শঙ্করাচার্য | Shankaracharya in bengali

শঙ্করাচার্য ( Shankaracharya )

ধর্ম স্থাপনের জন্য বহু দেবতা রুপী মানবের আবির্ভাব হয়েছে পৃথিবীতে। তাঁরা সনাতন হিন্দুধর্ম কে রক্ষা করতে এসেছিলেন।

ইতিহাস কিন্তু সেই কথাই বলে। আমরা এই দেবমানবদের কাছে অনেক পরিমাণে ঋণী।

এই দেবমানবরা বৈদিক ধর্মকে বসিয়েছিলেন শক্ত বেদীর উপর। ইতিহাসে এমনই এক দেবমানবের পরিচয় পাওয়া যায়।  

বেঁচেছিলেন মাত্র বত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু তিনি ছিলেন হিন্দুর হিন্দুত্বের গর্ব। আমরা তাঁর কাছে ঋণী। গোটা হিন্দু সমাজ তাঁর কাছে ঋণী।

তিনি আর কেউ নন , তিনি হলেন শঙ্করাচার্য। ইতিহাসে প্রসিদ্ধ আচার্য শঙ্কর বা আদি শঙ্কর ( Adi Shankara ) নামে।

পরবর্তীকালে তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন বহু সন্ত মহাপুরুষগণ।

তাই এবারের এই পোস্টে আলোচনা করবো শঙ্করাচার্যকে নিয়ে। জানবো শঙ্করাচার্যের জীবনীর আশ্চর্য ইতিহাস সম্পর্কে।

এইগুলি জানতে হলে পোস্টটি পুরোটা পড়তে থাকো।

জন্ম ও পরিচয় 

শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের কেরালা রাজ্যের মানুষ ছিলেন। হিন্দু পুরাণ অনুসারে ভগবান পরশুরাম কেরালা রাজ্যটিকে তৈরি করেছিলেন।

সেইজন্য কেরালা ( Kerala ) ‘God’s own country’ নামে পরিচিত। শঙ্করাচার্যের বাবার নাম শিবগুরু। মায়ের নাম বিশিষ্টা

শিবগুরু ছিলেন একজন সৎ , নিষ্ঠাবান বৈদিক নাম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ। মালয়ালম ভাষায় নাম্বুদ্রি শব্দের অর্থ শাস্ত্র বিশ্বাসে পূর্ণ ব্রাহ্মণ যিনি। শিবগুরু ও বিশিষ্টার কোনো সন্তান ছিল না।

সন্তান না থাকায় তাঁদের মনে সর্বদাই বড়ো দুঃখ থাকতো। শিবগুরু ও বিশিষ্টা কালাডি গ্রামের বৃষ পর্বতে চন্দ্রমৌলি শিবের আরাধনা শুরু করলেন। একটি দীর্ঘায়ু পুত্রের কামনা নিয়ে।

একদিন রাত্রে ভগবান শিব শিবগুরুকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। শিবগুরু বর হিসেবে দীর্ঘায়ু ও সর্বজ্ঞানী এক পুত্র চাইলেন।

ভগবান শিব বললেন , সর্বজ্ঞানী পুত্র চাও তো সে দীর্ঘায়ু হবে না। আর দীর্ঘায়ু পুত্র চাও তো সে সর্বজ্ঞানী হবে না।

কিন্তু শিবগুরু চাইলেন একজন সর্বজ্ঞানী পুত্র। ভগবান শিব বললেন , আমিই আসছি তোমাদের পুত্র হয়ে।

অবশেষে শিবাবতার শঙ্করাচার্য ৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই বৈশাখ শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে কেরালার কালাডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করলেন।

শৈশব  

শৈশবেই শঙ্করাচার্যের পিতা শিবগুরু মারা যান। মা বিশিষ্টাদেবীর কাছে তিনি বড়ো হন।

শৈশব থেকেই অত্যন্ত মেধা ও বুদ্ধি সম্পন্ন ছিলেন শঙ্করাচার্য। মাত্র তিন বছর বয়সেই বেদান্ত , রামায়ণ , মহাভারত , পুরাণ ইত্যাদি তিনি আয়ত্ত্ব করে নেন।

তুমি কি জানো বন্ধু  শঙ্করাচার্য বাল্যকাল থেকেই অত্যন্ত শ্রুতিধর ছিলেন। অর্থাৎ যা শুনতেন বা পড়তেন সবকিছুটাই তাঁর স্মৃতিতে থেকে যেতো।

সত্যিই এ যেন এক প্রতিভা বটে। পাঁচ বছর বয়সে মা বিশিষ্টাদেবী শঙ্করাচার্যের উপনয়ন করান।

আরও পড়ুননালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়

শঙ্করাচার্যের সন্ন্যাস গ্রহণ 

শঙ্করের বয়স তখন আট বছর। শঙ্করের চিন্তা কি করে সন্ন্যাস গ্রহণ করা যায়। কিন্তু আট বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুযোগ ছিল। মা বিশিষ্টাদেবী তা জানতেন।

তিনি শঙ্করকে সন্ন্যাসী হতে দিতে চান না। মায়ের ইচ্ছে ছেলে বড়ো হয়ে সংসারী হবে। একদিন শঙ্কর মায়ের সাথে আলোয়াই নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলেন।

এমন সময় জলের মধ্যে শঙ্করকে আক্রমণ করলো এক কুমির। কুমিরের কামড় থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন।

শঙ্কর তাঁর মা-কে বললেন , মা আমার মৃত্যুকাল এসে গেছে। তুমি আমাকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দাও। সন্ন্যাস ছাড়া আমার মুক্তি নেই। 

বাধ্য হয়ে বিশিষ্টাদেবী শঙ্কর কে বললেন , বাবা তুমি সন্ন্যাসীই হও।

শঙ্কর নিজের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান করে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন। পরনে গেরুয়া বস্ত্র , হাতে লাঠি ও কমণ্ডলু।

মা বিশিষ্টাদেবী , পরিজন , গ্রামবাসীদের ছেড়ে সন্ন্যাসী শঙ্কর বেরিয়ে পড়লেন গুরুর খোঁজে।   

গুরু গোবিন্দপাদ-এর সান্নিধ্যলাভ   

অজানা শহর , গ্রাম , অরণ্যের মধ্যে দিয়ে কয়েক মাস হেঁটে চললেন সন্ন্যাসী শঙ্কর। অবশেষে একদিন পৌঁছলেন নর্মদা নদীর তীরে এক গুহায়।

এই গুহার মধ্যে হাজার বছর ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন এক মহাযোগী। নাম তাঁর গুরু গোবিন্দপাদ। শঙ্কর একখানি প্রদীপ জ্বালিয়ে গুহার ভেতর প্রবেশ করলেন।

দেখলেন কঙ্কালসার এক যোগীকে। দীর্ঘ নাক , বড়ো চোখ , চওড়া কপাল , দীর্ঘ জটা এক যোগীবর ধ্যানে বসে আছেন। গোবিন্দপাদ -র ধ্যান ভঙ্গ হোলো।

পরিচয় ঘটলো শঙ্করের সাথে। শঙ্করাচার্যের গুরুর নাম গুরু গোবিন্দপাদ

গোবিন্দপাদ শঙ্করকে হঠযোগ , রাজযোগ , জ্ঞানযোগ শিক্ষা দিলেন। শঙ্কর এই সবকটি শিক্ষাই আয়ত্ত করলেন অতি সহজে।

তিনি শঙ্করকে আদেশ করলেন বেদের অর্থ নিজের ভাষায় রচনা করতে। সেইসাথে অদ্বৈত দর্শন প্রচার করতে বলেন। এরপর শঙ্করের নাম হোলো শঙ্করাচার্য। 

শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তবাদ প্রচার 

শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের সময়ে ভারতীয় সমাজ কুসংস্কারে , ধর্মের গোঁড়ামিতে আচ্ছন্ন ছিল। বৈদিক ধর্ম তথা হিন্দু ধর্ম অবক্ষয়ের পথে।

চারিদিকে মিথ্যাচার ছেয়ে ছিল। এমনসময়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন শঙ্করাচার্য। হিন্দু ধর্মকে বাঁচাতে।

হিন্দুদের কাছে শঙ্করাচার্য পরিচিত হলেন জগৎগুরু হিসেবে। গোটা ভারত পরিভ্রমনে বের হলেন শিষ্যদের নিয়ে। প্রচার করলেন বেদের অর্থ নিজের ভাষায়।

সকলকে পুনরায় বেদ শিক্ষা দিলেন। এরপর শঙ্করাচার্য প্রচার করেন অদ্বৈতবাদ দর্শন বা মতাদর্শ।

এই অদ্বৈতবাদের মূল কথা হোলো , ব্রহ্মই সত্য আর জগৎ মিথ্যা।

শঙ্করাচার্য অদ্বৈতবাদ দিয়ে বোঝালেন যে , জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

জীবকে ব্রহ্ম মনে করে , প্রতিটি মানুষের মধ্যে জীবের প্রতি ভালোবাসা জাগালেন তিনি।

এর ফলে বন্ধ হোলো ধর্মীয় হানাহানি। ধর্মীয় ভেদাভেদ। সকলের প্রতি সকলের ভালোবাসা জন্ম নিলো।

শঙ্করাচার্যের বাণী 

শঙ্করাচার্যের কিছু মূল্যবান বাণী গুলি হোলো –

ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ – অর্থাৎ ব্রহ্মই সত্য জগৎ মিথ্যা। জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। 

চিৎসদনন্দরূপায় সর্বোধিবৃত্তি সাক্ষিণেনমো বেদান্তবেদ্যায় ব্রহ্মণেহনন্ত রুপিণে – অর্থাৎ সচ্চিদানন্দরূপী বুদ্ধিবৃত্তির সাক্ষীস্বরূপ বেদান্তবেদ্যা ব্রহ্মকে প্রণাম। 

বেদান্তের বিচারে সব মানুষই ব্রহ্মস্বরূপ। 

এ জগৎ এক মায়াসময় নষ্ট না করে প্রকৃত ব্রহ্মের সন্ধানে বেরিয়ে পরা উচিত 

শঙ্করাচার্যের শিষ্যগণ 

শঙ্করাচার্য প্রথম কাশীতে যান। ব্রহ্মভাষ্য ব্যাখ্যা করেন এখানে।

কাশীতেই সনন্দন নামে একটি ছেলে শঙ্করাচার্যের কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করে। এই সনন্দন হলেন শঙ্করাচার্যের প্রথম শিষ্য।

শঙ্করাচার্য তাঁর নাম রেখেছিলেন পদ্মপাদ। এছাড়াও হস্তামলক , সুরেশ্বর , তোটকাচার্য প্রমূখরাও শঙ্করাচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। 

শঙ্করাচার্যের রচিত গ্রন্থ 

শঙ্করাচার্য তাঁর অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনকে গ্রন্থে স্থান দেন।

শঙ্করাচার্যের রচিত গ্রন্থগুলি হোলো – বিবেকচূড়ামণি , পঞ্চিকরণ , বাক্যসুধা , প্রবোধসুধাকর ইত্যাদি।

এছাড়াও বিভিন্ন দেবতাদের স্তোত্র রচনা করেছিলেন শঙ্করাচার্য। ব্রহ্মভাষ্যের মতো বহু ভাষ্য রচনা করেছিলেন। 

দশনামী সম্প্রদায় 

শঙ্করাচার্য বৈদিক ধর্মকে ছড়িয়ে দেবার জন্য দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দশনামী সম্প্রদায় হোলো – গিরি , পর্বত , সাগর , সরস্বতী , ভারতী , পুরী , তীর্থ , আশ্রম , বন , অরণ্য। 

শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত চারটি মঠ 

আদি শঙ্কর বা শঙ্করাচার্য হিন্দু ধর্মকে প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চারটি মঠ ভারতের চারকোণে। চারটি মঠের চার আচার্য। তাঁরা হলেন – হস্তামলক , পদ্মপাদ , তোটকচার্য , সুরেশ্বর।  এই চারটি মঠ হোলো –

শারদা মঠ , অবস্থিত গুজরাটের দ্বারকায়।

গোবর্ধন মঠ , অবস্থিত ওড়িশার পুরীতে। 

জ্যোতিৰ্মঠ ( যোশীমঠ ) , অবস্থিত উত্তরাখণ্ডের বদ্রিকাশ্রমে। 

শৃঙ্গেরী মঠ , অবস্থিত কর্নাটকে।  

মঠ প্রতিষ্ঠার সময়ে শঙ্করাচার্যের বয়স মাত্র ৩২ বছর। দৈববাণী হিসেবে মৃত্যুযোগও ছিল এই বয়সেই। উত্তরাখণ্ডের কেদারনাথে বদ্রিকাশ্রমে শঙ্করাচার্য দেহত্যাগ করেন। কেদারনাথেই শঙ্করাচার্যের সমাধিটি রয়েছে। 

আরও পড়ুনফা – হিয়েন কে ছিলেন     

আশা করি এই পোস্টটি পড়ে শঙ্করাচার্য সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি এবিষয়ে কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি অন্যদের সাথে Share কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!