মৌর্য সম্রাট অশোক (Maurya Emperor Ashoka in History)
কেমন আছো বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভালো আছো। এবারের যে পোস্টটি লিখব তা হল মৌর্য সম্রাট অশোকের সম্পর্কে।
আশা করি ইতিহাসে অশোকের সম্পর্কে নিশ্চই পড়েছ।
যদি না পড়ে থাকো তাহলে এই পোস্টটি অবশ্যই পড়ে নাও।
আগের পোস্টটি ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্ব সম্পর্কে করা হয়েছে। চাইলে এই পোস্টটিও তুমি পড়তে পারো।
সম্রাট অশোকের পরিচয় :
বিন্দুসারের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র অশোক মৌর্য বংশের সিংহাসনে বসেন।
সম্রাট অশোকের রাজত্বকাল ভারত তথা পৃথিবীর ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। সিংহলী গ্রন্থ ‘ মহাবংশ ‘ থেকে জানা যায় যে, অশোক তাঁর বহু ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে বসেন।
এজন্য তিনি চণ্ডাশোক নামে পরিচিত হন।
যদিও চণ্ডাশোক থেকে পরবর্তীকালে অশোক ধর্মাশোকে পরিণত হয়েছিলেন।
অশোকের সিংহাসন লাভ :
অশোকের পিতা বিন্দুসারের মৃত্যু হয়েছিল আনুমানিক ২৭৩ খ্রীষ্টপূর্বে।
বিভিন্ন উপাদান, শিলালেখ থেকে জানা যায় যে, অশোক সিংহাসনে বসেন ২৬৯ খ্রীস্টপূর্বে।
বিন্দুসারের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে এক প্রবল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল সিংহাসন লাভের জন্যে।
অশোক তাঁর ভাইদের হত্যা করে শেষ পর্যন্ত সিংহাসনে বসেন।
সম্রাট অশোকের উপাধি :
মৌর্য সম্রাট অশোক ‘ প্রিয়দর্শী ‘ , ‘ দেবানামপ্রিয় ‘ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনে বসেছিলেন।
১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস প্রিন্সেপ ব্রাহ্মী লিপিতে রচিত অশোকের একটি শিলালিপির পাঠোদ্ধার করেছিলেন। সেখানে এই উপাধির উল্লেখ ছিল।
কলিঙ্গ বিজয় :
অশোক তাঁর পূর্ব-পুরুষদের মতই সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। রাজত্বের নবম বছরে তিনি কলিঙ্গ রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।
২৬১ খ্রীষ্টপূর্বে অশোক কলিঙ্গ জয় করেন। বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কলিঙ্গ রাজ্যটি অবস্থিত ছিল।
আবার অনেকে মনে করেন ওড়িশার প্রাচীন নাম ছিল কলিঙ্গ।
তবে কলিঙ্গ যুদ্ধের বিবরণ ও ফল জানা যায় অশোকের তেরোতম প্রধান শিলালেখ থেকে।
কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ :
অশোক কেন কলিঙ্গ যুদ্ধের ঘোষণা করেছিলেন, সেই প্রশ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মতে, ‘ নন্দবংশের পতনের পর মগধের কৰ্তৃত্ব কলিঙ্গ মেনে নেয়নি ‘।
বিন্দুসার যখন চোলদের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, তখন কলিঙ্গ চোলদের পক্ষ নিয়েছিল। তাই হয়তো এই প্রতিশোধ নিতে অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হন।
কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিকদের মত অন্যরকম। রোমিলা থাপারের মতে, ‘ স্থল ও জলপথে কলিঙ্গ দক্ষিণ ভারতের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করত ‘।
কলিঙ্গ রাজ্যের তাম্রলিপ্ত নামে একটি বন্দর ছিল।
এই বন্দরের মাধ্যমে দঃ-পূ: এশিয়ার সাথে মগধের বাণিজ্য চলত।
আর এই পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কলিঙ্গ। তাই এখানে বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অশোক এই যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন।
কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রভাব :
কলিঙ্গ যুদ্ধের প্রভাব ছিল অপরিসীম। এই যুদ্ধে প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ বন্দি হয়েছিল।
আর নিহত হয়েছিল প্রায় এক লক্ষ। এই তথ্যগুলি সম্রাট অশোকের শিলালেখ থেকে পাওয়া যায়।
এত মানুষের মৃত্যুর বিষয়টি অশোককে মর্মাহত করেছিল। সফলতার সাথে যুদ্ধ জিতলেও তাঁর মন ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন এসেছিল।
যুদ্ধনীতি তিনি পুরোপুরি ত্যাগ করেছিলেন।
জৌগড়া শিলালেখতে তিনি বলেছেন, ‘ সকল মানুষ আমার সন্তান। আমি চাই যে তারা যেন ইহলোক ও পরলোকে সমস্ত সুখ লাভ করে ‘।
কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক বৌদ্ধধর্ম নেন। প্রেম ও শান্তির বাণী প্রচার করে মানুষের মন জয় করতে থাকেন।
ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়-এর মতে, ‘ কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়ানক হত্যাকান্ড ও ধ্বংসলীলা অশোকের মনে রূপান্তর আনে ‘।
আরও পড়ো : ফ্রান্সের সন্ত্রাসের রাজত্ব
সম্রাট অশোকের অনুশাসন স্তম্ভ বা শিলালেখ :
অনুশাসন স্তম্ভ বলতে পাথরের ওপর বা পাথরের তৈরি স্তম্ভের ওপর খোদাই করা লেখাকে বোঝান হয়।
অশোক একমাত্র শাসক যিনি তাঁর আদর্শ প্রচারের জন্য অনুশাসনের প্রয়োগ করেছিলেন।
অনুশাসনগুলি দুভাগে বিভক্ত। ১) পর্বত বা পাথরের খন্ডের ওপর খোদাই করা লিপি বা শিলালেখ। ২) শিলাস্তম্ভের গায়ে খোদাই করা লিপি বা স্তম্ভলেখ।
স্তম্ভলেখগুলি বেলেপাথরে তৈরি। এছাড়াও বেশ কিছু গুহলেখও পাওয়া গেছে।
যেসমস্ত স্থানে এই শিলালেখ গুলি পাওয়া গেছে সেগুলি হল— কালসী (দেরাদুন ), শাহবাজগড়ি (পাকিস্তান ), মানসেহরা (পাকিস্তান ), কান্দাহার (আফগানিস্তান ), ধৌলি (প্রাচীন কলিঙ্গ ), সোপারা (মহারাষ্ট্র ) ইত্যাদি।
সাম্রাজ্যের সীমানা :
বিভিন্ন গ্রন্থ ও শিলালিপি থেকে জানা যায় যে অশোকের সাম্রাজ্য উত্তরে তরাই অঞ্চল , কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
এছাড়াও দঃ-পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে আরবসাগর তীর পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল।
তাই বলা যেতে পারে যে, অশোকের সাম্রাজ্য উত্তরে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে মহীশূর পর্যন্ত এবং পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে উত্তর পশ্চিমে পেশোয়ার পর্যন্ত প্রসারিত ছিল।
সম্রাট অশোকের জনহিতকর কাজ :
অশোক যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে প্রজাদের কল্যাণের জন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ‘ ধর্মমহামাত্র ‘ নামে কর্মচারীদের ওপর প্রজাদের কল্যাণের ভার দিয়েছিলেন তিনি।
অশোকের নির্দেশে রাজুক , যুত , মহামাত্র নামক কর্মচারীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে প্রজাদের অভাব অভিযোগ শুনতেন ও সেগুলি মেটাতেন।
অশোক জনগণের সুবিধার জন্যে রাস্তার ধারে বৃক্ষ রোপণ ও কুঁয়ো খনন করেছিলেন।
যাতে ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত মানুষ বিশ্রাম ও জলপান করতে পারে।
এছাড়াও মানুষ ও পশুদের জন্যে চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন অশোক।
অশোকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ ও ধর্মপ্রচার :
অশোক প্রথমে শিবের উপাসক ছিলেন। কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তের কাছে তিনি বৌদ্ধধৰ্মে দীক্ষা নেন। অশোকের রাজধানী পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি ডাকা হয়েছিল।
অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা সিংহলে গিয়েছিলেন অশোকের ধর্মের বাণী প্রচার করতে।
অশোকের অন্য এক পুত্র কুনাল গিয়েছিলেন মধ্য এশিয়ায়।
এছাড়াও সিরিয়া, মিশর, ম্যাসিডনে অশোক তাঁর ধর্মদূত পাঠিয়েছিলেন।
মূল্যায়ন :
অশোক প্রথমে ছিলেন একজন প্রকৃত রাজা। কিন্তু কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তিনি চণ্ডাশোক থেকে ধর্মাশোকে পরিণত হন। প্রজাদের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে থাকেন।
প্রেমের বাণী প্রচার করে মানবসমাজকে উদবুদ্ধ করেছিলেন।
তাঁর মৃত্যুর পরেও মৌর্য সাম্রাজ্য দীর্ঘকাল টিকে ছিল।
তাই এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন, ‘ বিশ্ব ইতিহাসের অসংখ্য নৃপতির মধ্যে অশোকই ছিলেন একমাত্র উজ্জ্বল নক্ষত্র ‘।
আরও পড়ো : ফরাজি আন্দোলন
” আশা করি পোস্টটি পড়ে তোমার ভালো লেগেছে। যদি তোমার কোন মতামত থাকে তাহলে তুমি কমেন্ট করে আমাকে জানাতে পারো। তোমার মতামত আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। ভালো থেকো বন্ধু , আর ইতিহাস পড়তে থেকো “।