হজরত মুহাম্মদ ( সা:) কে ছিলেন (Who was Hazrat Muhammad)
প্রতিটি ধর্মেরই ধর্মপ্রচারকগণ এই পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন যুগে যুগে। যেমন খ্রিষ্টধর্মের প্রচার ঘটিয়েছেন যীশুখ্রিস্ট, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ঘটিয়েছেন গৌতম বুদ্ধ, জৈন ধর্মের প্রচার ঘটিয়েছেন মহাবীর জৈন।
ঠিক তেমনই ইসলামের প্রচারক হিসেবে ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন হজরত মুহাম্মদ ( সা:)। গোটা বিশ্বে ইসলাম ধর্মের বাণীকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি মানব সভ্যতার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন।
তবে তাঁর পৃথিবীতে আবির্ভাবের সময়টি সত্যিই কঠিন পরিস্থিতিময় ছিল। সেইসময় একদিকে যেমন রোমের পতন ঘটেছে , তেমনি গোটা এশিয়া-ইউরোপ জুড়ে দূর্ধর্ষ হুনেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
ভারতে গুপ্ত শাসনের দিনও ফুরিয়ে এসেছে। রোম সাম্রাজ্যকে ভেঙ্গে প্রায় তছনছ করে দিয়েছে বিভিন্ন উপজাতিরা। গ্রিকদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঐতিহ্য ইউরোপের মানুষজন প্রায় ভুলতে বসেছিলেন।
ঠিক এই পরিস্থিতিতে আবির্ভাব ঘটেছিল হজরত মুহাম্মদের ( সা:)। তিনি শেষ নবী বা শেষ পয়গম্বর। তাই এই পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করবো হজরত মহম্মদ কে নিয়ে। জানতে হলে এই পুরো পোস্টটি পড়তে হবে।
হজরত মুহাম্মদ (সা:)-র জন্ম
ইসলামি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিয়াল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ হজরত মুহাম্মদের ( সা:) জন্ম হয়। দিনটি ছিল সোমবার।
জন্মেছিলেন আরবের মরুশহর মক্কায়। মক্কা বর্তমানে সৌদি আরবের হেজাজ প্রদেশের অন্তর্গত।
হজরত মুহাম্মদের ( সা:) পিতা ও মাতার নাম
হজরত মুহাম্মদের ( সা:) পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। জন্মাবার আগেই তিনি নিজের বাবাকে হারিয়েছিলেন। আর মাকে হারিয়েছিলেন, যখন হজরত মুহাম্মদের ( সা:) বয়স ছিল মোটে ৬ বছর।
হজরত মুহাম্মদের (সা:) ছোটোবেলা
বাবা-মাকে অতি অল্প বয়সে হারিয়ে হজরত মুহাম্মদ ( সা:) হয়ে পড়েছিলেন অভিভাবকহীন।
এই অসহায় অবস্থায় তাঁর বাবা-মায়ের ভূমিকা নিয়েছিলেন কাকা আবু তালিব। একজন সন্তান তাঁর শৈশবে বাবা-মায়ের কাছ থেকেই শিক্ষা লাভ করে থাকে।
কিন্তু হজরত মুহাম্মদ ( সা:) সেদিক থেকে ছিলেন বঞ্চিত। কিন্তু তাঁর চারিত্রিক সততার কারণে তিনি মক্কাবাসীর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন।
লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় ছোটো বয়সে তিনি মেষ চরিয়েছেন। এমনকি কাকা আবু তালিবের সাথে ব্যবসাতেও সাহায্য করেছেন।
হজরত মুহাম্মদের ( সা:) বৈবাহিক জীবন
যৌবনে হজরত মুহাম্মদ ( সা:) হজরত খাদিজা (রা:) নামে এক মহিলার ব্যবসা দেখাশোনার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন। এখানেও হজরত মুহাম্মদ ( সা:) তাঁর সততা বজায় রেখেছিলেন।
মালকিন হজরত খাদিজা ( রা:) হজরত মুহাম্মদ-র ( সা:) সততায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। হজরত মুহাম্মদ ( সা:) প্রথমে ইতস্ততঃ বোধ করলেও পরে এই প্রস্তাব মেনে নেন।
শোনা যায় হজরত খাদিজা ( রা:) হজরত মুহাম্মদের ( সা:) থেকে বয়সে অনেক বড়ো ছিলেন।
হজরত মুহাম্মদের ( সা:) সন্তান-সন্ততি
হজরত মুহাম্মদ ও খাদিজার ( রা:) প্রথম পুত্র সন্তান ছিলেন কাসেম। কাসেমের নামেই হজরত মুহাম্মদের ( সা:) আরেকটি উপনাম হয়েছিল আবুল কাসেম।
এরপর একে একে হজরত মুহাম্মদের ( সা:) কন্যা সন্তানরা জন্মেছিলেন খাদিজার ( রা:) গর্ভে।
এঁরা হলেন জয়নব, রুকাইয়া, উম্মে কুলছূম, ফাতেমা। হজরত মুহাম্মদের ( সা:) সর্বশেষ পুত্র সন্তান ছিলেন আবদুল্লাহ।
আরও পড়ুন : ভারতীয় রাজ নর্তকীদের ইতিহাস
স্ত্রী খাদিজার ( রা:) মৃত্যুর পর হজরত মুহাম্মদ ( সা:) তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মারিয়া কিবতিয়া কে বিবাহ করেছিলেন। এই কিবতিয়ার গর্ভে ইব্রাহিম নামে হজরত মুহাম্মদের ( সা:) এক পুত্র সন্তান জন্মেছিল।
আল্লাহর বাণী লাভ
আরববাসীদের মধ্যে পৌত্তলিকতা বা মূর্তি পূজার প্রচলন থাকায় হজরত মুহাম্মদ ( সা:) এর বিরোধী ছিলেন। এছাড়াও মানুষকে কিভাবে পাপ করা থেকে, অন্যায় করা থেকে বিরত রাখা যায় তার জন্য তিনি সবসময় ভাবতেন।
বলা যেতে পারে এটাই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। হজরত মুহাম্মদের ( সা:) বয়স যখন ৩৫ বছর তখন তিনি মক্কার হেরা নামক এক পাহাড়ের গুহায় নিবিড় ধ্যানে মগ্ন থাকতেন।
আর একদিন এই হেরা গুহাতেই ফেরেস্তা জিবরাইল-র দ্বারা আল্লাহর বাণী লাভ করলেন হজরত মুহাম্মদ ( সা:)। সময়টা ছিল আনুমানিক ৬১০ খ্রিস্টাব্দ।
বাণীতে আল্লাহ হজরত ( সা:) বা রাসূল কে বলেছিলেন, জ্ঞানের মাধ্যমে রক্তকণা থেকে তৈরী মানুষ আল্লাহর সন্ধান লাভ করুক।
হজরত মুহাম্মদ (সা:)-র ইসলাম ধর্মের প্রচার
আল্লাহর বাণী লাভ করার পর হজরত মুহাম্মদের ( সা:) একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায় আল্লাহর বাণী সবার মধ্যে প্রচার করা। অর্থাৎ ইসলামকে প্রচার করা।
শুরুটা হজরত খাদিজাকে ( রা:) দিয়েই হয়েছিল। হজরত খাদিজাই ( রা:) প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন।
এরপর খাদিজার ( রা:) ঘনিষ্ঠরাও ইসলামকে গ্রহণ করে নিলেন। বলে রাখি হজরত মুহাম্মদ ( সা:) ছিলেন কোরেশ বংশীয়।
কিন্তু এই কোরেশরাই হজরতের ( সা:) ইসলাম প্রচারের প্রধান বিরোধী হয়ে উঠেছিল। শোনা যায় আবিসিনিয়ার রাজা নাজাসি-ও নাকি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।
মিরাজ ও হিজরত
একদিকে হজরতের ( সা:) নিজের কোরেশরা যখন ইসলাম প্রচারে বাধা দিচ্ছে , ঠিক সেইসময় হজরত মুহাম্মদের ( সা:) জীবনে ঘটেছিল দুটো বিপর্যয়। প্রথমটি কাকা আবু তালেবের মৃত্যু।
এবং দ্বিতীয়টি হজরত খাদিজার ( রা:) মৃত্যু। কোরেশদের অত্যাচার আরও বাড়লো। ঠিক একদিন রাতে হজরত মুহাম্মদের ( সা:) মিরাজ অভিজ্ঞতা ঘটে।
এর অর্থ আকাশে আল্লাহর কাছে তিনি পৌঁছেছিলেন সেইদিন। তবে অনেকে মিরাজকে আত্মার সফর বলেও মনে করে থাকেন। মক্কার প্রতিবেশী শহর ছিল মদিনা।
ইতিমধ্যে কোরেশরা হজরত মুহাম্মদকে ( সা:) হত্যার ষড়যন্ত্র করে। হজরত তা জানতে পেরে বন্ধু আবু বকর-কে সাথে নিয়ে মক্কা ছেড়ে মদিনার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেন।
মদিনার কুবা নামক একটি জায়গায় গড়ে তোলেন ইসলামের প্রথম মসজিদটি। ৬২২ সালে হজরত মুহাম্মদের ( সা:) মক্কা ছেড়ে মদিনায় যাওয়ার বছরটি হিজরত নামে পরিচিত।
হিজরত শব্দের অর্থ দেশত্যাগের বছর। হিজরতের সময় থেকেই শুরু হোলো ইসলামি ক্যালেন্ডারের গণনা।
মদিনা আক্রমণ ও যুদ্ধ
মক্কার কোরেশরা হজরত মুহাম্মদের ( সা:) ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে মদিনা আক্রমণ করে। এটি ইসলামের ইতিহাসে বদর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধ ছিল এক অসম লড়াই।
কারণ কোরেশদের সৈন্যবলের কাছে হজরতের ( সা:) সৈন্য ছিল খুব নগণ্য। যুদ্ধের সরঞ্জামও ছিল কোরেশদেরই বেশি। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও জয় হোলো ন্যায়ের, আত্মবিশ্বাসের।
কোরেশরা হজরত মুহাম্মদের ( সা:) সৈন্যদলের কাছে হেরে গেলো। এর পরবর্তী উহুদের যুদ্ধেও কোরেশরা আবার পরাস্ত হোলো মুসলমানদের কাছে।
এরপর হজরত মুহাম্মদ ( সা:) মক্কায় গিয়ে হজ পালন করবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু কোরেশরা তাকে মক্কায় ঢুকতে বাধা দিলে কোরেশদের সাথে তাঁর শান্তি চুক্তি হয়।
হুদায়বিয়া নামে জায়গাতে এই চুক্তিটি হয়েছিল। তাই এর নাম হোলো হুদায়বিয়া সন্ধি বা চুক্তি। কিন্তু কোরেশরা এই চুক্তি ভঙ্গ করায় হজরত ( সা:) ১০ হাজার সৈন্য নিয়ে মক্কা আক্রমণ করেন এবং লড়াইতে তিনি জয়ী হন।
জয় হোলো ইসলামের। মক্কার কাবায় দেবদেবীদের যে সমস্ত মূর্তি ছিল তা হজরতের ( সা:) নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল।
কারণ হজরত ( সা:) প্রথম থেকেই মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন। কাবা ঘর পবিত্র হয়ে সেখানে আল্লাহর উপাসনা শুরু হোলো।
হজরত মুহাম্মদের ( সা:) শেষ জীবন
মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি সেখানেই জীবনের শেষ হজ-টি করেছিলেন। মদিনায় যখন হজরত ( সা:) ফিরলেন তখন তিনি অসুখে আক্রান্ত।
মৃত্যুকালেও তাঁর কাছে সম্পত্তি বলতে ছিল একটিমাত্র খচ্চর ও একটু জমি। তাও তিনি দান করে দিয়েছিলেন।
সাদাসিধা আড়ম্বরহীন জীবন যাপন ছিল তাঁর। জানা যায় শুধু কিছু খেজুর ও জল খেয়েই নাকি দিনগুলি কাটাতেন।
অবশেষে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের রবিয়াল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ মাত্র ৬২ বছর বয়সে হজরত মুহাম্মদ ( সা:) মারা যান বা তাঁর ইন্তেকাল ঘটে।
আরও পড়ুন : মুঘল সম্রাট হুমায়ুন
” আশা করি এই পোস্টটি পড়ে হজরত মুহাম্মদ সম্পর্কে তুমি অনেক কিছু জানতে পারলে। যদি এবিষয়ে তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি অন্যদের সাথে Share কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। ”