তারকেশ্বরের ইতিহাস । Tarkeshwar Temple in bengali

তারকেশ্বরের ইতিহাস ( Tarkeshwar Temple )

তারকেশ্বর মন্দির ( Tarkeshwar temple ) পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। পশ্চিমবঙ্গের অগণিত হিন্দু ভক্তদের শৈব উপাসনার প্রধান কেন্দ্রস্থল হিসেবে চর্চিত।

এমন কোনো হিন্দুকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি তারকেশ্বর মন্দিরে পা রাখেননি। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় অবস্থিত তারকেশ্বর মন্দির হুগলি জেলাকেও করেছে সমৃদ্ধ।

আমাদের নিজেদের ঘর বাংলা প্রাচীনকাল থেকেই পরিচিত ছিল কালীক্ষেত্র হিসেবে। দেবী কালীর আরাধনাই চলতো বেশি।

কিন্তু শিবক্ষেত্র হিসেবে বাংলা পিছিয়ে থাকবে এমনটা তো হতে পারেনা। আত্মপ্রকাশ ঘটলো বাংলার জনপ্রিয় এই শৈব ক্ষেত্রটির।

ভক্তের জন্যই ভগবান। ভগবান শিব এখানে ভক্তদের কাছে পরিচিত হয়েছেন তারকনাথ রূপে।

আর এই তারকনাথ নামটি থেকেই হুগলি জেলায় স্থানটির নামকরণ হয়েছে তারকেশ্বর। শিব বৈদিক দেবতা নাকি অনার্যদের দেবতা সেই বিতর্কে নাহয় ঢুকলাম না।

কিন্তু শিব যে সারাভারতে সকলের অতিপ্রিয় একজন দেবতা একথা স্বীকার করতেই হয়। তিনি যেমন যোগীর আদর্শ।

ঠিক তেমনি গৃহী, ত্যাগীরও আদর্শ। গোটা ভারত জুড়ে শিব পূজিত হচ্ছেন লিঙ্গমূর্তি এবং খানিকটা বিগ্রহ রূপে।

কোথাও তিনি স্বয়ম্ভূ রূপে বিরাজিত। আবার কোথাও বা তাঁকে স্থাপন করা হয়েছে।

এমনই এক স্বয়ম্ভূ শৈবস্থান তারকেশ্বর। এখানে জানবো এই তারকেশ্বরের মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে। তারজন্য এই পুরো পোস্টটি অবশ্যই পড়তে হবে।

Tarkeshwar temple

অবস্থান

হুগলি জেলা পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য জেলা হিসেবে পরিচিত। ফরাসি, দিনেমার বণিকরা তাঁদের প্রথম আস্তানা গড়েছিল এই হুগলি জেলাতেই।

হুগলির চন্দননগর হোলো ফরাসিদের দ্বারা গঠিত ভারতে তাঁদের প্রথম উপনিবেশ স্থল।

হাওড়া, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর এই চারটি জেলার সাথে হুগলির সীমারেখা আছে।

জানা যায় যে গঙ্গার তীরে একসময় প্রচুর হোগলা পাতার বন থাকায় নাকি নামকরণ হয়েছিল হুগলি। আর সেইখান থেকেই হুগলি নদীরও নাম হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের দুঃখ নামে পরিচিত দামোদর নদী হুগলি জেলার প্রধান নদী। এখন এই হুগলি জেলাতেই তারকেশ্বর শহরে অবস্থিত তারকেশ্বর মহাদেবের মন্দির।

এক জাগ্রত শৈবস্থান। শুধু হুগলি জেলাতেই নয় এই শিবক্ষেত্রের মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশব্যাপী।

ভক্তদের কাছে শিব ( Lord Shiva ) এখানে পরিচিত তারকনাথ রূপে। বাংলার মন্দির রীতির ধারা অনুযায়ী তারকেশ্বর মন্দির আটচালা স্থাপত্যশৈলীর মন্দির।

যার গর্ভগৃহে বিরাজ করছেন স্বয়ং তারকনাথ। সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজনের কাছে তারকনাথ হয়ে উঠেছেন বড়ো আপনজন।

তাঁর মন্দির নিয়ে রয়েছে ইতিহাস। আমাদের লক্ষ্য সেই ইতিহাসের খোঁজ করা।

আরও পড়ুন : শঙ্করাচার্য

মন্দিরের ইতিহাসকথা

১) কেশব হাজারি ও তাঁর পরিবার

ইতিহাসে বর্ণিত আছে তারকেশ্বরের সাথে রামনগর নামক একটি স্থান অতীতে সংযুক্ত ছিল। বারাণসী থেকে এইস্থানে এসেছিলেন কেশব হাজারি নামে এক ব্যক্তি।

জানা যায় যে, অযোধ্যার নবাবের অত্যাচার থেকে পালিয়ে বাঁচতে পরিবার সমেত এখানে তিনি এসেছিলেন।

বিষ্ণুদাস ও ভারামল্ল নামে দুই পুত্র ও ভানুমতী নামে এক কন্যা ছিল জনৈক কেশব হাজারির। কিন্তু এই রামনগর সহ তারকেশ্বর ছিল মুর্শিদাবাদের নবাবের অধীন।

ক্রমে বিষ্ণুদাস ও ভারামল্ল উক্ত অঞ্চলে নিজেদের মালিকানা কায়েম ও কর আদায়ের চেষ্টা করলে নবাবের সৈন্য তাঁদের বন্দি করে।

জানা যায় বিষ্ণুদাস ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান বিষ্ণুভক্ত। মুর্শিদাবাদ নবাবের কারাগারে বিষ্ণুদাস ভগবান বিষ্ণুর কৃপাধন্য হয়ে কিছু অলৌকিক শক্তির প্রদর্শন দেখান।

নবাব এই ঘটনায় প্রীত হন।

তিনি দুই ভাইকে মুক্ত করেন এবং বালিগোরি ও মোহনবাগ পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দুই ভাইয়ের হাতে তুলে দেন। ভারামল্ল রাও উপাধিতে ভূষিত হন।

২) ভারমল্ল ও সন্ন্যাসী মায়াগিরি

কথিত আছে রাজা ভারমল্ল রাও-এর নাকি একটি বৃহৎ গোশালা ছিল। গোশালার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মুকুন্দ ঘোষ নামক এক কর্মচারীকে।

সেই গোশালার একটি আশ্চর্য গরু ছিল, নাম কপিলা। কপিলা নামক গরুটি প্রত্যহ বনের মধ্যে থাকা একটি পরিত্যক্ত শিবলিঙ্গের ওপর নিজের দুধ নিঃসরণ করতো।

রাজা ভারমল্ল রাও এই ঘটনার কথা জানতে পারেন। উত্তরভারত বরাবরই শিবক্ষেত্র রূপেই পরিচিতি পেয়ে এসেছে।

সেইসময় সুদূর উত্তরাখন্ড থেকে বাংলায় শৈবধর্ম প্রচারে এসেছিলেন যোশীমঠের নিষ্প্রাণ গিরির শিষ্য সন্ন্যাসী মায়াগিরি।

এই দীর্ঘ পথের তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন অপর এক সন্ন্যাসী মনমুকুন্দ গিরি। তাঁরা এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন রাজা ভারমল্লের রাজধানী রামনগরে।

দুই সন্ন্যাসীর শৈবধর্ম প্রচারের কথা ভারমল্ল জানতে পেরে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। বস্তুত এঁরা দুইজন সেই পরিত্যক্ত শিবলিঙ্গেরই আরাধনা করেছিলেন।

দুই সন্ন্যাসী তাঁদের আরাধ্য এই শিবলিঙ্গের নাম রেখেছিলেন তারকেশ্বর।

মায়াগিরি ও মনমুকুন্দ গিরির কাছে এই শিবলিঙ্গের অলৌকিক কথা শুনে ভারমল্ল এটিকে রামনগরে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

কিন্তু সেই শিবলিঙ্গটি ওইস্থানেই থেকে যায়। যা আজকে তারকেশ্বর নামেই সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে।

৩) ভারমল্লের মন্দির প্রতিষ্ঠা

জানা যায় যে স্বয়ং তারকনাথ রাজা ভারমল্লকে ( Raja Bharamalla ) স্বপ্নাদেশ দিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। সেইমতো বন পরিষ্কার করে মন্দির প্রতিষ্ঠার কাজ আরম্ভ হয়।

রাজা ভারমল্ল নিজেকে দেবসেবায় উৎসর্গ করেন। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা ভারমল্ল রাও তারকেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই হিন্দু স্থাপত্যটি বাংলার আটচালা মন্দির স্থাপত্যশৈলীতে গঠিত। মূল মন্দিরের সামনে দেওয়ালের গায়ে সুন্দর অলংকরণ দিয়ে সজ্জিত করা রয়েছে। 

তবে মন্দির প্রতিষ্ঠার সাল তারিখ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারমল্লের দানপত্র থেকে ওই বছরেই মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা জানা যায়।

পরবর্তী বহু সময়ের পর মন্দিরটি ভগ্নদশা প্রাপ্ত হলে বর্ধমানের মহারাজা নতুন করে মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

মন্দিরের সামনে নাটমন্দির উপস্থিত। অসংখ্য ভক্তের আগমনের ঘটায় মন্দিরের পরিসর আরও বাড়ানো হয়েছে।

মন্দিরের অন্যান্য দিক

১) মন্দিরের অভ্যন্তরভাগ 

তারকেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে অতীতের বহু কাহিনী। ধীরে ধীরে অগণিত হিন্দু ভক্তদের সারাবছর ধরে আনাগোনা বেড়েছে মন্দির বক্ষে। মন্দিরের উত্তরদিকে রয়েছে দুধপুকুর। 

প্রতিদিন শিবলিঙ্গের ওপর ভক্তদের অর্পণ করা দুধ মন্দিরের উত্তরদিকের জলাশয়ে পড়ে এইরূপ নামকরণ হয়েছে।

ভক্তদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই জলাশয়ে স্নান করলে শরীরে আরোগ্য লাভ হয়।

তারকনাথ ছাড়াও দেবী কালী, লক্ষ্মীনারায়ণের মন্দির ও অন্যান্য দেবদেবীর মন্দির এখানে বিদ্যমান।

চৈত্র মাসের গাজনমেলা, শ্রাবণ মাস, চড়ক-নীলপূজা, শিবরাত্রি ইত্যাদি জনপ্রিয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ভক্তদের ভিড় চোখে পড়ার মতো।

বিশেষ করে গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে ভক্তদের শিবলিঙ্গের ওপর জল ঢালার ধর্মীয় তৃপ্ততা সত্যিই নজর কাড়ে।

দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে দূরদূরান্ত থেকে বাঁক কাঁধে জল নিয়ে অগণিত ভক্তগণ এইসময় মন্দিরে আসেন। দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে আসা তাঁদের কাছে পরিশ্রম বলে মনে হয় না।

যেন যুগযুগান্ত ধরে তারকনাথ তাঁদের কতো আপনার, নিজের। তিনিই যেন ভক্তদের সব কষ্ট হরণ করে নেবেন।

ভক্তদের পূর্ণ বিশ্বাস বাবা তারকনাথ প্রসন্ন হয়ে সকল মনস্কামনা পূর্ণ করবেন। সাধারণত প্রতিদিন সকাল ৬:০০টা থেকে দুপুর ১:৩০ পর্যন্ত তারকেশ্বর মন্দির খোলা থাকে।

আবার কিছুক্ষনের বিরতির পর পুনরায় বিকেল ৪:০০ তে মন্দির খোলা হয়। যা খোলা থাকে সন্ধ্যা ৭:৩০ পর্যন্ত।

তবে বছরের বিশেষ দিনগুলিতে সময়ের হেরফের হয়ে থাকে। ট্রেন ও বাস দুই মাধ্যমেই তারকেশ্বর পৌঁছানো যায়।

২) আটচালা মন্দির

তারকেশ্বরের তারকনাথের মন্দির আটচালা আদলে তৈরী। আমাদের বাংলায় যে মন্দিরগুলি দেখা যায় তাতে চালা শ্রেণির ছাপ রয়েছে। মূলত চালা শ্রেণি তিনপ্রকারের।

চারচালা, আটচালা ও বারোচালা। চালা শ্রেণির মন্দিরগুলি বাংলার গ্রামের কুটিরগুলির মতো দেখতে।

বহু আগে এইভাবেই কুটিরের আদলে বাংলার দেবালয়গুলি তৈরি হোতো।

আসলে গম্বুজের ছাদকে গ্রামবাংলার কুটিরের চালার আকার দিলেই তা বদলে যেত চালা মন্দিরে। হুগলি জেলার অনেক স্থানেই চালা শ্রেণির মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে।

ছাদের চারদিক থেকে চারটি পিরামিড আকারের চাল একটি বিন্দুতে মিলিত হয়ে তৈরী হয় চারচালা মন্দির।

এইবার এই চারচালার চারটি চালের শীর্ষবিন্দু একসাথে মিশবার আগেই তার ওপর একটি ছোটো চালা বসিয়ে আটচালা মন্দির নির্মিত হোতো।

হুগলি জেলায় আটচালা মন্দিরের সংখ্যাই সবচাইতে বেশি।

এখানে আলোচিত তারকেশ্বরের তারকনাথের মন্দিরটি আটচালা আদলেই নির্মিত।

এটি ছাড়াও আঁটপুর, জাঙ্গিপাড়া, সিঙ্গুর, হরিপাল, ধনেখালি প্রভৃতি স্থানের শিবমন্দিরগুলিও হুগলি জেলার আটচালা মন্দিরের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

মূল্যায়ণ

পশ্চিমবঙ্গের এক জাগ্রত শৈবতীর্থ তারকেশ্বরের মহাদেবের মন্দির। এই মন্দিরের পরিবেশ প্রতিটি সাধু -সন্ত, ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র। মহাদেবের মাহাত্ম্য আজও সর্বজনবিদিত।

ভক্তদের কাছে তিনি তারকনাথ রূপে পূজিত হচ্ছেন। ভক্তদের বিশ্বাস তিনি তাঁদের সকল দুঃখ কষ্টের হরণকর্তা।

কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, দৈবিক মাহাত্ম্যের পাশাপাশি তারকেশ্বর মন্দিরের একটি নিজস্ব ইতিহাসও রয়েছে।

হয়তো সেই ইতিহাসের খোঁজ অনেকেই রাখেন না। তাই বলা যায় যে, ইতিহাস, কিংবদন্তি, দৈবিক মাহাত্ম্য এই সবকিছুর সাথেই ভগবান তারকনাথ স্বমহিমায় তারকেশ্বরে বিরাজিত।

আরও পড়ুন : ফা – হিয়েন কে ছিলেন

আশা করি তারকেশ্বরের ইতিহাস সম্পর্কিত পোস্টটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পেরেছো। যদি পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানিও এবং অন্যদের সাথে শেয়ার কোরো। তোমাদের মূল্যবান মতামত আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রেরণা যোগায়।        

4 thoughts on “তারকেশ্বরের ইতিহাস । Tarkeshwar Temple in bengali”

  1. কিন্তু বাঁকে করে জল বয়ে নিয়েগিয়ে শিব লিঙ্গে ঢেলে পূর্ণ প্রাপ্তি হয় বা মনোষ কামনা পূর্ণ হয়।
    এই বাঁকে করে জল বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো ইতিহাস আছে?
    জানা থাকলে একটু আমাদের জানাবেন ।
    কান্বার যাত্রা হয় হিমাচল প্রদেশে। এই যাত্রার ইতিহাস কিছুটা হলেও জেনেছি।

    কিন্তু তারকেশ্বর যাত্রার ইতিহাস জানি না?

    1. নিশ্চই জানাবো। পোস্টটি পড়বার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!