ফরাসী বিপ্লবের (১৭৮৯) অর্থনৈতিক কারণ (Economic cause of French Revolution)
কেমন আছো বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভাল আছো।
আগের ব্লগে ফরাসী বিপ্লব ঘটবার রাজনৈতিক কারণ নিয়ে আলোচনা করেছি। যদি এখনও না পড়ে থাকো তাহলে অবশ্যই পড়ে নিও। আশা রাখি তুমি লেখাটি পড়ে উপকৃত হবে। তাহলে চলো এই বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণগুলি সম্পর্কে জানা যাক।
ফরাসী বিপ্লব ঘটবার জন্যে অর্থনৈতিক কারণকে নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে।
ঐতিহাসিক কার্লাইল রাজনৈতিক ক্ষোভকেই ফরাসী বিপ্লবের প্রধান কারণ বলেছেন। থিয়ার্স, মিনেত প্রমূখ ঐতিহাসিকরাও কার্লাইলের মতকেই সমর্থন করেছেন।
ঐতিহাসিক টেইন দার্শনিকদের প্রভাবকেই বিপ্লবের কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন।
কিন্তু এঁদের সবার থেকে আলাদা হয়ে ঐতিহাসিক জুলেস মিশেলই (Jules Michel) সর্বপ্রথম এই বিপ্লবের জন্যে অর্থনৈতিক কারণকে গুরুত্ব দিয়েছেন।
ফরাসী বিপ্লবের বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণগুলি হল —
আরও পড়ুন : https://iitihas.com/political-causes-of-the-french-revolution-in-bengali/
প্রত্যক্ষ কর দুর্নীতি
ফ্রান্সে তিনটি প্রধান কর ছিল। সেগুলি হল- টেইলি (সম্পত্তি কর ), ক্যাপিটেশন (উৎপাদন কর ), ভিংতিয়েমে (আয়কর ) । কিন্তু যাজক ও অভিজাতরা এই সম্পত্তি কর দিত না। এমনকি উৎপাদন কর, আয়করও তাঁরা এড়িয়ে চলত। ফলে তাঁদের না দেওয়া করের বোঝা চেপেছিল ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের ঘাড়ে। অথচ যাজক ও অভিজাতরাই ছিল ফ্রান্সের সম্পদের ৪০% মালিক। এইভাবে প্রত্যক্ষ কর ব্যবস্থায় দুর্নীতি ফ্রান্সের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
পরোক্ষ কর দুর্নীতি
প্রত্যক্ষ কর ছাড়াও ফ্রান্সে কিছু পরোক্ষ করও প্রচলিত ছিল। যেমন- গ্যাবেলা (লবণ কর ), করভি (বিনা মজুরীতে কাজ করা), বানালিতে ইত্যাদি। ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণীর মানুষরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুটোই কর দিত। সরকার, গীর্জা ও সামন্ত প্রভূদের এইসব কর দেওয়ার পর ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ তথা কৃষকদের হাতে কিছুই থাকতো না। পরোক্ষ করের এইরুপ ব্যবস্থার ফলে ফ্রান্সের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
সরকার ও রাজপরিবারের অপব্যয়
ফ্রান্সের অর্থনীতিতে অন্ধকার নেমে আসে সরকার ও রাজপরিবারের অতিরিক্ত অর্থ খরচের ফলে। কোষাগারের জমা অর্থ থেকেও কর্মচারীদের মাইনে, যুদ্ধের খরচ, রাজপরিবারের খরচ চালানো সম্ভব হত না। ঐতিহাসিক গুডউইন -এর মতে রাজপ্রাসাদের দেখভালের জন্যই প্রায় ১৬ হাজার কর্মীদের রাখা হয়েছিল। এরসাথে রাজা ও তাঁদের স্ত্রীদের ভোগবিলাস তো ছিলই। এই খরচ মেটাতে সরকারকে ঋণ নিতে হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল যুদ্ধের খরচও। জানা যায় যে এই ঋনের মোট পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি লেভ্ৰ। এই অতিরিক্ত খরচ বন্ধ করার অক্ষমতা সরকারের না থাকায় অর্থনীতি ভাঙ্গতে শুরু করে।
মুদ্রাস্ফীতি
এইসময় ফ্রান্সের লোকসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দ্রব্যমূল্যও বাড়তে থাকে। প্রচূর পরিমাণে সোনা ও রূপা আমেরিকা থেকে ফ্রান্সে এইসময় এসেছিল। বেশী পরিমাণে আসার ফলে ফ্রান্সে মুদ্রাস্ফীতি হয়; জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। খাদ্যবস্তুর দাম বাড়লেও খেটে খাওয়া গরীব শ্রমিক, দিন মজুরদের মজুরী কিন্তু বাড়েনি। ক্ষুধার্ত মানুষ রুটির জন্যে শহরের দিকে পালাতে আরম্ভ করে। ফ্রান্স অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। বিপ্লবের পথ তৈরি হয়।
ভূমিদাসদের করের দ্বারা নিপীড়ন
ভূমিদাস বা সার্ফ দের অবস্থান ছিল সবার নীচে। সামন্ত প্রভূদের কাছে সারাদিন খাটার পর তাঁদের ভাগ্যে জুটত করের বোঝা। একপ্রকার তাঁদেরকে নিপীড়ন করা হত। যে অন্যায্য করগুলি ভূমিদাসদের দিতে হত সেগুলি হল – টাইদ (ধর্মকর), স্যামপার্ট (ফসলের ভাগের কর), সেন্স (বছরের খাজনা), বানালিতে (গম পেষাই কলে গম ভাঙান ও সাথে মদ তৈরির বিনিময়ে কিছু দেওয়া) ইত্যাদি। জমিতে বেগার খাটার বিনিময়েও তাঁরা একটি কর দিত তার নাম করভি। এই শোষণের ফলে ভূমিদাসদের মধ্যে ক্ষোভ জন্মাতে থাকে। আর সেই ক্ষোভ থেকে জন্ম নেয় বিপ্লব।
সাঁকুলেত শ্রেণীর হতাশা
ফ্রান্সের তৃতীয় শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে একধরণের ভবঘুরে শ্রমজীবি লোক ছিল। ফ্রান্সে এদেরকে বলা হত সাঁকুলেত (Sans-Culottes) | এরা মূলত গ্রাম থেকে শহরে আসা ছিন্নমূল মানুষ। সাঁকুলেত দের দুর্দশার সীমা ছিল না। কাজ থেকে ছাঁটাই, বেকারত্ব ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। এদের মধ্যে ছিল ক্ষুধার জ্বালা, দারিদ্রতার হতাশা। সমাজের উচ্চ শ্রেণীর বঞ্চনার শিকার ছিল তাঁরা। এই দরিদ্র শ্রেণীর হারাবার কিছুই ছিল না। মজুরির হার কিছুটা বাড়লেও খাদ্যদ্রব্যের দাম প্রচন্ড হারে বেড়েছিল। তাই সাঁকুলেত দের হাতে আর কিছুই থাকত না। এরাই ফরাসী বিপ্লবের বারুদ হিসাবে কাজ করেছিল।
উপসংহার
পরিশেষে বলা যায় যে, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। বিভিন্ন অন্যায্য কর তাঁদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল তাঁদের। তাই ক্ষুধার্ত জনতা তাঁদের ক্ষোভ উগড়ে দেয় ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে। তাই ঐতিহাসিক জুলেস মিশেল বলেছেন যে, ফরাসী বিপ্লবের প্রকৃত নায়ক ছিল দরিদ্র, ক্ষুধার্ত জনতা। অবশ্যই এই ক্ষোভ অসন্তোষ ছিল অর্থনৈতিক।
লেখাটি পড়ে তোমার কেমন লাগলো তুমি কমেন্ট করে নিশ্চয়ই জানাবে। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার। ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো।
Hi
পোস্টটি যে পড়েছেন এর জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন …
লেখাটি সহজ ও সুন্দর হয়েছে। এক নজরে যে কোনো উৎসাহী পাঠক বিষয়টির উপর সামগ্রিক ধারণা লাভ করবেন। অসংখ্য ধন্যবাদ।
পড়বার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।