ফরাজি আন্দোলন । Faraizi Movement in bengali

ফরাজি আন্দোলন (Faraizi Movement) 

কেমন আছ বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভাল আছ। এবারে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব তা হল ফরাজি আন্দোলন। যদি ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন সম্পর্কে না পড়ে থাকো তাহলে এই পোস্টটি অবশ্যই পড়ে  নিও। 

এর আগের পোস্টে ডিরোজিও ও নব্যবঙ্গ আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেছি। পারলে সেটি একবার পড়ে নিও। আশা করি এই পোস্টটিও তোমার ভাল লাগবে।  

তাহলে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। 

ফরাজি কথার অর্থ :

বন্ধু এই পোস্টটি পড়বার শুরুতেই তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে  পারে যে , ফরাজি কথার অর্থ কী ? ফরাজি কথাটির উৎপত্তি হয়েছে আরবী শব্দ ‘ ফর্জ ‘ থেকে। যার অর্থ হল আল্লার আদেশ বা ইসলাম নির্দিষ্ট কর্তব্য বাংলাদেশে ফরাজি আন্দোলনের প্রবর্তক ছিলেন হাজী শরিয়ৎউল্লাহ। শরিয়ৎউল্লাহ বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অল্প বয়সে হজ করার জন্য মক্কায় যান। ১৮২০ সালে সেখান থেকে দেশে ফিরে ফরাজি নামক একটি মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। 

ফরাজি আন্দোলনের স্থান :

ফরাজি আন্দোলন প্রথমে পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে শুরু হয়েছিল। পরে তা পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ, বাখরগঞ্জ, যশোর, বগুড়া ইত্যাদি জেলাগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এইসমস্ত জেলাগুলির দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে এই আন্দোলন জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। 

ফরাজি মতাদর্শ :

ফরাজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হাজী শরিয়ৎউল্লাহ। ১৮২০ সালে মক্কা থেকে হজ করে দেশে ফেরার পর ইসলামের আদর্শ সম্পর্কে মুসলিমদের কাছে প্রচার করতে থাকেন। 

তিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষকে দার-উল-হারব বা বিধর্মীদের দেশ বলে ঘোষণা করেছিলেন। 

শরিয়ৎউল্লাহ তাঁর অনুগামী মুসলিমদের মধ্যে কিছু মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন ফরাজিরা এই বিধর্মীদের দেশে শুক্রবার নামাজ পড়বে না। এমনকি হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব-অনুষ্ঠানকেও বর্জন করে চলবে। মুসলিমদেরকে অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করার আবেদন জানিয়েছিলেন।

ফরাজি আন্দোলনের নেতাবৃন্দ :

১৮৫০ সালের ১ লা জানুয়ারি শরিয়ৎউল্লাহ -র মৃত্যু ঘটলে তাঁর পুত্র দুদু মিঞা ফরাজি আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। দুদু মিঞার আসল নাম ছিল মহম্মদ মহসিন আহম্মদ। দুদু মিঞা বলতেন যে, ” জমি ভগবানের দান, এতে জমিদারের ব্যক্তিগত মালিকানা ভগবানের বিধান বিরোধী। ”  

দুদু মিঞা তাঁর অনুগামী কৃষকভাইদের জমিদারি খাজনা ও নীলচাষ করতে বাধ্য না হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার বাহাদুরপুর গ্রামে দুদু মিঞা মারা গিয়েছিলেন। এরপর এই আন্দোলনের হাল ধরেছিলেন তাঁর পুত্র নোয়া মিঞা। তিনি ১৮৮০ র দশক পর্যন্ত জমিদার বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ পরিচালনা করেছিলেন। 

সুপ্রকাশ রায়ের মতে, ‘ দুদু মিঞার মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুদু মিঞা ও ফরাজি মতবাদের প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল। ‘

আরও পড়ো : https://iitihas.com/historian-abdul-hamid-lahori-in-bengali/

আরও পড়ো  : https://iitihas.com/religious-life-of-rig-vedic-aryans-in-bengali/

ফরাজি আন্দোলনের কারণ ও তীব্রতা :

ফরাজি আন্দোলনের কারণ হল দরিদ্র কৃষকদের ওপর হিন্দু জমিদার ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার। অতিরিক্ত হারে খাজনা আদায়, জোর করে জমি কেড়ে নেওয়া ও জোর করে নীলচাষ করানোর জন্যই এই অত্যাচার করা হত। এই আন্দোলন পরে তীব্র রূপ নিয়েছিল। ফরিদপুর অঞ্চলের ইংরেজ নীলকর ডানলপ ফরাজিদের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদের বাড়ি-ঘর লুঠ ও ধ্বংস করেছিলেন। 

ফরাজিরা এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ডানলপের নীল কুঠিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। এমনকি নীলকুঠির গোমস্তা কালি কাঞ্জিলালকে হত্যা পর্যন্ত করেছিল।  

ফরাজি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ :

১) ফরাজি আন্দোলনের নেতাদের রাজনৈতিক চেতনার অভাব ছিল। সেইসাথে সংগ্রামের সঠিক লক্ষ্য না থাকার কারণে আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল। 

২) দুদু মিঞার দীর্ঘ কারাবাসের ফলে আন্দোলন নেতৃত্বর অভাবে ভুগছিল। ফরাজিরা দুদু মিঞার মতো যোগ্য নেতা গড়ে তুলতে পারেনি। 

৩) ফরাজি অনুগামীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল দরিদ্র কৃষক শ্রেণীর মানুষ। কাজেই তাঁদের অর্থের জোর ছিল না। তাই তাঁদের পক্ষে দীর্ঘসময় ধরে এই আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। 

৪) ফরাজি আন্দোলন মূলত সীমাবদ্ধ ছিল কৃষক শ্রেণীর মানুষদের মধ্যেই। সেকারণে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের ব্যাপক সমর্থন পায়নি। তাই এই আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।  

উপসংহার :

ফরাজিরা একটি মুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু তাঁদের ধর্মীয় চেতনাতে প্রভাবিত হয়েই দরিদ্র কৃষকরা জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। পরে এই আন্দোলন দমন হয়েছিল ঠিকই , কিন্তু ইতিহাসে ফরাজি আন্দোলন আজও উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। 

“আশা করি বন্ধু পোস্টটি পড়ে তোমার ভাল লেগেছে। তবুও তোমার কোন মতামত থাকলে তুমি কমেন্ট করে আমাকে জানাতে পারো। ভালো থেকো বন্ধু , আর ইতিহাস পড়তে থেকো  । “

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!