মৌর্য যুগের শিল্পকলা (The Maurya Art)
নমস্কার বন্ধু কেমন আছো, আশা করি নিশ্চই ভালো আছো। বন্ধু তুমি কোনো ঐতিহাসিক স্থানে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার প্রাচীন কোনো মন্দির বা গুহার গঠন ও তার সুন্দর কারুকার্য নিশ্চয় দেখে থাকবে।
এইগুলোকেই বলা হয় শিল্পকলা। যেকোনো শিল্পকলা মানুষের দ্বারাই সৃষ্টি হয়।
এবারের আলোচনার বিষয় মৌর্য যুগের শিল্পকলা। তাই মৌর্য যুগের শিল্পকলা সম্বন্ধে জানতে হলে এই পোস্টটি তোমাকে অবশ্যই পড়তে হবে।
আশা রাখি তুমি পড়ে উপকৃত হবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট মনসবদারি প্রথা সম্পর্কে জানতে হলে লিঙ্কে ক্লিক করে তুমি পড়তে পারো।
মৌর্য যুগের স্থাপত্য
শিল্পসমৃদ্ধ রাজপ্রাসাদ :
মৌর্য শিল্পকলার সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই চন্দ্রগুপ্ত নির্মিত পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদের কথা বলতে হয়।
সুন্দর ভাবে সাজানো ও কারুকার্যমন্ডিত রাজপ্রাসাদটি সেযুগের প্রত্যেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গ্রীকদূত মেগাস্থিনিস সেসময় ভারতে ছিলেন।
তিনি এই রাজপ্রাসাদটির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় রাজপ্রাসাদটি কাঠের তৈরি ছিল। প্রাসাদটির থামগুলিতে খোদাই করা ছিল সোনা ও রুপার কারুকাজ করা পাখি, লতাপাতার নকশা।
চারদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা প্রাসাদটিতে ছিল মোট ৬৪ টি দরজা এবং ৫৭০ টি তোরণ বা প্রবেশপথ।
মেগাস্থিনিস তাঁর ‘ইন্ডিকা ‘ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ভারতের অধিবাসীরা শিল্পে খুবই দক্ষ ছিলেন ‘।
বর্তমানে পাটনায় রাজপ্রাসাদটির কাঠের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে।
স্থাপত্যে পাথরের ব্যবহার :
চন্দ্রগুপ্তের আমলে রাজপ্রাসাদ তৈরিতে কাঠের ব্যবহার করা হলেও অশোকের আমলে তার বদল ঘটে।
অশোকের আমলে কাঠের পরিবর্তে পাথরের ব্যবহার করা হয়েছিল। ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে পাথরের তৈরি এক বিশাল প্রাসাদের কথা জানা যায়।
চীনা পর্যটক ফা-হিয়েন অশোকের রাজপ্রাসাদের পাথরের কারুকার্যমন্ডিত দেওয়াল, দরজা দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল মানুষ নয় বরং অলৌকিক কোনো শক্তিই হয়তো প্রাসাদটি তৈরী করেছে।
পাটনার কুমারহারে রাজপ্রাসাদের অবশিষ্ট অংশ হিসেবে পাথরের থাম, বিশাল দরবার কক্ষ আবিষ্কৃত হয়েছে।
সেইসময় ভালোভাবে পালিশ করে পাথরগুলিকে মসৃণ ও চকচকে করে তোলা হতো। যার ফলে স্থাপত্যগুলির সৌন্দর্য ফুটে উঠতো।
আরও পড়ুন : মৌর্য সম্রাট অশোক
স্তূপ স্থাপত্য :
তোমার মনে হয়তো প্রশ্ন জাগছে যে স্তূপ কি ?
স্তূপ হলো পাহাড়ের মতো গোল আকারের দেখতে একধরণের স্থাপত্য। এখানে মূলত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমাধিস্ত করা হয়। এবং সেইসাথে ধ্যানের স্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘মহাবংশ ‘ থেকে জানা যায় যে অশোক প্রায় চুরাশি হাজার স্তূপ স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন।
অশোকের তৈরি সবচেয়ে বড় স্তূপটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের সাঁচীতে অবস্থিত। যা সাঁচী স্তূপ নামে বিখ্যাত।
এই স্তূপটি ইট ও পাথর দ্বারা নির্মিত। মৌর্য শিল্পরীতির এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো এই সাঁচী স্তূপটি।
সাঁচীর পাশাপাশি সারনাথ স্তূপটিও অশোক তথা মৌর্য আমলের এক অনন্য স্থাপত্য কীর্তি।
চৈত্য স্থাপত্য :
কোনো মহামানব বা পবিত্র ঘটনার স্মৃতি জড়িয়ে থাকা স্তূপগুলিকে বলা হয় চৈত্য ।
চৈত্য কে প্রার্থনা করার স্থল হিসেবে মানা হয়। মৌর্য আমলের বেশ কিছু চৈত্য সাঁচী ও সারনাথে দেখা যায়। এমনকি গুহা খোদাই করেও সেইসময় চৈত্য নির্মাণ করা হয়েছিল।
গুহা স্থাপত্যের নিদর্শনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুদামা গুহা, বরাবর গুহা ইত্যাদি।
এইসমস্ত গুহা চৈত্যের দেওয়ালগুলি ছিল মসৃণ পাথরের।
জানা যায় সম্রাট অশোক নাকি একটি গুহা চৈত্য আজীবিক ধর্ম সম্প্রদায়দের দান হিসেবে দিয়েছিলেন।
মৌর্য স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য :
১) মৌর্য স্থাপত্যে কাঠের ব্যবহার ঘটানো হয়েছিল। উদাহরণ হিসাবে চন্দ্রগুপ্তের নির্মিত পাটলিপুত্রের রাজপ্রাসাদের কথা বলা যেতে পারে।
২) স্থাপত্যকর্মে পাথরের ব্যবহার করা হয়েছিল।
৩) পাথরখণ্ড গুলির মসৃণতা বাড়াতে পালিশের ব্যবহার করে স্থাপত্যের জৌলুসতা বৃদ্ধি করা হয়।
৪) মৌর্য শিল্প স্থাপত্যে কিছুটা গ্রীক ও পারসিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
৫) স্তূপ, চৈত্যের মতো আয়তনে বড় স্থাপত্যগুলি মৌর্য শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
মৌর্য যুগের ভাস্কর্য
স্তম্ভ :
স্থাপত্যের সাথে সাথে মৌর্য যুগে ভাস্কর্য শিল্পেরও বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। অশোকের নির্মিত স্তম্ভের গায়ে সুন্দর ভাস্কর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। তাছাড়াও স্তূপের তোরণ, চৈত্যের প্রবেশদ্বারের উপরেও অসামান্য ভাস্কর্যের কাজ করা হত।
স্তম্ভের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হোলো একশিলা স্তম্ভ । একশিলা স্তম্ভ বলতে একটিমাত্র পাথরের তৈরি স্তম্ভকেই বোঝায়।
বিহার, এলাহাবাদ, দিল্লী, সারনাথ, সাঁচী প্রভৃতি জায়গাগুলিতে বহু একশিলা স্তম্ভ অশোকের আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল।
স্তম্ভগুলির গায়ে লিপি খোদাইয়ের কারুকার্য বেশ আকর্ষণীয়।
স্তম্ভের গঠন ও শিল্প নৈপুণ্য :
স্তম্ভগুলি ছিল খুবই সুন্দর করে পালিশ করা ও মসৃণ। স্তম্ভের একটি অংশ দণ্ড ও অপর অংশ শীর্ষ নামে পরিচিত।
দণ্ডের গঠন হতো সরু আকারের। দণ্ডের মাথায় থাকতো শীর্ষ নামক অংশটি। শীর্ষ বিভক্ত ছিল তিনটি অংশে। যেমন – ঘন্টা, মঞ্চ ও পশুর মূর্তিতে।
ঘন্টার ওপরে থাকা মঞ্চের আকার হতো গোল বা আয়তাকার। ফুল, লতা পাতা ইত্যাদির চোখ ধাঁধানো অলঙ্করণ এই মঞ্চের গায়ে করা থাকতো।
ঠিক এর ওপরে থাকতো কোনো পশুমূর্তি।
পশুমূর্তি গুলিতে এতটাই সূক্ষ্ম ভাস্কর্য করা হয়েছে , দেখলে মনে হবে একাজ একমাত্র ভারতীয় শিল্পীদের দ্বারাই সম্ভব।
পশুমূর্তির ভাস্কর্য :
স্তম্ভের ওপরের দিকেই থাকতো পশুমূর্তিগুলি। পশুমূর্তি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ঘোড়া, সিংহ, বৃষ বা ষাঁড় ও হাতির মূর্তিকে।
রামপূর্বা, লৌড়িয়া নন্দনগড়, বাখিরা প্রভৃতি স্থানের স্তম্ভগুলিতে এই পশুমূর্তি ও সেগুলির ওপর করা ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া গেছে। যদি পশুমূর্তির সবচেয়ে বড়ো নিদর্শনের কথা বলা হয় তাহলে সারনাথ স্তম্ভের কথা বলতেই হয়।
সারনাথ স্তম্ভে পিঠে পিঠ দিয়ে বসা চারটি সিংহ, সিংহগুলির থাবা ও সিংহগুলির মাংসপেশীতে অপূর্ব মৌর্য ভাস্কর্যের কারুকাজ দেখবার মতো। অনেকে এর সাথে গ্রীক ভাস্কর্যের তুলনা করে থাকেন।
পশুমূর্তির তলায় খোদাই করা আছে একটি চক্র। এই চক্রটি ভারতের জাতীয় পতাকায় অশোক চক্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এছাড়াও বুদ্ধদেবের জীবনের সাথে সম্পর্কিত হাতি, ঘোড়া, ষাঁড় ও সিংহের মূর্তিও অশোকের এই স্তম্ভে খোদাই করা আছে।
সবচেয়ে অবাক করার বিষয় এই যে, এই চারমুখওয়ালা সিংহমূর্তি অশোক স্তম্ভটিকেই ভারতের জাতীয় প্রতীক হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
উড়িষ্যার ধৌলি পাহাড়ে খোদিত একটি হাতির মূর্তিও মৌর্য শিল্পকলার এক অন্যতম নিদর্শন।
মৌর্য ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য :
১) অশোক স্তম্ভগুলিকে পালিশের মাধ্যমে মসৃণ করে তোলা হয়েছিল।
২) মৌর্য পশু ভাস্কর্যে গ্রীক ও পারসিক শৈলীর প্রভাব ছিল।
৩) মৌর্য ভাস্কর্য আড়ম্বর ও রাজকীয় ভাবের পরিচয় দেয়।
মূল্যায়ন :
হরপ্পা সভ্যতায় ভারতীয় শিল্পকলার প্রথম দেখা মিলেছিল। কিন্তু তারপর আর শিল্পকর্মের কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
ঐতিহাসিক এস.কে.সরস্বতীর মতে, হরপ্পা সভ্যতার পর ভারতীয় শিল্পকলার শূন্যতা দূর হয়েছিল মৌর্য যুগে। মৌর্য যুগে শিল্পে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটে।
কাঠ, পোড়ামাটি প্রভৃতি শিল্পের দুর্বল উপকরণের পরিবর্তে মৌর্য যুগে পাথরের ব্যবহার করা হয়েছিল। এর ফলে শিল্পকর্মগুলির জৌলুসতা অনেক বেশী বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ো : ষোড়শ মহাজনপদ
” আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তোমার ভালো লেগেছে। যদি তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি কমেন্ট করে আমাকে জানাতে পারো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। ভালো থেকো বন্ধু আর ইতিহাস পড়তে থেকো। “