ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্ব (Reign of Terror in France)
কেমন আছ বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভাল আছ। আগের পোস্টগুলিতে ফরাসি বিপ্লবের কারণ গুলি নিয়ে আলোচনা করেছি।
আশা করি তুমি তা পড়েছ। আর যদি পড়ে না থাকো তাহলে অবশ্যই পড়ে নিও।
এবারের পোস্টে আলোচনা করব ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্ব নিয়ে।
আশা করি এই পোস্টটি তোমার ভাল লাগবে। তাই পুরোটা পড়বার জন্যে তোমাকে অনুরোধ করছি।
সন্ত্রাসের রাজত্ব কী ? :
১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। এরপর ভোটদানের মাধ্যমে জাতীয় মহাসভা (National Convention) গঠিত হয়।
জাতীয় মহাসভা ফ্রান্স কে প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করে।
জাতীয় মহাসভাতে তিনটি দল ছিল – জিরোন্ডিস্ট, জ্যাকোবিন ও মডারেট।
জিরোন্ডিস্ট বা নরমপন্থীদের পতন ঘটলে জ্যাকোবিন বা উগ্র বিপ্লববাদী দলের রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
জ্যাকোবিনরা সীমান্তের শত্রুসেনা ও দেশের ভেতরের প্রতিবিপ্লবী বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়।
তখন তাঁরা প্রজাতন্ত্রকে রক্ষার শপথ নেন। এবং এক জরুরী শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এরই নাম হল সন্ত্রাসের রাজত্ব (Reign of Terror)।
সময়কাল :
ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে সন্ত্রাসের রাজত্ব ছিল এক ভয়াবহ অধ্যায়।
এর সময়কাল ছিল ২রা জুন, ১৭৯৩ – ২৭শে জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।
ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্বের নায়ক ছিলেন জ্যাকোবিন দলের নেতা রোবসপিয়ার।
সন্ত্রাসের শাসন প্রবর্তনের কারণ :
বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও রাজতন্ত্রের সমর্থকদের বিরোধিতা ফ্রান্সে অচলাবস্থার সৃষ্টি করে। ঐক্য ও সংহতি ঠিক রাখার জন্যে এক নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
জিরোন্ডিস্ট দলের পতনে লায়নস, মারশাই, বোর্দো প্রভৃতি শহরগুলিতে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ধর্মীয় বিবাদ।
ফ্রান্সের কৃষক ও যাজকগণ ‘ Civil Constitution of the Clergy ‘ নামে এই বিধির বিরুদ্ধে এবং ১৭ তম লুইয়ের সমর্থনে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
এইভাবে এক প্রবল প্রতিবিপ্লব গড়ে ওঠে।
দেশের ভিতরের এই গোলযোগ ও বহিঃশত্রুর আক্রমণ মোকাবিলার জন্য জ্যাকোবিন দল সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করে।
সন্ত্রাসের আদর্শ :
মানুষকে হত্যা করা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে চারিদিকে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করাই ছিল সন্ত্রাসবাদীদের একমাত্র লক্ষ্য।
তাঁরা প্রচার করত যে, ত্রাস বা ভয়ের মাধ্যমেই দ্রুত ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব।
ত্রাসই হল পুণ্যের পথ।
তাঁরা এটাও মনে করতেন যে, নির্মমতা ও কঠোরতাই হল সরকারের প্রতি জনগণের আনুগত্য লাভের একমাত্র পথ।
তাই তাঁদের আদর্শই ছিল বিপ্লব বিরোধী সমালোচকদের নির্মম ভাবে শাস্তি দেওয়া।
সন্ত্রাসের আইনব্যবস্থা :
ফ্রান্সের জাতীয় সম্মেলন বা মহাসভাই ছিল দেশের সার্বভৌম প্রতিনিধি সভা।
কিন্তু জাতীয় সম্মেলনে জ্যাকোবিন নেতাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়ায় জাতীয় সম্মেলন কয়েকটি আইন পাশ করে।
এই আইনগুলি ছিল, যেমন – সর্বোচ্চ মূল্যের আইন, বাধ্যতামূলক হিসেবে সেনাদলে যোগ দেওয়ার আইন, সন্দেহের আইন।
সন্দেহের আইন অনুযায়ী কোন ব্যক্তি গ্রেপ্তার হলে তাঁর জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা ছিল।
সন্দেহ জনক বিপ্লবীদের দমনের জন্য বিপ্লবী বিচারসভা গঠন করা হয়।
এই বিচারসভার সাহায্যে দ্রুত দণ্ড দেওয়া হত। অপরাধ যাচাই না করেই মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করা হত।
আরও পড়ো : ফরাসী বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা
সন্ত্রাসের কার্যকলাপ :
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে সন্ত্রাসের কার্যকলাপ বাড়তে থাকে। এর সাথে ভয়ঙ্করতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। কঠোর শাস্তির ভয়ে সাধারণ মানুষ সেনাদলে যোগ দিয়েছিল।
দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া মানুষদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল।
জিরোন্ডিস্ট, রাজতন্ত্রের সমর্থনকারীদের গিলোটিনে হত্যা করা হয়।
জাতীয় সম্মেলনে পাশ হওয়া আইন গুলিকে জ্যাকোবিনরা কঠোর ভাবে প্রয়োগ করতে শুরু করে।
রাণী মারিয়া এন্টোনেট, মাদাম রোলাঁ, ডিউক অফ অর্লিয়েন্স প্রমুখ ব্যক্তিদের গিলোটিন নামক যন্ত্রে মারা হয়েছিল।
জিরোন্ডিস্টদের প্রধান নেতা ভার্গানিয়াও এবং ব্রিসো-কে গিলোটিনে ফেলে হত্যা করা হয়।
এমনকি গিলোটিনের হাত থেকে রেহাই পায়নি রাজপরিবারের শিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষরা।
বলা হয় যে, ফ্রান্সের লয়ার নদীর জল মৃতদেহের দ্বারা দূষিত হয়ে গিয়েছিল।
অবশেষে রোবসপিয়ার-এর মৃত্যুতে সন্ত্রাসের রাজত্বের অবসান ঘটে ২৭শে জুলাই, ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে। সন্ত্রাসের রাজত্বে প্রায় ৪০,০০০ মানুষকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়েছিল।
গিলোটিন যন্ত্র :
গিলোটিন যন্ত্রের আবিষ্কারক ছিলেন একজন ফরাসি চিকিৎসক। সেই চিকিৎসকের নাম ছিল ডঃ গিলোটিন।
তাই তাঁর নাম অনুসারে যন্ত্রটির নাম গিলোটিন হয়েছিল।
যন্ত্রটি হল দুটো কাঠের মাঝখানে ঝুলন্ত ভারী লোহার কাটারি।
এই যন্ত্রটি দিয়ে এর নীচে শুয়ে থাকা মানুষের মুণ্ডচ্ছেদ করা হত। সন্ত্রাসের রাজত্বে প্রায় ৪০,০০০ মানুষকে এই গিলোটিন যন্ত্রে মারা হয়েছিল।
সন্ত্রাসের রাজত্বের প্রকৃতি :
১) সেইসময় ফ্রান্সের সংকট ও গোলযোগের সময় সন্ত্রাসের প্রয়োজনীয়তা ছিল ঠিকই। কিন্তু সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে অহেতুক বাড়াবাড়ি করা হয়েছিল।
২) রোবসপিয়ার তাঁর একনায়কতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখবার জন্যই ফ্রান্সে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিলেন।
৩) বিনা বিচারে বহু লোককে অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়। বহু নির্দোষ মানুষ সন্ত্রাসের বলি হয়েছিল।
৪) মাদাম রোলাঁ, ড্যান্টন এর মত বিপ্লবীরাও সন্ত্রাসের কবলে পড়ে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। তাই ম্যাডাম রোলাঁ বলেছিলেন, ” হায় স্বাধীনতা তোমার নাম নিয়ে কত অনাচারই না করা হচ্ছে “।
৫) জন নিরাপত্তা সমিতি শেষ পর্যন্ত রোবসপিয়ারের একনায়কতন্ত্রের অধীনে চলে এসেছিল। যা গণতন্ত্র ও সংবিধান সম্মত ছিল না।
সন্ত্রাসের পক্ষে যুক্তি :
সন্ত্রাসের রাজত্বের সমর্থনে ঐতিহাসিকরা কিছু যুক্তি দেখিয়েছেন। এই ঐতিহাসিকরা ছিলেন ওলার, রাইকার, লেফেভার, মিশেল প্রমুখরা।
১) ওলারের মতে , ফ্রান্সের ভিতরে ও বাইরে যে সংকট ঘনিয়েছিল তা সন্ত্রাস ছাড়া সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না।
২) রাইকারের মতে, ‘ সন্ত্রাস বিপ্লবকে রক্ষা করে ‘।
৩) রুশো বলেছিলেন বিপর্যস্ত সমাজ স্বাধীনতার থেকে দূরে থাকলে তা চাপিয়ে দেওয়া উচিত। সন্ত্রাস সেই চেষ্টাই করেছিল।
৪) লেফেভারের মতে, ফরাসি বিপ্লবের অর্থনেতিক ও সামাজিক আদর্শ সন্ত্রাসের সাহায্যেই বিস্তার লাভ করেছিল।
৫) মাতিয়ে বলেছেন সমাজে বিপ্লবের শিকড় প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু ঐতিহাসিক ট্যালমন, ডেভিড থমসন, তেইন, লুই ব্লা প্রমুখরা সন্ত্রাসের বিপক্ষেই কথা বলেছেন। ঐতিহাসিক লুই ব্লা বলেছেন যে, ” সন্ত্রাস ফ্রান্সকে বাঁচায়নি , সন্ত্রাস বিপ্লবকে পঙ্গু করে দেয় “।
উপসংহার :
ফ্রান্স যখন বৈদেশিক আক্রমণ ও প্রতিবিপ্লবের আগুনে জ্বলছিল ঠিক সেইসময় সন্ত্রাসের উদ্ভব হয়।
সন্ত্রাস এগুলিকে রুখে পরিবর্তন নিয়ে আসে।
কিন্তু পাশাপাশি সন্ত্রাসের সময় যতটা রক্তপাত হয়েছিল সেই রক্তপাতের ততটা দরকার ছিল না। তাই সন্ত্রাসের ফলে বিপ্লব তার গরিমা হারিয়েছিল।
আরও পড়ো : ইতিহাসে আবুল ফজল
” আশা করি পোস্টটি পড়ে তোমার ভালো লেগেছে। যদি তোমার কোন মতামত থাকে তাহলে তুমি কমেন্ট করে আমাকে জানাতে পারো। তোমার মতামত আমাকে নতুন কিছু লিখতে উৎসাহ জোগাবে। ভালো থেকো বন্ধু , আর ইতিহাস পড়তে থেকো “।
এই লেখাটি আমাকে খুবই উপকৃত করেছে , আমি বাড়িতে শিক্ষক ছাড়াই পড়ি আপনার দ্বারা খুবই উপকৃত হয়েছি।
অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। তোমার উপযোগী কি ধরণের পোস্ট দরকার কমেন্ট করে আমাকে জানিও। আমি চেষ্টা করব সেই পোস্ট গুলি লিখতে। খুব ভালো থেকো… আর এইভাবেই iitihas.com এর পাশে থেকো। আর অন্যদের সাথে অবশ্যই শেয়ার কোরো।
আমার ফরাসি বিপ্লব, ইউরোপে ঐক্য ও অনৈক যুগ 1815 , ইতিহাস চর্চা , মোগল যুগের পতনের বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজ্য উত্থান এই সমস্ত ক্ষেত্রের বড় প্রশ্ন দিলে উপকৃত হব আর এতে আপনার iitihas. Com ও সমৃদ্ধ হবে আশা রাখি
তুমি আমার website এর যে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী এটা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। আবারও ধন্যবাদ তোমাকে পোস্ট পড়বার জন্য। আমি চেষ্টা করবো যাতে যত তাড়াতাড়ি পোস্টগুলি আপলোড করা যায়। ফরাসি বিপ্লব সম্পর্কে পোস্ট রয়েছে, হয়তো তোমার কাজে আসতে পারে। খুব ভালো থেকো।
আপনার এই তথ্যটি আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আপনি এই ভাবে তথ্য দিতে থাকুন। ধন্যবাদ 🙏