ওয়ারেন হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিসের বিচার সংস্কার । Warren Hastings & Cornwallis Reforms in bengali

কেমন আছো বন্ধু ? আশা করি নিশ্চই ভাল আছো। ওয়ারেন হেস্টিংস , কর্নওয়ালিস এরা কারা ছিলেন জানো ? এরা প্রত্যেকেই ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল। এর মধ্যে ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন বাংলার প্রথম গভর্নর জেনারেল। 

নবাবি আমলের বাংলায় ফৌজদারি বিচার চলত মুসলিম আইন অনুযায়ী। প্রতন্ত গ্রামে কোনো নিয়মিত আদালত ছিল না। কোনো বিরোধ দেখা দিলে সালিশির মাধ্যমে তা মেটানো হত। 

মুসলিম আইনের ফতোয়া বা ব্যাখ্যা দিতে এবং বিভিন্ন ফোজদারি মামলার রায় দিতেন কাজি। অপরাধ দেখে শাস্তি হিসাবে দেওয়া হত বেতের আঘাত , কারাদণ্ড , অঙ্গচ্ছেদ প্রভৃতি। 

১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের পর (ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনব্যবস্থা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চায়। ১৭৭২ সালে পুরোপুরি শাসনভার নিজেদের হাতে নেয়। 

তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings) 

হেস্টিংসের নজরে আসে যে সেইসময় বাংলাদেশে কোনো সুষ্ঠূ বিচারব্যবস্থা ছিল না। দরকার ছিল একটা স্থায়ী বিচার বিভাগীয় সংস্কারের। ওয়ারেন হেস্টিংস মন দিলেন সেইকাজে। 

হেস্টিংসের পরে লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলায় গভর্নর জেনারেল হয়ে আসলে তিনিও কিছু বিচার বিভাগের সংস্কার করেছিলেন। তাহলে দেখা যাক এদের বিচার বিভাগীয় সংস্কার গুলো। 

হেস্টিংসের সংস্কার (Reform of Hastings) :

ওয়ারেন হেস্টিংস বিচার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন। তিনি প্রতিটা জেলায় একটি করে দেওয়ানী আদালত ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করেন। কলকাতায় দুটি উচ্চ আদালত গঠন করা হয়েছিল। এগুলি ছিল সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিজামত আদালত। 

দেওয়ানি আদালত গুলিতে দেওয়ানি বিচারের ভার ছিল কালেক্টর দের হাতে। 

অন্যদিকে ফৌজদারী আদালত গুলিতে ফৌজদারী বিচারের ভার ছিল দেশীয় বিচারকদের উপর। 

১৭৭৪ সালে জেলার দেওয়ানি আদালতগুলি পরিচালনার জন্য আমিল নামে একধরণের ভারতীয় কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল। আমিলের বিচারে অসন্তুষ্ট হলে যে কেউই প্রাদেশিক কাউন্সিলের (Provincial Council) কাছে আবেদন করতে পারত। 

১৭৭৫ সালে সদর নিজামত আদালতকে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়। সদর নিজামত আদালতের প্রধান ছিলেন বাংলার নবাব মনোনীত একজন বিচারক। নায়েম নাজিম নামে ভারতীয়র উপর এই আদালতের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। 

১৭৮১ সালে এই দেওয়ানি আদালতগুলির সংখ্যা বাড়িয়ে আঠারো করা হয়। এর মধ্যে ৪টি কালেক্টররা পরিচালনা করতেন। আর বাকি ১৪টি ইউরোপীয় বিচারকদের দায়িত্বে ছিল। 

দেওয়ানি বিচারের জন্য ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে একটি হিন্দু আইনবিধি রচিত হয় এবং ইংরেজিতেও অনুবাদ হয়েছিল। একইসাথে মুসলিম আইনবিধিও রচিত হয়েছিল ও সেটিকেও ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।  

ওয়ারেন হেস্টিংসের ওপর প্রধান দায়িত্ব ছিল বাংলায় দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটানো। আর সেইসাথে বাংলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। ১৭৭২ সালে বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়ে প্রথমেই তিনি দ্বৈত শাসনের বিলুপ্তি ঘটান। 

দ্বৈত শাসনের অর্থ হল বাংলার নবাব ও দিল্লির সম্রাটের মিলিত শাসন। হেস্টিংস এদের সাথে সমস্ত চুক্তি বাতিলের ঘোষণা করেন। 

অত্যাচারী সীতাব রায়রেজা খাঁ এই দুইজন ছিলেন রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে। হেস্টিংস সীতাব রায় ও রেজা খাঁকে পদচ্যুত করে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব কোম্পানির হাতে দিয়ে দেন। এই রাজস্ব আদায় করার জন্য প্রতিটি জেলায় একজন করে ইংরেজ কালেক্টর তিনি নিয়োগ করেন। 

এছাড়াও রাজস্ব ব্যবস্থা তদারকির জন্য হেস্টিংস একটি রেভিনিউ বোর্ডও স্থাপন করেছিলেন। 

কর্নওয়ালিসের সংস্কার (Reform of Cornwallis) : 

ওয়ারেন হেস্টিংসের পর বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর জেনারেল হন কর্নওয়ালিস। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হন। লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনকালেও বিচারব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার করা হয়। 

কর্নওয়ালিস রাজস্ব বিভাগ ও বিচার বিভাগকে পৃথক করেন। কালেক্টরদের বিচার ক্ষমতা লোপ করা হয়। কালেক্টররা রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি করতে পারতেন না। কর্নওয়ালিসের আমলে রাজস্ব সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির দায়িত্ব রাজস্ব পরিষদ বা Board of Revenue-এর হাতে অর্পণ করা হয়েছিল। 

প্রতিটি জেলায় একজন করে ইংরেজ জজের অধীনে জেলা আদালত গড়ে তোলা হয়। প্রত্যেক প্রাদেশিক আদালতে তিনজন করে ইংরেজ বিচারক নিযুক্ত হন। 

লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে কলকাতা , ঢাকা , পাটনা ও মুর্শিদাবাদে চারটি ভ্রাম্যমান আদালত গঠন করা হয়। আদালতের বিচারকগণ বছরে দুবার নিজেদের এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিচারের কাজ গুলি করতেন। 

বিচারের সময় তারা এদেশের হিন্দু ও মুসলমান কর্মচারীদের সাহায্য নিতেন। 

কর্নওয়ালিস সদর নিজামত আদালত মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় সরিয়ে এনেছিলেন। এর ফলে সদর নিজামত আদালতের ওপর নবাবের কর্তৃত্ত্ব লোপ পায়। 

এইসময় জেলা আদালতের বাইরে অনেকগুলি নিম্ন আদালতও গঠিত হয়েছিল। সর্বনিম্ন আদালত ছিল মুনসিফের আদালত। যেখানে ৫০ টাকা পর্যন্ত মামলাগুলি চলত। 

তুমি কি জানো যে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের জনক হিসাবে কর্নওয়ালিস ইতিহাসে পরিচিত। ভারতীয় শাসন ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য সুশিক্ষিত , দক্ষ , বুদ্ধিমান রাজকর্মচারী নিযুক্ত করার প্রথাই ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (Indian Civil Service) নামে পরিচিতি পেয়েছে। 

কর্নওয়ালিস চেয়েছিলেন শিক্ষিত , কাজে দক্ষ কর্মচারীদের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিতকে মজবুত করতে। 

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে কর্নওয়ালিস কোড প্রণয়ন করা হয়। এতে কর্নওয়ালিসের শাসন ও বিচার সংস্কারগুলি লিপিবদ্ধ হয়েছিল। দেশের ভিতর সুশাসন নিয়ে আসাই ছিল কোডের প্রধান উদ্দেশ্য। 

হেস্টিংস যখন ভারতে আসেন তখন এখানকার পুলিশ ব্যবস্থা সুগঠিত ছিল না। লর্ড কর্নওয়ালিস পুলিশ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করেন। তুমি কি জানো যে ভারতে এই আধুনিক পুলিশ ব্যবস্থার ভিত কর্নওয়ালিস -ই গড়েছিলেন। 

তিনি প্রত্যেক জেলাগুলিতে একাধিক থানা স্থাপন করেছিলেন। থানাগুলির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল দারোগা দের ওপর। কলকাতা শহরের জন্য একজন পুলিশ কমিশনারও নিয়োগ করা হয়েছিল।

তিনি আগের প্রচলিত মুঘল শাসন ব্যবস্থাকে বর্জন করেন। তার পরিবর্তে তিনি ব্রিটিশ ভারতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আইনের শাসনের দ্বারা কর্নওয়ালিস সবাইকে আইনের অধীনে নিয়ে আসেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সমস্ত কর্মচারীদের এই আইন মেনে চলতে বাধ্য করেছিলেন। 

তবে ভারতীয়দের কাজের দক্ষতা নিয়ে তিনি হীন ধারণা পোষণ করতেন। তাইতো উচ্চপদ গুলিতে তিনি ভারতীয়দের নিয়োগ করেননি। উচ্চপদ গুলিতে ইউরোপীয় কর্মচারীদের তিনি নিয়োগ করেছিলেন। এর ফলে ভারতীয়রা সুযোগ ও মর্যাদা লাভে বঞ্চিত হয়।

তাই সবশেষে বলা যায় ভারতের বিচার ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ঘটিয়েছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস ও কর্নওয়ালিস। পুরোনো মুঘল বিচার ব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক সুগঠিত আধুনিক বিচার ব্যবস্থা।

লেখাটি পড়ে তোমার কেমন লাগলো তুমি কমেন্ট করে নিশ্চয়ই জানাবে। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার।  ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো। 

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!