ঋক-বৈদিক সমাজ ( Rig Vedic Society)
কেমন আছো বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভালো আছো।
এবারের আলোচনার বিষয় ঋক-বৈদিক যুগের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে। তুমি নিশ্চই ইতিহাসে আর্যদের সম্পর্কে পড়েছ ? তাঁরা মূলত যাযাবর ছিল। এই যাযাবর আর্যরা এদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে একটি সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলে।
খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১০০০ অব্দকে ঋক-বৈদিক যুগ হিসাবে ধরা হয়। এই সমকালের মধ্যেই আর্যরা যে সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তা ঋক-বৈদিক সমাজ ব্যবস্থা নামে পরিচিত।
যাইহোক, এবারে সেই সমাজ ব্যবস্থা কিরকম ছিল তা বরং জেনে নেওয়া যাক।
নীচে তার বিবরণ দেওয়া হল।
পরিবার :
পরিবার হল আমাদের সমাজ জীবনের মূল ভিত্তি। ঋক-বৈদিক যুগের সমাজে পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। একজন পিতা হতেন পরিবারের প্রধান কর্তা। পরিবারে তাঁর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠপুত্র পরিবারের দায়িত্ব নিতেন। পরিবারের প্রধানকে বলা হত কুলপতি বা কুলপা। যেহেতু পিতার মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রই অধিকার লাভ করত, তাই সমাজে পুত্র সন্তান জন্মের কামনা করা হত। এই যুগের সমাজে গৃহে অতিথিকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হত।
সমাজে নারীর স্থান :
ঋক-বৈদিক সমাজে নারীর বিশেষ মর্যাদা ছিল। ঋগ্বেদের স্তোত্রে নারীকে সম্মানের উঁচু আসনে বসানো হয়েছিল। শুধুমাত্র গৃহেই নারীর জীবন থেমে থাকেনি। একজন নারী তাঁর স্বামীর সাথে যজ্ঞের অনুষ্ঠানেও অংশ নিতে পারতেন। শিক্ষালাভ, তর্কযুদ্ধ, শ্লোক রচনা, রাজকার্য প্রভৃতিতে নারীর সমান অধিকার ছিল। অপালা, ঘোষা, বিশ্ববারা, লোপামুদ্রা, বিষ্পলা, মুদ্গলানী প্রমুখরা ছিলেন সেইযুগের মহিয়ষী নারী। গৃহকর্ম, নৃত্যগীত, স্বামীর ধর্মসঙ্গিনীর কাজ ছিল নারীর প্রধান কর্তব্য। বাল্য-বিবাহ ও সতীদাহ প্রথা সমাজে না থাকায় নারী জাতির সামাজিক মর্যাদা যথেষ্ট উন্নত ছিল।
আরো পড়ুন : https://iitihas.com/regulating-act-pitts-india-act-in-bengali/
বিনোদন :
অবসর সময়ে বিনোদন বা আমোদ প্রমোদ এযুগের সমাজের প্রধান অঙ্গ ছিল। জীবনের একঘেয়েমি দূর করার জন্য আর্যরা বিনোদনের মাধ্যমে দিন কাটাতো। নাচ, গান, শিকার, মুষ্টিযুদ্ধ প্রভৃতিতে নিজেদের জড়িয়ে রাখত। কণ্ঠ সঙ্গীত ও যন্ত্রসংগীত দুটোরই প্রচলন ছিল। যন্ত্রসংগীতে ব্যবহার হত বীণা, বাঁশি ইত্যাদি। সমাজে পাশাখেলা চালু ছিল। যা পরে ঋক-বৈদিক আর্যদের জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলেছিল। শিকার আমোদ-প্রমোদের মধ্যে থাকলেও, তা উচ্চ শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বর্ণপ্রথা :
ঋক-বৈদিক সমাজে বর্ণ বৈষম্য ছিল। তবে জাতি বৈষম্য ছিল না। ডি. ডি. কোশাম্বীর মতে, বর্ণ বা শ্রেণীকে জাতিগত অর্থে ব্যবহার করা হত না। সমাজে গৌর বর্ণের আর্য এবং কৃষ্ণ বর্ণের অনার্য এই দুটি ভাগ ছিল। এদের মধ্যে তফাৎ বোঝানোর জন্যই বর্ণ শব্দটি আসে। ধীরে ধীরে পেশা ও কাজের ভিত্তিতে সমাজে ৪টি বর্ণের সৃষ্টি হয়। একেই চতুবর্ণ বা বর্ণাশ্রম বলা হয়। এগুলি হল – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।
- ব্রাহ্মণের কাজ ছিল মূলত যাগযজ্ঞ, শিক্ষাদান করা।
- ক্ষত্রিয়রা রাজ্য রক্ষা, শাসন ও যুদ্ধের দায়িত্ব পালন করত।
- কৃষিকাজ, পশুপালন, বাণিজ্যের দায়িত্ব পালন করত বৈশ্যরা।
- অনার্যরা শূদ্র বা দাস হিসাবে উপরের এই তিন বর্ণের সেবা করত।
শিক্ষা :
ঋক-বৈদিক যুগে শিক্ষার প্রচলন ছিল। তার উদাহরণ সংস্কৃত ভাষায় রচিত ঋগ্বেদ। এইসময় গুরুর গৃহে থেকেই ছাত্রকে শিক্ষালাভ করতে হত। ব্রহ্মচর্য পালনের মধ্য দিয়েই শুরু হত শিক্ষালাভ। বেদ, সাহিত্য, ব্যাকরণ এইসবের চর্চা হত গুরুর গৃহে। তবে লেখার পদ্ধতি কি ছিল তা জানা যায় না। তবে যাই হোক, এই যুগের শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ছাত্রদের সুচরিত্র গড়ে তোলা। জেনে রাখো বন্ধু, শিক্ষাই পারে একজন মানুষের সুন্দর চরিত্র গঠন করতে।
পোশাক পরিচ্ছদ :
পশম ও সুতি বস্ত্র দুই প্রচলিত ছিল। পোশাকের বাস ও অধিবাস এই দুটি অংশ ছিল। বাস মানে শরীরের নীচের পোশাক। আর অধিবাস মানে শরীরের উপরের পোশাক। দ্রাপী নামে ঋগ্বেদে ঢিলেঢালা এক পোশাকের কথা বলা আছে। অলঙ্কারের মধ্যে ‘কর্ণশোভন’ নামক কানের দুল ব্যবহার হত। যা মহিলাদের শোভা বৃদ্ধি করত। এছাড়াও মহিলারা ‘কুরির’ নামে মাথার একটি অলঙ্কার ব্যবহার করত। গলায় যে সোনার গহনা পড়া হত তার নাম ছিল ‘নিষ্ক’।
খাদ্য-পানীয় :
বেঁচে থাকতে গেলে খাদ্যের প্রয়োজন। ঋক-বৈদিক যুগে আর্যরা খাদ্য হিসাবে আমিষ ও নিরামিষ উভয় প্রকার খাদ্য গ্রহণ করত। আমিষ খাবারের মধ্যে ভেড়া ও ছাগলের মাংস তাঁরা আহার করত। নিরামিষ খাবারের মধ্যে ছিল ফলমূল, বিভিন্ন তরি-তরকারি। দুধজাত খাবারের মধ্যে ঘি, মাখন তাঁদের প্রিয় ছিল। গাভীর প্রতি শ্রদ্ধা থাকায় গাভীর গরম দুধ পান এইযুগে ছিল প্রিয় পানীয়। কোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে সোমরস নামক এক ধরণের সুরা পান করা হত।
যাইহোক ঋক-বৈদিক যুগের সমাজের একটি বিবরণ তোমার সামনে তুলে ধরলাম। আশা রাখি তুমি পড়ে নিশ্চই কিছুটা ধারণা পেয়েছ।
লেখাটি পড়ে তোমার কেমন লেগেছে তুমি কমেন্টে আমাকে জানিও। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার। ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো।