প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান । Sources of Ancient indian history in bengali

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান ( Sources of Ancient indian history )

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ( Sources of Ancient indian history ) আমরা অতীত ঘটনার ওপর নির্ভরশীল। 

অতীতের ঘটনাকে জানতে ঐতিহাসিকরা যে তথ্যের ওপর নির্ভর করেন তাই হোলো ইতিহাসের উপাদান। 

আরো সহজভাবে বললে, যে সূত্র থেকে ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করা হয় তাকেই বলা হয় ইতিহাসের উপাদান।

এই উপাদানগুলি হোলো যেমন, লিখিত বিবরণ, দলিলপত্র, বিভিন্ন দ্রব্য, নিদর্শন, কোনো চিহ্ন ইত্যাদি। বলা হয় যে, প্রাচীন ভারতীয়রা ইতিহাস রচনার জন্য কোনো তথ্য রেখে যাননি।

বিভিন্ন পন্ডিতরাও এই একই কথা বলেছেন।

মনে করা হয় যে, গ্রীস, রোমের প্রাচীন ইতিহাস রচনা করেছেন হেরোডোটাস, ট্যাসিটাস, থুকিডিডিস প্রমুখরা। তাহলে ভারতের ক্ষেত্রে কেন এমন কেউ ছিলেন না ?

নিশ্চয়ই ছিলেন, তবে তাঁরা বিবরণ লিপিবদ্ধ করে যেতে পারেননি।

তাই ইতিহাসবিদদের বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করতে হয়েছে।

এই উপাদানগুলি দুভাগে বিভক্ত। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান এবং সাহিত্যিক উপাদান।

Sources of ancient indian history

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও গুরুত্ব ( Sources of Ancient indian history )

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস উপাদানে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের এক বিরাট গুরুত্ব রয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব সাহায্যে যে ইতিহাস রচিত হয় তা বিজ্ঞানসম্মত। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে বিভিন্ন মূর্তি, পাত্র, ধাতু-পাথরের তৈরি বিভিন্ন উপকরণ আবিষ্কৃত হয়।

সেই উপকরণগুলোর মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট যুগের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব হয়।

বহু প্রাচীনকালে ভারতের মানুষের বাসস্থান, কৃষিব্যবস্থা, সেইসময়কার গ্রাম,নগর এই সবকিছু সম্বন্ধে জানা যায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান থেকে।

এইকারণেই ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের আমলে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ( Indian archeological department ) প্রতিষ্ঠা হয়।

তখন এর প্রধান ছিলেন স্যার জন মার্শাল

ঐতিহাসিকদের কাছে সুদূর অতীত থেকে আধুনিক যুগের গোড়া পর্যন্ত বস্তুই প্রত্নবস্তু। ঐতিহাসিকরা এইখান থেকেই উপাদান সংগ্রহ করে রচনা করেন ইতিহাস।

যে ইতিহাস সুদূর অতীতের কথা আমাদের শোনায়।

১) স্থাপত্য-ভাস্কর্য 

স্থাপত্য ও ভাস্কর্য প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় এক অন্যতম উপাদান।

প্রাচীনকালে নির্মিত বহু প্রাসাদ, মন্দির, স্তূপ, বিহার, স্মৃতিস্তম্ভ, মূর্তি প্রভৃতি প্রত্নবস্তু হিসেবে মাটির তলা থেকে পাওয়া যায়।

তাই প্রাচীনকালের এইসকল ধর্মীয় স্থাপত্য ও ভাস্কর্য থেকে শিল্প ও ধর্মের বিবর্তনের ইতিহাস জানা যায়।

সেইসাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসকেও প্রতিফলিত করে। এই মন্দির, স্তূপ, বিহার, প্রাসাদ ইত্যাদির নির্মাণ পদ্ধতি, আকার, কারুকার্য বিশ্লেষণ করে ইতিহাসের সময় নির্ণয় করা সম্ভব হয়।

যেমন, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কাঠের প্রাসাদ, গান্ধার শিল্প, অজন্তা ইলোরার গুহা স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, রাজগীর ও নালন্দা, এলিফ্যান্টা গুহা প্রভৃতি স্থাপত্য-ভাস্কর্যের উদাহরণ।

এইগুলির শিল্পচেতনা, সূক্ষ্মতা ভারতের ইতিহাসের উপাদানে এক অন্য মাত্রা যোগ করে। 

২) শিলালিপি ও তাম্রলিপি 

প্রাচীন ইতিহাসের উপাদানে লিপির গুরুত্ব অনেকখানি।

যেহেতু প্রাচীন ভারতে কাগজের আবিষ্কার হয়নি তাই ভারতের রাজারা তাঁদের আদেশপত্র, ধর্মমত ইত্যাদি পাথরে ও ধাতুফলকে খোদাই করে যান।

এছাড়া তামা বা ব্রোঞ্জ, পোড়ামাটির ফলকেও প্রাচীন লিপিগুলি খোদাই করা হোতো।

আরও পড়ুন : হরপ্পার নগর পরিকল্পনা

পাথর, পর্বতের গায়ে, মন্দিরের গায়ে খোদিত লিপি থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাল-তারিখ, রাজার নাম, শাসন পরিচালনা সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা যায়। 

তামার ফলকে যেগুলি খোদাই হোতো সেগুলি পরিচিত তাম্রশাসন নামে। জমি বিক্রি, জমিদান, ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত তথ্য তাম্রশাসন থেকে জানা যায়।

উদাহরণ হিসেবে পালরাজা দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসনের কথা বলা যেতে পারে।

এছাড়াও পালরাজা ধর্মপালের খালিমপুর তাম্রশাসন, যেখানে বাংলায় অরাজকতা বা মাৎস্যন্যায় সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সম্রাট অশোকের শিলালিপিগুলি ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা।

অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন জেম্স প্রিন্সেপ। জনগণের বোঝার সুবিধার্থে প্রাকৃত ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। ব্রাহ্মী লিপি লেখা হোতো বাঁ দিক থেকে ডান দিকে।

এই লিপিগুলি থেকে অশোকের শাসনকাল সম্পর্কে বহু তথ্য মেলে।

কলিঙ্গরাজ খারবেলের হাতিগুমফা লিপি, রুদ্রদামনের জুনাগড় লিপি, সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি, শশাঙ্কের গঞ্জাম লিপি প্রভৃতি ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান।

৩) মুদ্রা

প্রাচীন কালের মুদ্রাগুলি সমকালীন ইতিহাসের বহু তথ্য পরিবেশন করে।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম। মুদ্রা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের এক অন্যতম উপাদানরূপে স্বীকৃত।

প্রাচীনকালে বাণিজ্য ও জিনিসপত্র কেনাবেচার প্রধান মাধ্যম ছিল মুদ্রা।

ভারতের প্রাচীন মুদ্রাগুলি থেকে সম্রাটদের রাজত্বের সময়, অর্থনৈতিক অবস্থা, ধাতু শিল্পের মান, বিশেষ ঘটনা, ভাষা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়।

প্রাচীন ভারতের মুদ্রাগুলি মূলত সীসা, রুপো, তামা, সোনা দিয়ে তৈরী ছিল। মুদ্রাগুলিতে খোদাই করা থাকতো তারিখ, রাজার মূর্তি, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, রাজার নাম ইত্যাদি।

প্রাচীন ইতিহাস রচনার সময় মুদ্রাগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্য ঐতিহাসিকদের সাহায্য করে থাকে।

খননকার্যের সময় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তক্ষশীলার ভীরমাউন্ডে পাওয়া ছাপযুক্ত মুদ্রাগুলিই ভারতের প্রাচীনতম মুদ্রা।

এগুলি ছিল নন্দ-মৌর্য আমলের। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক দিক সম্পর্কে অবহিত হতে মুদ্রা আমাদের সাহায্য করে।

কুষাণ যুগের মুদ্রাগুলি ছিল স্বর্ণমুদ্রা। কুষাণরাই প্রথম ভারতে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন।

কুষাণ সম্রাট বিম কদফিসের মুদ্রায় মহেশ্বর কথাটি উল্লেখ থাকায় জানা যায় তাঁর শৈব ধর্ম অবলম্বনের কথা।

কণিষ্কের মুদ্রায় বুদ্ধের মূর্তি অঙ্কিত থাকায়, কণিষ্কের বৌদ্ধ ধর্মের দিকটি জানা সম্ভব হয়।

এছাড়াও গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের বীনাবাদন ছাপযুক্ত মুদ্রা থেকে তাঁর সঙ্গীত অনুরাগের পরিচয় দেয়।

সাতবাহন রাজাদের মুদ্রায় জাহাজের ছাপ তাঁদের বাণিজ্য ও সামুদ্রিক কার্যাবলীর ইঙ্গিত বহন করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে মুদ্রার ওপর অঙ্কিত এইসমস্ত আকর্ষণীয় তথ্যে আমাদের ইতিহাস পরিপুষ্ট।

৪) খননকার্য 

প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে ভারতের অনেক স্থানে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংস অবশেষ পাওয়া গেছে। সুতরাং এগুলিকে বিশ্লেষণ করে ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের বহু তথ্য পাওয়া যায়।

এর মধ্যে প্রথমেই নাম আসে হরপ্পা সভ্যতা বা সিন্ধু সভ্যতার।

এই সভ্যতা ভারতের প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে।

সিন্ধু নদীর উপত্যকায় হরপ্পার প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, আর্য সভ্যতার আগে ভারতে এক উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

পরবর্তীকালে হরপ্পা সভ্যতার হাত ধরে সাঁচী, সারনাথ, পাটলিপুত্র, নালন্দা, পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্রকেতুগড় প্রভৃতি স্থানে খননকার্য চালানো হয়।

অনেক অজানা ইতিহাস উন্মোচিত হয়।

এরফলে ঐতিহাসিকদের প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা করা সহজ হয়।

এমনকি মধ্য এশিয়ার টাকলামাকানে স্যার অরেলস্টেইন কর্তৃক ভারতীয় উপনিবেশের নিদর্শন আবিষ্কার থেকেও অনেককিছু জানা যায়।

সাহিত্যিক উপাদান ও গুরুত্ব 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদানে সাহিত্যিক উপাদানের গুরুত্বও কোনো অংশে কম নয়। আসলে যে কোনো দেশের সাহিত্য সে দেশের দর্পণ বিশেষ।

সেই সাহিত্যের দর্পণের মধ্য দিয়ে রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুই প্রতিফলিত হয়।

তাই সাহিত্য সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার জন্য ঐতিহাসিকরা সাহিত্যিক উপাদানের ওপর নির্ভর করে থাকেন।

সুদূর প্রাচীনকাল থেকে মানুষের জীবনধারা বুঝবার জন্য সাহিত্যিক প্রমাণের দরকার পড়ে।

এখন ভারত ইতিহাসের সাহিত্য উপাদানকে দুভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। দেশীয় সাহিত্য এবং বিদেশীয় পর্যটকদের বিবরণ বা বৈদেশিক গ্রন্থ।

১) দেশীয় সাহিত্য 

i) বৈদিক সাহিত্য –

দেশীয় সাহিত্যের মধ্যে ইতিহাস জানার জন্য বেদ বা বৈদিক সাহিত্যে খুবই কার্যকরী।

আমরা সকলেই জানি যে, বেদ প্রধানত চার প্রকার। ঋক, সাম, যজু ,অথর্ব।

এছাড়াও রয়েছে আরণ্যক, সূত্র সাহিত্য, উপনিষদ ইত্যাদি। এই সবগুলি একত্রে বৈদিক সাহিত্য নামে পরিচিত।

বেদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীনতম বেদ হোলো ঋকবেদ। ঋকবেদের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের মধ্যে।

ঋকবেদে ১০৬০০ টি স্তুতিমূলক মন্ত্র সংকলিত প্রার্থনা মন্ত্র ও প্রাকৃতিক বর্ণনা সমেত দেবদেবীর পূজার্চনার বিষয় স্থান পেয়েছে।

সামবেদে স্তোত্রধর্মী গান, যজুর্বেদে যজ্ঞের মন্ত্র এবং অথর্ববেদে মারণ,উচাটন, বশীকরণ প্রভৃতি রহস্যময় বিদ্যার বিষয় সংকলিত আছে।

তাই এগুলি থেকে আর্যদের ধর্ম, সমাজ, অর্থনৈতিক জীবনের নানা তথ্য পাওয়া যায়।

এছাড়াও আরণ্যক, উপনিষদের বিষয়গুলি ইতিহাস রচনার কাজে ব্যবহার করা হয়। তাই বলা যায় প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় বৈদিক সাহিত্য অপরিহার্য। 

ii) মহাকাব্য ও পুরাণ –

দেশীয় সাহিত্যিক উপাদানের মধ্যে মহাকাব্য ও পুরাণের গুরুত্ব অনেকখানি।

ভারতের দুটি প্রাচীন মহাকাব্য হোলো রামায়ণ ও মহাভারত। সংস্কৃত ভাষায় লেখা এই দুটি মহাকাব্য পৃথিবীর দীর্ঘতম মহাকাব্য।

মহত্ব ও ভারবত্ব থাকার কারণে নাম হয়েছে মহাভারত। বলা যায় এটি ভারতের অমৃত গ্রন্থ।

কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই মহাভারতের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে।

অন্যদিকে রামায়ণের প্রধান চরিত্র রামচন্দ্রের লঙ্কা থেকে সীতা উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছিল রামায়ণ। এই দুটি মহাকাব্যই রচিত হয়েছিল দীর্ঘ সময়কাল ধরে।

তাই এই দীর্ঘ সময়ের ভারতের সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি, ধর্মীয় জীবন, প্রযুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন তথ্য এইখান থেকে পাওয়া যায়।

পুরাণ হোলো প্রাচীন কাহিনীগুলির সমন্বিত রূপ। ভারতের অনেক প্রাচীন রাজবংশের বিবরণ পুরাণে বর্ণিত আছে।

ভারতের সনাতন ধর্মে পুরাণের সংখ্যা ১৮ টি।

যেমন মৌর্যবংশের উপাদান হিসেবে বিষ্ণুপুরাণ, সাতবাহনদের ইতিহাস জানার জন্য মৎস্যপুরাণ, গুপ্ত বংশের ইতিহাসের জন্য বায়ুপুরাণ নির্ভরযোগ্য উপাদান।

iii) বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য – 

বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যগুলি ইতিহাস রচনার উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে মগধের উত্থানের সম্পর্কে জানা যায় বৌদ্ধ গ্রন্থ দীর্ঘ নিকায়অঙ্গুত্তর নিকায় থেকে।

এছাড়াও নাগার্জুনের মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা, অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস রচনার কাজে সাহায্য করে।

অপরদিকে জৈন গ্রন্থ ভগবতী সূত্র, ভদ্রবাহু রচিত জৈনকল্প সূত্র ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।

iv) মৌর্যযুগের সাহিত্য – 

মৌর্যযুগের ইতিহাসের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি।

এখানে মৌর্য শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস, হেমচন্দ্রের পরিশিষ্টপর্বণ গ্রন্থ থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সম্পর্কে বহু তথ্য উপাদান কাজে লাগে।

v) গুপ্তযুগের সাহিত্য –

ইতিহাসের উপাদানে ভরা বহু সাহিত্য গুপ্তযুগে রচিত হয়েছিল।

এইসময়ের একজন বিখ্যাত কবি হলেন হরিষেণ। তিনি সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি ছিলেন।

হরিষেণ রচনা করেছিলেন এলাহাবাদ প্রশস্তি, যা সমুদ্রগুপ্তের কার্যকলাপ সম্পর্কে তথ্য দেয়।

ভাস রচিত চারুদত্ত নাটক, কালিদাসের মেঘদূত, রঘুবংশম, অভিজ্ঞানশকুন্তলম কাব্য খুবই মূলবান উপাদান।

বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা, যেখানে সেসময়কার নাগরিকদের জীবনযাত্রা বর্ণিত হয়েছে।

গুপ্ত পরবর্তী যুগের সাহিত্যিক উপাদানের মধ্যে বাণভট্টের লেখা হর্ষচরিত বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাণভট্ট ছিলেন হর্ষবর্ধনের সভাকবি।

তাছাড়াও সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, বিলহনের বিক্রমাঙ্কদেব চরিত, কলহনের রাজতরঙ্গিনী মূল্যবান গন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।

vi) সঙ্গম সাহিত্য – 

সঙ্গম সাহিত্য বলতে মূলত তামিল সাহিত্যকে বোঝানো হয়।

সঙ্গম কথাটির অর্থ তামিল কবিদের সংঘ বা সম্মেলন। সঙ্গম সাহিত্যগুলির রচনাকাল ৩০০-৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।

তামিল ভাষায় রচিত দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ সিলোপ্পাদিকরমমণিমেখলৈ। এইদুটি গ্রন্থে কাবেরিপত্তনম ও মাদুরাই এর কৃষি অর্থনীতি, নারীজাতির অবস্থা সম্পর্কিত অনেক তথ্যের বর্ণনা আছে।

২.বৈদেশিক গ্রন্থ ও পর্যটকদের বিবরণ
i) বৈদেশিক গ্রন্থ – 

শুধুমাত্র দেশীয় সাহিত্যই নয়, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস রচনায় বৈদেশিক গ্রন্থও অপরিহার্য উপাদান।

এইরকমই একটি গ্রন্থ হোলো পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান সী

গ্রন্থটির রচয়িতার নাম জানা না গেলেও,পাশ্চাত্য দেশের সাথে প্রাচীন ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্যের যোগাযোগের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা আছে।

রোমান পন্ডিত প্লিনির মূল্যবান গ্রন্থ ন্যাচারালিস হিস্টোরিয়া থেকে প্রাচীন রোম-ভারত বাণিজ্যের কথা জানা যায়।

গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের তথ্য কার্টিয়াস, ডিওডোরাস প্রমূখ রোমান লেখকদের ইতিহাস থেকে আমরা পেয়ে থাকি।

সবচাইতে মূল্যবান গ্রন্থ মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা থেকে মৌর্যযুগ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা মেলে।

এছাড়াও টলেমির জিওগ্রাফিকে হুফেগেসিস বা ভূগোল গ্রন্থটিও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানতে কাজে লাগে।

কুষাণদের ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করে প্যান-কু রচিত সিয়েন-হান-শু গ্রন্থটি। ফা হিয়েন রচিত ফো-কুয়ো-কি, হিউয়েন সাং রচিত সি-ইউ-কি আরো দুটি দরকারি উপাদান।

ii) পর্যটকদের বিবরণ –

প্রাচীন ভারতে বহু বিদেশী পর্যটক এসেছিলেন। তাঁরা ভারতে এসে যা প্রত্যক্ষ করেছেন, সেই বিবরণের ভিত্তিতেই দেশে ফিরে গিয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

তাঁদের সেইসমস্ত অতি মূল্যবান বিবরণ ভারতের ইতিহাস রচনায় কাজে আসে।

যেমন, মেগাস্থিনিসের বিবরণ মূলক গ্রন্থ ইন্ডিকা, ফা হিয়েনের ফো-কুয়ো-কি, হিউয়েন সাং-র সি-ইউ-কি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

একাদশ শতাব্দীতে ভারতে এসেছিলেন আরব পর্যটক আলবেরুণী

গজনীর সুলতান মামুদের সাথে তিনি এদেশে আসেন। আলবেরুণী রচিত গ্রন্থটির নাম তহকিক-ই-হিন্দ

এই বইটিতে তৎকালীন হিন্দু সমাজের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে। যা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম উপাদান হিসেবে স্বীকৃত।

উপসংহার –

এতগুলি উপাদানের ওপর নির্ভর করে ইতিহাস রচনা করা যায় ঠিকই। তবে সীমাবদ্ধতাও আছে।

লিপি, সভাকবিদের রচিত গ্রন্থগুলি হয়তো শাসকদের পক্ষপাত দোষে দুষ্ট।

বিদেশীয় গ্রন্থ, বৈদেশিকদের বিবরণ সবসময় নির্ভুল হয় না।

কারণ এদেশের ভাষা, রীতি নীতি তাঁদের বোধগম্য ছিল না। তাই বলা যেতে পারে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্বেও সতর্কতার সাথে উপাদানগুলি বিশ্লেষণ, বিচার করলে তবেই নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা সম্ভব।

আরও পড়ুন : সাঁওতাল বিদ্রোহ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!