চূড়ায় ফরাসী বিপ্লবের পতাকাও পর্যন্ত উড়িয়েছিল। 

এইসব করার পিছনে কারণ ছিল ফরাসী বিপ্লবের দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা। যা তাঁদের সমাজের কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করেছিল।

আকাডেমিক এসোসিয়েশন :

১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিও তাঁর অনুগামীদের নিয়ে আকাডেমিক এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সমিতির সভাপতি ছিলেন ডিরোজিও নিজেই। আর সম্পাদক হয়েছিলেন উমাচরণ বসু।

বিভিন্ন বিষয়ের বিতর্ক  নিয়ে এই সভা বসত। এখানে ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীদের আলোচনার বিষয় ছিল সত্যের স্বরূপ, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা, দেশপ্রেমের মহত্ব, পুরোহিত শ্রেণীর মিথ্যাচার, সদগুণের অনুশীলন ইত্যাদি। 

বিতর্কের মূল লক্ষ্য ছিল সেইসময়ের হিন্দুধর্মের গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার স্বরূপ উদ্ঘাটন করা। 

এই বিতর্ক গুলিতে ডিরোজিওর অনুগামীরা ছাড়াও ডেভিড হেয়ার, কর্নেল বিটসন, বেনসন, প্রমুখ ইংরেজ সুধীরা নিয়মিত আসতেন। 

পত্রপত্রিকা : 

ডিরোজিওর ছাত্ররা ১৮৩০ সালে ‘পার্থেনন ‘ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পার্থেনন পত্রিকায় ডিরোজিয়ানরা গ্রিসের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনে ও বিভিন্ন হিন্দু কুপ্রথার বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। 

কৃষ্ণমোহন ব্যানার্জ্জী তাঁর ‘ দ্য পার্সিকিউটেড ‘ নাটকের মাধ্যমে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি গুলি তুলে ধরেছিলেন। 

এছাড়াও ডিরোজিও নিজে ‘ হেসপেরাস ‘ , ‘ ক্যালকাটা লিটেরারি গেজেট ‘ , ‘ ক্যালেইডোস্কোপ ‘ পত্রিকাগুলির সম্পাদনা করতেন। 

ডিরোজিয়ানরা ‘ এনকোয়েরার ‘ , ‘ জ্ঞানান্বেষণ ‘ ইত্যাদি পত্রিকার মাধ্যমে নব্যবঙ্গ বা ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনকে জারী রেখেছিলেন। 

ডিরোজিও দেশাত্ম বোধক কবিতাও লিখেছিলেন। সেগুলি হল ‘ টু ইন্ডিয়া মাই নেটিভ ল্যান্ড ‘ , ‘ দ্য ফকির অফ জাঙ্গিরা ‘।

নব্যবঙ্গ আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা :

নব্যবঙ্গ আন্দোলন হিন্দু সমাজের কুসংস্কার ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেও এর কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। 

১) নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী সমাজে কুসংস্কার, জাতিভেদ প্রভৃতির বিরুদ্ধে আলোড়ন তৈরি করলেও, তাঁদের প্রভাব সমাজের গভীরে প্রবেশ করাতে ব্যর্থ হয়েছিল। 

২) এই গোষ্ঠীর সদস্যরা ছিলেন তখনকার বাঙালি উচ্চশ্রেণীর সন্তান। তাঁরা নিজেদের কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সংস্কারগুলিকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেননি। 

৩) নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীর আন্দোলন ছিল কলকাতার শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী কেন্দ্রিক। ফলে গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি।  

৪) ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে কলেরায় ডিরোজিওর মৃত্যু ঘটলে নব্যবঙ্গ গোষ্ঠীরা তাঁদের আন্দোলন থেকে চ্যুত হয়। এবং তাঁরা পৃথক পৃথক পথ বেছে নেয়। জীবিকা অর্জনের জন্য বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করে। 

৫) নব্যবঙ্গীয়রা উৎসাহের বশে হিন্দুধর্মকে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন। যেমন, গঙ্গাজলের পবিত্রতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ ইত্যাদি কাজ সাধারণ হিন্দুদের ব্যথিত করে। ফলে আন্দোলন গতি হারায়।  

পরিশেষে : 

এতকিছু সত্ত্বেও সামাজিক কুসংস্কার -এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম, শিক্ষার প্রসার, যুক্তিবোধের বিকাশ ঘটানো প্রভৃতি কাজে নব্যবঙ্গীয়দের অবদান ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ও থাকবে। দেশের প্রতি ডিরোজিও ও তাঁর অনুগামীদের ভালবাসা এবং দেশকে গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা বাঙালিকে দেশপ্রেমে উদবুদ্ধ করে তুলেছিল। বিশিষ্ট নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন যে, ” এঁরাই বাংলায় আমাদের জাতির পিতা, এঁদের গুণাবলী আমাদের কাছে স্মরণীয় “।

আরও পড়ুন : হরপ্পার নগর পরিকল্পনা  

আশা করি বন্ধু পোস্টটি পড়ে তোমার ভাল লেগেছে। তবুও তোমার কোন মতামত থাকলে তুমি কমেন্ট করে আমাকে জানাতে পারো। ভালো থেকো বন্ধু , আর ইতিহাস পড়তে থেকো  “।  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!