শিখ ধর্মের উত্থান ( The rise of Sikhism )
ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্ম ও ভাষাভাষীর দেশ। হিন্দু , বৌদ্ধ, জৈন, ইসলাম ইত্যাদি ধর্মের পাশাপাশি শিখ ধর্ম ভারতে বিদ্যমান। এই শিখদের উত্থান ( The rise of Sikhism ) হোলো কিভাবে।
সময়টা পঞ্চদশ – ষোড়শ শতাব্দী। সেইসময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভক্তিবাদী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
এই ভক্তিবাদী আন্দোলন থেকেই জন্ম নেয় শিখ ধর্ম ( Sikh Religion) । পাঞ্জাবে ভক্তিবাদী ধর্মীয় আন্দোলন শুরু করেছিলেন গুরু নানক।
বলা যায় শিখ ধর্মের প্রবর্তক বা প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গুরু নানক ( Guru Nanak )।
শিখ ধর্মে জাতিভেদ, ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনো স্থান ছিল না। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বোধের ওপর শিখধর্ম অটুট হয়েছিল। আজও সেই ধারা বয়ে চলেছে শিখদের মধ্যে।
আশা করি শিখ ধর্মের উত্থান বা শিখ ধর্মের ইতিহাস জানতে পোস্টটি খুবই সহায়ক হবে। তাই পুরো পোস্টটি পড়বার অনুরোধ রইলো।
শিখ ধর্মের গুরুগণ ( The rise of sikhism )
শিখ ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন গুরু নানক ( Guru Nanak )। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শকে পাথেয় করে শিখধর্মের উৎপত্তি হয়।
গুরু নানকের মৃত্যুর পর শিখ ধর্মকে পরবর্তী নয়জন শিখ গুরু এগিয়ে নিয়ে যান। এই নয়জন গুরু হলেন –
গুরু অঙ্গদ , গুরু অমরদাস , গুরু রামদাস , গুরু অর্জুন , গুরু হরগোবিন্দ , গুরু হররায় , গুরু হারকিষেণ , গুরু তেগবাহাদুর , গুরু গোবিন্দ সিংহ।
এঁদের সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হোলো।
১) গুরু নানক ( Guru Nanak )
i) জন্ম ও পরিচয়
শিখদের দশ গুরুর মধ্যে প্রথম গুরু ছিলেন গুরু নানক। গুরু নানকের জন্ম হয় ১৪৬৯ ( 1469 ) খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের নানকানা সাহিব ( Nankana Sahib ) -র তালবন্দী গ্রামেতে।
বাবার নাম ছিল মেহতা কালু ( Mehta Kalu ) এবং মায়ের নাম ছিল মাতা তৃপ্তা ( Mata Tripta )। গুরু নানকের ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম হলেও, ছোটো থেকেই তিনি সাধনাতেই মগ্ন থাকতেন।
অল্প বয়সে সংসার পরিজন ত্যাগ করে শ্রীলংকা, বাগদাদ, মক্কা প্রভৃতি স্থানে ভ্রমণ করেন। ধর্মের সত্যতা জানতে।
গুরু নানক জাতিভেদ , মূর্তিপূজা , ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরোধী ছিলেন। ধর্মের কুপ্রথা , গোঁড়ামিকে দূর করে প্রতিষ্ঠা করলেন একেশ্বরবাদী শিখ ধর্মের।
ii) শিখ কারা
গুরু নানকের অনুগামীরা এই ধর্মকে অনুসরণ করায় তাঁরা পরিচিত হলেন শিখ নামে। শিখ -র বাংলা অর্থ শিষ্য। অর্থাৎ যাঁরা গুরু নানকের শিষ্য তাঁরাই শিখ।
iii) নানক জয়ন্তী
বর্তমানে প্রতিবছর অক্টোবর – নভেম্বর মাসে শিখরা গুরু নানক জয়ন্তী ( Guru Nanak Jayanti ) পালন করে থাকে।
এই দিনটিকে শিখরা গুরু নানকের জন্মদিন ( Guru Nanak birthday; In 2022, 553 Guru Nanak birth anniversary ) হিসেবে পালন করেন।
২) গুরু অঙ্গদ ( Guru Angad )
i) জন্ম
গুরু নানকের মৃত্যুর পর শিখদের দ্বিতীয় গুরু অঙ্গদ শিখ গুরুপদে বসেন ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে। গুরু অঙ্গদ পাঞ্জাবের হারিকে ( Harike ) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি শিখদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে প্রয়াসী হন। শিখরা পরিণত হন ধর্মসম্প্রদায়ে।
ii) গুরুমুখী অক্ষর প্রচলন
বর্তমানে শিখরা পড়তে লিখতে যে অক্ষর ব্যবহার করে তা হোলো গুরুমুখী অক্ষর।
তুমি কি জানো, গুরু অঙ্গদ এই গুরুমুখী অক্ষর ( Gurumukhi Alphabet ) বা ভাষার প্রবর্তন করেছিলেন।
এছাড়াও গুরু অঙ্গদ বিভিন্ন স্থানে গুরু কা লঙ্গর ( Gurudwara ) গড়ে তোলেন।
আরও পড়ুন : মৌর্য যুগের শিল্পকলা
৩) গুরু অমরদাস ( Guru Amardas )
i) জন্ম
গুরু অমরদাস ছিলেন শিখদের তৃতীয় গুরু। গুরু অঙ্গদ – র দেহাবসানের পর ১৫৫২ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে শিখদের গুরুপদের দায়িত্ব নেন।
গুরু অমরদাস জন্মেছিলেন পাঞ্জাবের অমৃতসর ( Amritsar ) গ্রামেতে। তাঁর আমলে শিখ সংগঠনের শক্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ii) শিখ পন্থ
গুরু অমরদাস শিখদের সম্প্রদায়তে ভাগ করেছিলেন। সম্প্রদায় অর্থাৎ শিখ পন্থ। মোট বাইশটি মঞ্জিতে ( Manjis ) শিখ সম্প্রদায় বা পন্থ বিভক্ত হয়।
মঞ্জি গুলির দায়িত্ব থাকতো সৎ, একনিষ্ঠ কোনো শিখ ব্যক্তির ওপর। গুরু অমরদাস আনন্দ ( Anand ) নামে কিছু স্তোত্র রচনা করেছিলেন।
শিখদের বিবাহ ( Sikh Wedding ) অনুষ্ঠানের সময় এই স্তোত্র গান হিসেবে গাওয়া হয়। যাঁর নাম আনন্দ কারাজ ( Anand Karaj )।
৪) গুরু রামদাস ( Guru Ramdas )
শিখ সম্প্রদায়ের চতুর্থ গুরু রামদাস পাকিস্তানের লাহোরে (Lahore ) জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে শিখ গুরুপদে বসেন।
গুরু রামদাস শিখদের পবিত্র শহর পাঞ্জাবের অমৃতসরে স্বর্ণমন্দির – র ( Amritsar Golden Temple ) ভিত্তি নির্মাণ করেন। অমৃতসর নামটি এসেছে অমৃত সরোবর ( Amritsar lake ) থেকে |
সম্রাট আকবর শিখ গুরু রামদাস কে জমি দান করেছিলেন অমৃতসরে। সেই জমির ওপর অমৃত সরোবর নামে একটি জলাশয় খনন করেছিলেন গুরু রামদাস।
এই সরোবরের তীরেই অমৃতসর স্বর্ণমন্দির গড়ে ওঠে।
৫) গুরু অর্জুন ( Guru Arjun )
শিখ সম্প্রদায়ের পঞ্চম গুরু হলেন গুরু অর্জুন। গুরু রামদাসের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গুরু অর্জুন শিখ গুরুপদে আসীন হন। সময়কাল ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দ।
গুরু রামদাসের খনন করা অমৃত সরোবরের মাঝে গুরু অর্জুন হরমন্দির সাহিব ( Harmandir Sahib ) তৈরি করেন। এই হরমন্দির সাহিব – ই আজকের অমৃতসর স্বর্ণমন্দির।
i) শিখধর্মগন্থ গ্রন্থসাহেব
স্বর্ণমন্দিরের চূড়া সোনা দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন শিখ রাজা রঞ্জিত সিংহ ( Ranjit Singh )। গুরু অর্জুন শিখদের ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থ সাহেব ( Granth Sahib ) রচনা করেন।
গুরু নানকের বাণী সংকলিত শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থের নাম গ্রন্থ সাহেব। গ্রন্থ সাহেব গুরুমুখী পাঞ্জাবি ভাষায় রচিত।
তবে পাঞ্জাবি ছাড়াও সংস্কৃত, হিন্দি, ফার্সি প্রভৃতি ভাষাও গ্রন্থ সাহেবে ব্যবহার হয়েছে। জানা যায় যে, গুরু অর্জুন জাহাঙ্গীরের বিদ্রোহী পুত্র খসরুকে তাঁর কাছে স্থান দেন।
এই অপরাধে গুরু অর্জুন বন্দী হন এবং তাঁকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। গুরু অর্জুন -র এই হত্যা শিখদের কে ক্ষুব্ধ করে তোলে। এখান থেকেই শুরু হয় শিখ ও মুঘলদের শত্রুতা।
৬) গুরু হরগোবিন্দ ( Guru Hargobind )
ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিখ গুরুপদ গ্রহণ করেন। গুরু হরগোবিন্দ সাচ্চা বাদশাহ ( Saccha Badshah ) উপাধি নিয়েছিলেন।
গুরু হরগোবিন্দ হরমন্দির সাহিব বা স্বর্ণমন্দিরে অকাল তখ্ত – র ( Akal Takht founder ) প্রতিষ্ঠাতা।
তাঁর আমলে শিখদের সামরিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর হরগোবিন্দ কে গোয়ালিয়র দুর্গে ( Gwalior Fort ) বন্দী করে রেখেছিলেন।
হরগোবিন্দের নেতৃত্বে শিখ ও মুঘলদের মধ্যে কার্তারপুর ও অমৃতসরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।
৭) গুরু হররায় ( Guru Harrai )
গুরু হররায় শিখদের সপ্তম গুরু হিসেবে পরিচিত। ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিখদের গুরুপদের দায়িত্ব নেন।
৮) গুরু হরকিষেণ ( Guru Harkishen )
গুরু হরকিষেণ যিনি শিখদের অষ্টম গুরু। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি শিখদের গুরু পদে বসেন। এঁদের সময়েও শিখ ও মুঘলদের সম্পর্ক তিক্তপূর্ণ ছিল।
৯) গুরু তেগবাহাদুর ( Guru Tegh Bahadur )
গুরু তেগবাহাদুর শিখদের নবম গুরু। ১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে শিখ গুরুপদে আসীন হন। গুরু তেগবাহাদুরের আসল নাম ছিল ত্যাগ মাল ( Guru Teghbahadur originally called Tyag Mal )।
নবম গুরু তেগবাহাদুরের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় তিনি সম্রাট ঔরঙ্গজেবের ( Aurangzeb ) কোপের মুখে পড়েন। মুঘল – শিখ সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটে।
ঔরঙ্গজেব তেগবাহাদুরকে বন্দী করেন এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের আদেশ দেন। কিন্তু গুরু তেগবাহাদুর শিখ ধর্মের প্রতি নিজের বিশ্বাস অটুট রাখেন।
ঔরঙ্গজেব গুরু তেগবাহাদুরকে হত্যা করেন। মৃত্যুদণ্ড হিসেবে মুণ্ডচ্ছেদ করা হয় তেগবাহাদুরের।
১০) গুরু গোবিন্দ সিং ( Guru Gobind Singh )
গুরু তেগবাহাদুরের মৃত্যুর পর শিখদের দশম গুরু রূপে অভিষিক্ত হন তারই পুত্র গুরু গোবিন্দ সিং। গুরু গোবিন্দ সিং-ই ছিলেন শিখদের শেষ গুরু।
i) খালসা
মুঘলদের বিরুদ্ধে শিখ সামরিক সংগঠন রূপে গুরু গোবিন্দ সিং প্রতিষ্ঠা করেন খালসা ( Khalsa )। শিখ সামরিক সংগঠনকে বলা হোতো খালসা। খালসা কথার অর্থ পবিত্র।
খালসা -তে যোগ দেওয়ার জন্য পাহুল বা দীক্ষার প্রচলন করেন গুরু গোবিন্দ সিং। এছাড়াও শিখদের সিং ( Singh Surname ) উপাধি ধারণের নির্দেশ দেন।
ii) শিখ ধর্মের ‘পঞ্চ ক’
খালসার সদস্যদের পঞ্চ ‘ক’ ( Five K ) ধারণের আদেশ দেন গুরু গোবিন্দ সিং।
এই পঞ্চ ক হোলো – কেশ বা চুল ( Kesh ), কৃপাণ বা তরবারি ( Kripan ), কাঙ্গা বা চিরুনি ( Kangha ), কচ্ছ বা পায়জামা ( Kacchera ), কড়া বা লোহার বালা ( Kara )।
তাঁর নেতৃত্বে আনন্দপুরের যুদ্ধে শিখরা জয়লাভ করেছিল। কিন্তু গোবিন্দ সিংয়ের দুই পুত্রকে মুঘলরা হত্যা করে।
গুরু গোবিন্দ সিং শিখদের ওপর মুঘলদের নির্যাতন বন্ধের জন্য ঔরঙ্গজেবকে জাফরনামা নামে ( Zafarnama letter ) একটি চিঠি দেন। ঔরঙ্গজেব চিঠির উত্তরে গুরু গোবিন্দ সিং কে দিল্লীতে আমন্ত্রণ জানান।
কিন্তু দেখা হওয়ার আগেই ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়। অন্যদিকে ঔরঙ্গজেবের পুত্র বাহাদুর শাহের সাথে গোবিন্দ সিং এর মিত্রতা গড়ে ওঠে।
বাহাদুর শাহের দাক্ষিণাত্য অভিযানে গোবিন্দ সিং সঙ্গী হন।
এখানেই ১৭০৮ সালে এক যুদ্ধের তাঁবুতে দুই পাঠান যুবক গুরু গোবিন্দ সিং কে তলপেটে ছুরির আঘাত করে মেরে ফেলে।
গুরু গোবিন্দ সিং-র মৃত্যুর পর শিখ গুরুপদ বিলুপ্ত হয়।
আরও পড়ুন : সুফি আন্দোলন বা সুফিবাদ
আশা করি এই পোস্টটি পড়ে শিখ ধর্মের উত্থান বা শিখ ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি এবিষয়ে কোনো মতামত থাকে তাহলে Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে সাহায্য করে।