সুফি আন্দোলন বা সুফিবাদ (Sufi Movement or Sufism)
কেমন আছো বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভালো আছো।
এবারের আলোচনার বিষয় সুফি আন্দোলন বা সুফিবাদ (Sufism) সম্পর্কে। এর নামকরণ, এর উৎপত্তি ইত্যাদি সম্পর্কে তোমায় জানাবো। তাই এই পোস্টটি পুরোটা পড়ার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছি।
আশা রাখি অবশ্যই তুমি পড়বে। চাইলে এই পোস্টটি ছাড়াও তুমি এই ওয়েবসাইটে অন্যান্য পোস্টগুলিও পড়তে পারো।
তাহলে চল প্রথমেই সুফিবাদের উৎপত্তি জানা যাক।
উৎপত্তি (Origin) :
পারস্যের অতীন্দ্রিয়বাদী (Mystic) মরমীয়া সম্প্রদায় থেকে সুফীবাদের জন্ম।
হজরত মহম্মদের মৃত্যুর পর ইসলাম ধর্মে অবক্ষয় দেখা দেয়। সময়টা ছিল নবম-দশম শতাব্দী।
মুসলমানদের একটা অংশ সেইসময় ভোগ বিলাসে মেতে ছিল।
তাই এদের সংস্কার ও সংশোধনের জন্য সুফিবাদের উৎপত্তি হয়। যা ত্যাগ, বৈরাগ্য ও আল্লার নিকট নিজেকে সমর্পনের উপর গুরুত্ব দিয়েছিল।
সুফির নামকরণ (Naming of Sufi’s) :
বন্ধু তুমি এতক্ষনে নিশ্চই সুফির নামকরণ কিভাবে হল, সেটা ভাবছ। বলব তোমাকে সেইবিষয়ে।
‘সুফি’ কথাটি আরবী শব্দ। যার অর্থ পশম বা উল। এই মতবাদের সন্তগণ খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতেন।
এই সন্তগণ-রা পশমের একটি সাধারণ, মোটা বস্ত্র পড়তেন।
এখান থেকেই এঁরা সুফি নামে পরিচিতি পান। আবার অনেকের মতে ‘সাফা’ (পবিত্র) কথা থেকেই সুফি কথাটি এসেছে।
এঁদের মতবাদ সুফিবাদ নামে পরিচিত হয়।
বৌদ্ধ – হিন্দু প্রভাব (Buddhist-Hindu influence) :
সুফিবাদে বৌদ্ধ ও হিন্দু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইসলামের জন্মের আগেই মধ্য এশিয়াতে বৌদ্ধধর্ম বেশ জনপ্রিয় ছিল।
এই মধ্য এশিয়া পরে মুসলমানদের অধিকারে আসে।
এই বৌদ্ধরাও তখন ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। বৌদ্ধ ভাব সুফি মতবাদকে প্রভাবিত করে।
এমনকি বুদ্ধের কাহিনীগুলি ইসলামের মধ্যে প্রচলিত ছিল।
ভারতীয় যোগ সাধনার বই ‘অমৃত কুণ্ড’ ফার্সী ভাষাতে অনুবাদ করা হয়েছিল। এইভাবে সুফিবাদ মিশ্র ধর্মে পরিণত হয়।
আরও পড়ো : নেতাজী ও তার আজাদ হিন্দ ফৌজ
সুফিবাদের মূলকথা (Basics of Sufism) :
সুফিবাদের মূল কথা হল – মানুষের আত্মার সাথে ঈশ্বরের আত্মার নিবিড় মিলন। সুফিরা বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বর লাভ করা যায় একমাত্র ভক্তির মাধ্যমে।
এক ঈশ্বর প্রথায় সুফিরা বিশ্বাস করতেন।
তাঁরা মনে করতেন আসক্তির জন্যই মানুষ কষ্ট ভোগ করে। তাঁদের ধারণা ছিল কোনো কিছুর ভোগ থেকেই পাপের জন্ম হয়।
তাই সুফি সাধকরা ভোগ বিলাস থেকে দূরে থাকতেন। সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করতেন। নিজেদের বাণী প্রচার করতেন।
সুফি সাধনার কয়েকটি স্তর ছিল। যেমন – তওবা (অনুশোচনা), ফকর (দারিদ্র), সবর (সহ্য করা), সুকর (কৃতজ্ঞতা), রজা (ঈশ্বরের করুণালাভের ইচ্ছা), ওয়ারা (নিবৃত্তি) ইত্যাদি।
গুরু (Guru) :
সুফিরা তাঁদের গুরুকে বলত ‘পীর’ বা ‘খাজা’ (Khwaja)। গুরুর হাত ধরেই সুফি সন্ন্যাস জীবন শুরু হত।
ঈশ্বরের করুণা লাভের মাধ্যমে মুক্তি লাভ সুফিদের লক্ষ্য ছিল। সেকারণেই দরকার হত গুরুর।
গুরু বা পীরের সাধনার স্থান ছিল ‘দরগা’ বা ‘খানকা’। পীরের অনুগামীদের বলা হত ‘ফকির’ বা ‘দরবেশ’।
সুফিরা প্রায় ১২ টি সিলসিলা (সম্প্রদায়) তে বিভক্ত ছিল। এর মধ্যে বেশী উল্লেখযোগ্য ছিল চিশতি ও সুহরাবর্দি সম্প্রদায়।
চিশতি সম্প্রদায় (Chishti Community) :
১) ভারতের চিশতি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। মহম্মদ ঘোরীর সাথে তিনি ভারতে এসেছিলেন।
২) মইনুদ্দিন চিশতির দরগা ছিল রাজস্থানের আজমীরে।
৩) বখতিয়ার কাকি ছিলেন মইনুদ্দিন চিশতির একজন শিষ্য।
৪) বখতিয়ার কাকির শিষ্য ফরিদ উদ্দিন শকর জনপ্রিয় সুফি সাধক ছিলেন।
৫) চিশতি সম্প্রদায়ের শ্রেষ্ঠ সাধক ছিলেন নিজাম উদ্দিন আউলিয়া। তিনি আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছিলেন।
৬) নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার দরগা ছিল দিল্লীতে।
৭) হিন্দু – মুসলিম ধর্মের বহু মানুষ তাঁর শিষ্য হয়েছিলেন।
৮) কবি আমীর খসরু, বিখ্যাত ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারাণী আউলিয়ার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
৯) নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার প্রধান শিষ্য ছিলেন নাসিরউদ্দি চিরাগ। যাঁকে বলা হত চিরাগ-ই-দিল্লী বা দিল্লীর আলো।
১০) ভারতের ধর্মসমন্বয়-এর ক্ষেত্রে চিশতি সম্প্রদায়ের সাধকদের অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
সুহরাবর্দি সম্প্রদায় (Suhrawardiyya Community) :
১) সন্ত শিহাবউদ্দিন সুহরাবর্দি এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
২) পাঞ্জাব, মুলতান, পূর্ববঙ্গে এই সম্প্রদায়ের জনপ্রিয়তা ছিল।
৩) চিশতি সম্প্রদায়ের সাথে এঁদের পার্থক্য ছিল। যেমন, চিশতিদের মত এঁরা দরিদ্র জীবনযাপন করত না।
৪) সুফি সাধক হামিদ উদ্দিন নাগরী ছিলেন সুহরাবর্দি-র শ্রেষ্ঠ শিষ্য।
৫) এই সম্প্রদায় সমাজের উঁচু নীচু সবার সাথে সমান আচরণ করত।
৬) সুহরাবর্দি সম্প্রদায় সংযম ও কষ্টসাধনে বিশ্বাসী ছিল না।
এছাড়াও আল-কাদেরী, ফিরদৌসী, সাত্তারি সম্প্রদায়ের অস্তিত্বও ভারতে ছিল। তবে এঁদের অনুগামীর সংখ্যা বেশী ছিল না।
সুফিবাদের প্রভাব (Influence of Sufism) :
ক) সুফিদের সহজ সরল জীবনধারা সমাজের প্রতিটি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
খ) সুফিবাদের সহিষ্ণুতায় বহু হিন্দু ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
গ) আকবরের আমলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সুফিবাদের দ্বারাই ঘটেছিল।
ঘ) সুফি সাধনায় সত্যপীর, মানিকপীর, ওলাবিবি প্রভৃতি দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটে। এই দেবদেবীদের উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই পূজা, মানত করত।
ঙ) শিক্ষা ও সাহিত্যেও সুফিদের বিশেষ অবদান ছিল।
চ) সুফি সন্তরা হিন্দী ভাষাতে বাণী প্রচার করতেন। বিভিন্ন কবিতা, গান লিখতেন হিন্দীতে। এর ফলে সাধারণ মানুষদের বুঝতে অসুবিধা হত না।
এই ভাবে সুফির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে ওঠে।
আরও পড়ো : আকবরের রাজপুত নীতি
“পোস্টটি পড়ে তোমার কেমন লাগল তুমি কমেন্টে নিশ্চয়ই জানাবে। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার। ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো । “
Durdanto lekhati; Amar anek dhyonnobad janben. Sufibaad er follower der Opore Turkistan er Badshash /Sultan enara khub ekta kintu sodoy chilen na! Iran aar Turkey er modhye lodai legi thakto 15 th aar 16 th Century te.
ধন্যবাদ পুরোটা পড়বার জন্য ,আপনি চাইলে অন্য লেখাগুলিও এই ওয়েবসাইটে পড়তে পারেন। ভালো থাকবেন….
Awesome… very informative
ধন্যবাদ…