নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ( Nalanda University )
আজকাল আমরা ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করি।
কেউ পড়ি বাংলা , কেউ ইংরাজী , কেউ ইতিহাস , আবার কেউবা বিজ্ঞান বা আরো অন্য বিষয়।
আচ্ছা যদি প্রশ্ন করা হয় , ভারতের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি ? হ্যাঁ অবশ্যই এর উত্তর হবে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ( Nalanda University )।
এটি প্রাচীন ভারতের একটি বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জগৎজোড়া নাম হলেও অন্য বিভিন্ন বিষয় এখানে পড়ানো হোতো।
উৎকৃষ্ট মানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী দুই মিলে যেন পরিপূর্ণ ছিল এটি। যত দিন যেতে লাগলো নালন্দা তত যেন খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিল। অবশ্যই মহাযান বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্র হিসেবে।
এই পোস্টে আলোচনা করবো নালন্দা-কে নিয়ে। জানবো বৌদ্ধ মঠ থেকে কিভাবে নালন্দা হয়ে উঠলো বিখ্যাত এক বিশ্ববিদ্যালয়।
তাই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস জানতে হলে এই পুরো পোস্টটি তোমাকে পড়তে হবে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা
আনুমানিক ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে গুপ্তসম্রাট কুমারগুপ্ত নালন্দায় কিছু মন্দির ও বিহার তৈরী করেছিলেন।
কিন্তু কে জানতো এই নালন্দাই একদিন হয়ে উঠবে বিদ্যাচর্চার এক প্রধান কেন্দ্র।
কিন্তু ঐতিহাসিক খননকার্য থেকে জানা যায় যে , নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গুপ্তসম্রাট কুমারগুপ্ত।
নালন্দা শব্দের অর্থ
তুমি হয়তো জানোনা যে , নালন্দা শব্দটির একটি আলাদা অর্থ রয়েছে। এই নালন্দা শব্দটির অর্থ হোলো , যেখানে অবিরত জ্ঞান দান করা হয়। সত্যিই নালন্দা নামকরণটি যেন স্বার্থক।
জৈন ও বৌদ্ধদের কাছে নালন্দা
জৈন ও বৌদ্ধ উভয়ের কাছেই নালন্দা এক পবিত্র স্থান। স্বয়ং জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর এই নালন্দাতেই চৌদ্দটি বর্ষাকাল কাটিয়েছেন।
রাজগৃহ বা বর্তমান রাজগীর থেকে নালন্দার দূরত্ব প্রায় ১১ কিলোমিটার। প্রাচীনকালে নালন্দা এতটাই মনোরম ছিল যে , এর টানে স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ অনেক বার এখানে এসেছেন।
বুদ্ধদেবের এক প্রধান শিষ্য ছিলেন , নাম তাঁর সারিপুত্ত। এই সারিপুত্ত নালন্দাতেই জন্মান ও এখানেই মারা যান।
আরও পড়ুন : ফা – হিয়েন কে ছিলেন
সেইসময় সম্রাট অশোক সারিপুত্তের স্মৃতিতে এখানে একটি মঠ নির্মাণ করেছিলেন। সময়ের সাথে সাথে এই মঠটিকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল মহাবিহার। বৌদ্ধ মহাবিহার।
তাই অন্যদিক দিয়ে ভেবে দেখলে দেখা যায় যে , সম্রাট অশোকই ছিলেন নালন্দার আসল প্রতিষ্ঠাতা।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিল রাজগৃহ ( বর্তমান রাজগীর ) -তে। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান কেন্দ্র ছিল এটি। তবে মহাযান মত ছাড়া হীনযান মতের শাস্ত্রগুলিও পড়ানো হোতো এখানে।
এক অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার ছিল বিশ্ববিদ্যালয়টি। হেতুবিদ্যা ( ন্যায়শাস্ত্র ) , তন্ত্রশাস্ত্র , অথর্ববেদ , দর্শন , ব্যাকরণ , চিকিৎসাবিদ্যা , বৌদ্ধ শাস্ত্র , স্থাপত্য বিদ্যা , শিল্পকলা বিদ্যা প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের এখানে পড়ানো হোতো।
শিক্ষার মান এতটাই উন্নত ছিল যে , জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা বিপদসংকুল পথ পেরিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতেন।
শিক্ষকের কাজ শিক্ষাদান করা। তাঁর শিক্ষায় প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে উঠবে শিক্ষার্থীরা।
নালন্দার জগৎজোড়া খ্যাতির পিছনে প্রধান অবদান ছিল শিক্ষকদের। শিক্ষকদের ব্যবহার ও কথাবার্তা ছিল নম্র , ভদ্র এবং মিষ্টভাষী।
তাঁদের তৈরী নিয়মকানুন যথেষ্ট কঠোর ছিল। ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে চলতো।
নাগার্জুন , আর্যদেব , বাসুবন্ধু , শীলভদ্র , ইন্দ্রগুপ্ত প্রমূখরা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। নাগার্জুন ছিলেন একজন মহাযান দার্শনিক ও নালন্দার আচার্য।
ব্রাহ্মণ পন্ডিত শীলভদ্র নালন্দার অধ্যক্ষ ছিলেন।
চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং প্রথমে নালন্দায় আসেন শিক্ষার্থী হয়ে। পরে তিনি নালন্দার আচার্য হয়েছিলেন।
নালন্দার স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় দেখতে বড়োই সুন্দর। এর গঠনশৈলী প্রত্যেকের নজর কাড়বেই। নালন্দার গেট দিয়ে ঢুকে খানিকটা এগোলে প্রথমেই আসল মঠটি চোখে পড়বে।
দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। যদিও এখন অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
প্রথম মন্দিরটি এখনো মাটির নীচে। সেটির উপর সাতবার মঠ বা মন্দির তৈরী করা হয়েছে।
বর্তমানে বেড়াতে গিয়ে নালন্দার সপ্তম নিৰ্মাণটি আমাদের চোখে পড়ে। এছাড়াও রয়েছে ঢিবির মতো দেখতে স্তূপ। এই স্তূপগুলি বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের স্মৃতিতে তৈরী করা।
মঠ মন্দিরগুলো তৈরিতে ঢালাইয়ের ব্যবহার করা হয়েছিল। তুমি হয়তো ভাবছো ঢালাই তো সিমেন্ট ও লোহা দিয়ে হয়।
কিন্তু না , সেইসময় সিমেন্ট ও লোহা পাওয়া যাবে কোথায়। তাই শিল্পীরা পাথর , চুন , সুরকি দিয়ে মজবুত ঢালাই তৈরী করেছিলেন।
আছে দেওয়াল ঘেরা ছোটো ছোটো কুঠুরি।
এগুলি ছিল ছাত্রদের থাকার জায়গা। ছিল পাথরের তৈরী মঞ্চ ও বড়ো উঠোন।
এখানে বসে শিক্ষাদান করা হতো। এছাড়াও ছিল জলের কুয়ো।
চৌদ্দটি মন্দির খননকার্যের ফলে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রতিটি মন্দিরের উঠোনে বুদ্ধের বিশাল মূর্তি থাকতো। শিক্ষার্থীরা বুদ্ধদেবকে প্রণাম করে তাঁদের দিন শুরু করতো।
মঠগুলিতে উনানের ব্যবস্থা করা ছিল। প্রতিদিনের রান্নাবান্না এখানে করা হতো।
নালন্দায় খোঁড়াখুঁড়ির সময় বুদ্ধ , বিষ্ণু , অবলোকিতেশ্বর প্রভৃতি মূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তিগুলির কারুকার্য দেখার মতো।
নালন্দার ভাস্কর্য শিল্পীরা পাথর ও ব্রোঞ্জমূর্তি বানানোতে পারদর্শী ছিলেন। বর্তমানে মিউজিয়ামে মূর্তিগুলি দেখে অবাক হতে হয়।
রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতিতে সামিল হয়েছিলেন বিভিন্ন রাজারা। বলা হয় যে , গুপ্ত যুগ ছিল স্বর্ণযুগ। গুপ্ত যুগেই নালন্দা খ্যাতির শিখরে পৌঁছেছিল।
গুপ্ত যুগ একদিন শেষ হয়। পরবর্তীকালে রাজা হর্ষবর্ধন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
হর্ষবর্ধনের উদ্যোগে ছাত্র ও শিক্ষকদের খাওয়ার হিসেবে চাল , ডাল , সব্জি , মাখন , দুধ বিনামূল্যে দেওয়া হতো।
যাতে তাঁদের ভিক্ষা করতে না বেরোতে হয়। এমনকি সকল ছাত্রদের পড়াশোনার ভারও রাজারাই বহন করতেন।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কারণ
প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যগুলি সবসময়ই ধ্বংসের মুখোমুখি হয়েছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ও কিন্তু ধ্বংসের তালিকা থেকে বাদ যায়নি।
ইতিহাস এই ঘটনার সাক্ষী। সময়টা ১২০০ খ্রিস্টাব্দ। মুসলমান শাসক মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি মগধ জয় করলেন।
সেইসাথে ধ্বংস করলেন নালন্দাকে। বখতিয়ার খিলজির সৈন্যরা লুঠপাট চালালো গোটা নালন্দায়। তুমি কি জানো যে , নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বড়ো গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরী ছিল।
খিলজির সৈন্যরা সেই লাইব্রেরীর মূল্যবান পুঁথি , বইগুলি আগুনে জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়।
নালন্দার মঠ , মন্দির , ছাত্রদের থাকার জায়গা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিল। খিলজি চলে যাওয়ার পর নালন্দায় আবার নতুন করে পড়াশোনা শুরু হয়।
কিন্তু আবার ১২৩৫ সালে মুসলমান আক্রমণ ঘটে নালন্দায়। এই আক্রমণে নালন্দার অবশিষ্ট অংশটুকুও ধ্বংস হয়ে যায়।
ঐতিহ্যবাহী নালন্দা হারিয়ে গেলো যেন কোথায়। ঠাঁই হোলো ইতিহাসের পাতায়। তাই নালন্দা ধ্বংসের কারণ হোলো বখতিয়ার খিলজির আক্রমণ।
আরও পড়ুন : ভারতীয় রাজ নর্তকীদের ইতিহাস
আশা করি এই পোস্টটি পড়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি এবিষয়ে তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি অন্যদের সাথে Share কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে।