ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলাফল
শিল্প বিপ্লব কি, শিল্প বিপ্লব প্রথম কোথায় হয়েছিল এই সম্পর্কে একটি পোস্ট এই ওয়েবসাইটে আগেই করা হয়েছে। পোস্টটির নাম ‘ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব‘ ( Industrial revolution in England ) ।
আশা করি উপরের প্রশ্নগুলির উত্তর এই পোস্টটিতে পেয়ে যাবে। ইংল্যান্ড দেশটি ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত।
১৮০০ সালের শেষদিকে ইংল্যান্ড এবং ইউরোপের অন্য দেশগুলিতে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তন ছিল শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনে পরিবর্তন।
তাই শিল্পদ্রব্যের উৎপাদনে এই যে বিপুল পরিবর্তন ঘটলো তাকেই শিল্পবিপ্লব বলা হয়।
এইসময় গোটা ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জায়গায় কল কারখানা গড়ে উঠতে থাকে।
সেই কারখানাগুলোতে দিনরাত মানুষেরা তাঁদের শরীরের শ্রম দিয়ে শিল্পদ্রব্য উৎপাদন করতে লাগলো। আবিষ্কার হোলো শিল্পের জন্য দরকারি বিভিন্ন যন্ত্রপাতির।
ইংল্যান্ডের শিল্পের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এইবার আসি অন্য কথায়।
শিল্পে বিপ্লব তো এলো, কিন্তু এই শিল্পবিপ্লবের ফলাফলটা কি ছিল ?
যে কোনো কিছুর নির্দিষ্ট একটা ফলাফল থাকে। সেটা সুফল বা কুফল দুইই হতে পারে।
এই পোস্টে ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের ফলাফল বা শিল্পবিপ্লবের ফলাফল সম্পর্কে জানবো। তাই পোস্টটি অবশ্যই শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ রইলো।
শিল্পবিপ্লবের সুফল
শিল্পবিপ্লব হোলো আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান ঘটনার মধ্যে একটি।
শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ডের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছিল।
এইবার আমরা দেখবো শিল্পবিপ্লবের ফলে কি কি সুফল হয়েছিল।
যন্ত্রের আবির্ভাব –
যন্ত্র বা মেশিন এমন এক জিনিস যা মানুষের জীবনযাত্রায় গতি এনে দেয়। যেমনটা হয়েছিল ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে।
ইংল্যান্ড প্রথমে কৃষি নির্ভর দেশ ছিল। সমাজ ব্যবস্থা ছিল কুটীর শিল্পমুখী।
হঠাৎ যন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে সমাজ পাল্টাতে শুরু করে। নগর কেন্দ্রিক, যন্ত্র নির্ভর সভ্যতার সৃষ্টি হয়। যন্ত্র এসে ইংল্যান্ডের মানুষদের জীবনকে করে তোলে আরামপ্রদ।
সাধারণ মানুষের বিলাসের বিভিন্ন সামগ্রী যন্ত্রের সাহায্যে তৈরী হতে থাকে। ইংল্যান্ডের জনগণের প্রতিটি দিন কাটতে থাকে আনন্দে আরামে।
আরও পড়ুন : ভগৎ সিং স্মরণীয় কেন
বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন আবিষ্কার –
মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে বিজ্ঞানের দান অপরিসীম। বিজ্ঞান না থাকলে হয়তো কোনোকিছুই সম্ভব হোতো না।
বিজ্ঞানকে নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাঁদেরকে আমরা বৈজ্ঞানিক বলি।
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব যদি না ঘটতো তাহলে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার গুলির কথা আমরা জানতেই পারতাম না। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে প্রকৃতিকে জয় করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়েছে।
প্রকৃতির আলো, বাতাস, বিদ্যুৎ, জল প্রভৃতি শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনেক যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছিল।
যে যন্ত্রগুলি ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের পক্ষে সত্যিই হিতকর ছিল।
কর্মসংস্থান তৈরী –
শিল্পের সাথে কর্মসংস্থানের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। কারণ শিল্পের প্রসার ঘটলেই কর্মসংস্থান হতে বাধ্য।
যেমনটা হয়েছিল ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের ফলে প্রচুর কারখানা গড়ে উঠেছিল।
আর এই কারখানাগুলিতে লোকে কাজ পাওয়ার ফলে কর্মসংস্থানের দরজা খুলে যায়।
শিল্পবিপ্লব এক নতুন সভ্যতার জন্ম দেয়। কর্মহীনতা বা বেকারত্ব মানুষকে দারিদ্র্যতার দিকে ঠেলে দেয়।
এইসময়টায় গোটা ইউরোপ জুড়ে জনসংখ্যাও প্রবলভাবে বাড়ছিল। এতো বেশি জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের জন্য দরকার ছিল কল-কারখানার।
শিল্প বিপ্লব এসে এই কর্মসংস্থানের পথকে সুগম করে দেয়।
সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব –
শিল্পবিপ্লবের এক শুভ ফল হোলো সমাজতন্ত্রবাদের উদ্ভব।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য দূর হয়। স্থাপিত হয় সমতা।
এই সমতা স্থাপনই সমাজতন্ত্রবাদের মূল কথা।
এই উদ্ভবের ফলে রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসে। অনেক দেশে সমাজতন্ত্রবাদ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গৃহীত হতে থাকে।
উপনিবেশের জন্ম –
শিল্পবিপ্লবের ফলে উপনিবেশ বিস্তারের প্রবণতা দেখা দেয়। এটি শিল্পবিপ্লবের একটি সুফল বলা যেতে পারে।
আগেই বলেছি ইংল্যান্ড ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত একটি দেশ। শিল্পবিপ্লব এই ইংল্যান্ডেই প্রথম হয়েছিল।
পরে ক্রমশ এই শিল্পবিপ্লব ইউরোপের জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়া প্রভৃতি দেশগুলিতে শুরু হয়।
শিল্পবিপ্লবের ফলে এই দেশগুলিতে প্রচুর পরিমাণে পণ্য উৎপাদন হতে শুরু করে। এইবার এই পণ্য সামগ্রীগুলি বিক্রির জন্য দরকার ছিল বড়ো বাজারের।
তাই ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের অন্য দেশগুলি এশিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশগুলিতে উপনিবেশ গড়ে তোলে।
অবাধে বিক্রি হতে থাকে ইউরোপের কারখানায় তৈরী পণ্যগুলি। শিল্পবিপ্লব জন্ম দিয়েছিল এই উপনিবেশের।
শিল্পবিপ্লবের কুফল
শিল্পবিপ্লবের ফলে শিল্পের প্রসার ঘটেছিল একথা সত্য। তবে এর পাশাপাশি শিল্পবিপ্লবের কুফলও দেখা যায়।
তাই এইবার দেখবো শিল্পবিপ্লবের ফলে কি কি কুফল এসেছিল।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য সমস্যা –
শিল্পবিপ্লবের ফলে পুরো ইউরোপ জুড়ে জনসংখ্যা আশ্চর্য ভাবে বৃদ্ধি পায়।
কারণ কল কারখানায় কাজের টানে ইউরোপের গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষ শহরে এসে ভিড় জমাতে থাকে।
ইংল্যান্ডে জনসংখ্যার হার ছিল সর্বাধিক। এতো বেশি জনসংখ্যার জন্য দরকার ছিল পর্যাপ্ত বাসস্থান, পানীয় জল, খাদ্য ইত্যাদির।
কিন্তু এগুলির একটাও ছিল না।
শিল্প শহর গুলিতে উপযুক্ত বাসস্থানের অভাবে বস্তি গড়ে ওঠে। এর ফলে নগর জীবনের অবনতি ঘটে।
বস্তির নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে এই বিপুল জনসংখ্যার লোকজন ও শ্রমিকেরা বাস করতে বাধ্য হয়।
বস্তির কর্দমাক্ত পরিবেশে খেটে খাওয়া শ্রমিকদের দিনগুলি কাটতে থাকে কষ্টের মধ্য দিয়ে।
শ্রমিকের দুর্দশা –
শিল্প স্থাপন থেকে শিল্প উৎপাদন ; দরকার হয় শ্রমিকের। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পর শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্রই সামনে আসে।
শ্রমিকদের সঠিক বাসস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় তাঁদের বাস করতে হোতো বস্তিতে। বস্তির দুর্গন্ধ, কাঁদা পাঁক পরিবেশে শ্রমিকদের জীবন কাটতো।
আনন্দহীন, একঘেয়ে জীবনকে একটু রঙিন করতে শ্রমিকেরা তাঁদের উপার্জন ব্যয় করতো ভাঁটিখানায়।
পরিবারের শিশুদের ভালো শিক্ষাদান করার সামর্থ্যও শ্রমিকদের ছিল না।
সারাদিন কারখানায় পরিশ্রম করার পর অল্প রোজগার, দারিদ্র, হতাশা শ্রমিকদের জীবনটাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়।
উদাহরণ হিসেবে ইংল্যান্ডের ওয়েলস ( Wales ) প্রদেশের কয়লাখনির শ্রমিকদের দুর্দশার বাস্তব চিত্র বহু উপন্যাসে বর্ণনা করা হয়েছে।
কুটির শিল্প ও কারিগরের অবনতি –
শিল্পবিপ্লবের আগে ইংল্যান্ড সহ গোটা ইউরোপে কুটির শিল্প চালু ছিল। কুটির শিল্পের কারিগরেরা নিজেদের হাতে বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য তৈরী করতেন।
এর থেকে এই কারিগরদের মোটামুটি একটা আয় হোতো। সময় বদলালো, যন্ত্রের আবিষ্কার ঘটলো।
যা কিছুর উৎপাদন সবই হতে লাগলো ওই যন্ত্রের মাধ্যমে। কুটির শিল্পের কারিগরেরা তাঁদের চিরাচরিত কাজ হারালেন।
তাঁরা বেকার হয়ে পড়লেন। এটি হোলো অর্থনৈতিক জীবনে শিল্পবিপ্লবের এক মারাত্মক কুফল।
কুটির শিল্পের কারিগরেরা কাজ হারিয়ে যন্ত্র, কারখানা এইসবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন।
জানা যায় যে, কুটির শিল্পের কারিগরেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ইংল্যান্ডে যন্ত্রগুলি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন। যন্ত্রের বিরুদ্ধে এই বিদ্রোহ লাডাইট রায়ট ( luddite riots ) নামে পরিচিত হয়।
শিশু শ্রমিকের উত্থান –
বিশ্বের প্রতিটি শিশু জাতির ভবিষ্যৎ। তাঁরা বড়ো হয়ে দেশ তথা জাতি গড়ার কাজ করবে।
আজও শিশুদের উদ্দেশ্যে বিশ্ব শিশু দিবস বা World children’s day পালিত হয় ২০ শে নভেম্বর।
কিন্তু শিশু শ্রম বা শিশু শ্রমিকের জন্ম সমাজে এক মারাত্মক অপরাধ। শিল্প বিপ্লবের সামাজিক কুফলের মধ্যে একটি ছিল শিশু শ্রমিকদের কারখানার কাজে লাগানো।
ইংল্যান্ডের শিল্প কারখানার মালিকরা অনাথ ভবঘুরে শিশুদের অর্থের বিনিময়ে কিনে নিয়ে বেগার খাটাতো।
ছোট্ট শিশুরা এই শ্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারতো না। অন্যদিকে কারখানার মালিকরা শিশুদের শ্রমকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা লুটতো।
পুঁজিবাদীর জন্ম ও শোষণ –
শিল্পবিপ্লব পুঁজিবাদের ( Capitalism ) জন্ম দেয়। শিল্প উৎপাদনে যাঁরা অর্থ বিনিয়োগ করে লাভ করতে লাগলো তারাই পুঁজিপতি ( Capitalist ) বা পুঁজিবাদী নামে পরিচিত।
এঁরাই ছিল অর্থে ফুলে ফেঁপে থাকা মালিকপক্ষ। কুটির শিল্পের ক্ষুদ্র উৎপাদকদের সাথে পুঁজিবাদীদের পার্থক্য ছিল উৎপাদন ব্যবস্থায়।
কুটির শিল্পের উৎপাদকরা চাহিদা মতো উৎপাদন করতো।
বেশি শিল্পদ্রব্য তৈরী ও প্রচুর বিক্রি করে মুনাফা লাভ করার সুযোগ তাদের ছিল না।
কিন্তু শিল্পবিপ্লব জন্ম দিল পুঁজিপতি শিল্প মালিকদের। এই পুঁজিপতিরা চাহিদা অপেক্ষা বেশি উৎপাদন ও বিক্রি করে মুনাফা কামিয়ে নিলো।
দেশের একচেটিয়া উৎপাদন ব্যবস্থা পুঁজিপতিদের হাতে চলে আসায় তারা ক্ষমতাশালী শ্রেণীতে পরিণত হয়।
এর সাথে বাড়লো এদের শোষণ। শ্রমিকদের কম মজুরী দিয়ে পুঁজিপতিরা আরও ধনী হতে থাকলো।
শ্রমিকরা হয়ে গিয়েছিল শোষণের বস্তু। কার্ল মার্ক্স-র মতে, ধনী আরও ধনী হোলো, গরীব হোলো আরও গরীব ।
গ্রামের গুরুত্ব হ্রাস –
শিল্পবিপ্লবের আগে পর্যন্ত ইউরোপ তথা ইংল্যান্ডের গ্রামগুলিতে অনেক লোকজন বাস করতো।
গ্রামগুলির আয়ের উৎস ছিল কৃষিকাজ ও ছোটো কুটির শিল্প থেকে আসা আয়। ইতিমধ্যে শিল্পবিপ্লব ঘটলো ইংল্যান্ড তথা ইউরোপ জুড়ে।
মানুষজন গ্রাম ছেড়ে, আসতে শুরু করলেন ইউরোপের শহরগুলিতে।
কারণ তাঁদের মনে হয়েছিল শহরের জীবন বোধ হয় আরামদায়ক। সবকিছুই হয়তো হাতের নাগালে পাওয়া যাবে।
দলে দলে লোক গ্রাম ছেড়ে শহরে আসায় গ্রামগুলি জনহীন হয়ে পড়ে। গ্রামগুলি তার জৌলুসতা হারায়।
ইংল্যান্ডের কল-কারখানা গুলিতে গ্রাম থেকে আসা মানুষগুলি হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে লাগলো।
শহরের আরামদায়ক জীবনের ভাবনায় তাঁদের ছেদ পড়লো। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের গ্রামগুলির গুরুত্ব হ্রাস পেতে থাকে।
উপসংহার –
এতকিছু আলোচনার পর বলা যেতে পারে যে, শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপে বিরাট পরিবর্তন ঘটে।
চাষি, শিল্পী, কারিগরেরা তাঁদের জীবিকা ছেড়ে কারখানায় যোগ দিয়ে শ্রমিকে পরিণত হয়।
সমাজে দুটি শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে পুঁজিপতি ও শ্রমিক-মজুর। এর ফলে শ্রেণী বৈষম্য দেখা দেয়।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এক সময় বলেছিলেন, ইংল্যান্ডের জনগণ সেই সময় দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল, যথা- ধনী ও দরিদ্র।
আরও পড়ুন : মুঘল ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা
আশা করি এই পোস্টটি পড়ে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ফলাফল সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে তোমার মতামত জানিও। আর অবশ্যই পোস্টটি অন্যদের সাথে শেয়ার কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। ভালো থেকো বন্ধু ….