মুঘল ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ( Mughal banking system )
বর্তমানে আমরা টাকাপয়সার লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে কিসের সাহায্য নিই ? হ্যাঁ এই সহজ প্রশ্নটির উত্তর হোলো, আমরা অবশ্যই ব্যাঙ্কের সাহায্য নিয়ে থাকি।
দৈনন্দিন জীবনে ছোটো থেকে আরম্ভ করে বড়ো অঙ্কের টাকার লেনদেন ব্যাঙ্কের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
আসলে ব্যাঙ্ক হোলো একটি নিরাপদ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যেখানে প্রতিটি মানুষ তাঁর রোজগারের অর্থকে সঞ্চিত করে রাখে।
আবার প্রয়োজনে সেই সঞ্চিত অর্থকে সে তুলতেও পারে।
এ তো গেলো এখনকার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার কথা।
আচ্ছা মুঘল যুগের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা কেমন ছিল ? তবে নিশ্চই আধুনিককালের মতো যে ছিল না, তা কিন্তু বলা যেতে পারে।
আজকের মতো ব্যাংকিং ব্যবস্থা মুঘল ভারতে ছিল না ঠিকই।
তবে এক নতুন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ( Banking system ) উপহার দিয়েছিল মুঘল ভারত।
আসলে মুঘল যুগে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক দুই ব্যবসা বাণিজ্যই ফুলেফেঁপে উঠেছিল। তারওপর শিল্পের রমরমা দেখা দেয়।
এরফলে এইসময় অর্থনীতিও মুদ্রা নির্ভর হয়ে ওঠে। তাই এর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার।
এখন এই ব্যাংকিং ব্যবস্থা কেমন ছিল ? টাকার লেনদেন হোতো কিভাবে ? কাঁরা ছিলেন মুঘল ভারতের ব্যাংকার ?
এই সব উত্তর জানতে এই পোস্টটি পুরোটা পড়তে হবে।
মুঘল যুগের ব্যাংকিং ব্যবস্থা যেমন ছিল
মুঘল ভারতের গ্রামগুলিতে ছোটো কিছু ব্যাংকার ছিল। ব্যাংকার তাঁদের কেই বলা হোতো যাঁরা ছোটোখাটো ব্যাঙ্কের মতন ছিলেন।
এই ব্যাংকার দের নাম ছিল শরফ বা স্রফ। কি ছিল এঁদের কাজ ?
এঁদের কাজ ছিল গ্রামের কৃষক, ছোটো কারিগর, ছোটো ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া।
কৃষকদের কে শরফ বা স্রফরা যে ঋণ দিত তার নাম তাকাভি। স্রফরা ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি বীমা বা Insurance ব্যবস্থার সাথেও জড়িত ছিল।
সমাজের বিভিন্ন মানুষ শরফদের কাছে টাকা বদল করতে আসতো।
তখন শরফরা পয়সা থেকে তা টাকায় বদলের জন্য আরও অতিরিক্ত টাকা বাটা হিসেবে চাইতো। বাটা অর্থাৎ কমিশন।
এই কমিশনের হার শতকরা ১/৪ থেকে ১/৮ হারে ধার্য করা হোতো। এইসমস্ত তথ্যগুলি ঐতিহাসিক ট্যাভার্নিয়ের বিবরণ থেকে পাওয়া যায়।
শরফ ছাড়াও বানিয়া ও মহাজনরাও ব্যাংকার হিসেবে কাজ চালাতেন।
বানিয়া শব্দটি খুবই প্রচলিত একটি শব্দ। আজকাল তো ব্যাপক পরিমাণে এই শব্দটি লোকমুখে ব্যবহৃত হয়।
যার অর্থ হোলো ব্যবসায়ী ধরনের মানুষজন। বানিয়াদের কাজ ছিল বাণিজ্য করা।
কিন্তু মুঘল যুগে বাণিজ্য করার পাশাপাশি বানিয়ারা ব্যাংকারও ছিল। বানিয়া ও মহাজনরা আমানত রেখে টাকা ধার দিত চড়া সুদের বিনিময়ে।
পদ্ধতিটা অনেকটা এখনকার ব্যাংকের মতো।
এছাড়াও ছিলেন সাহুকাররা। সাহুকাররাও টাকা ধার দিয়ে সুদের ব্যবসা করতেন। তাই সাহুকারদের কেও ব্যাংকার বলা যেতে পারে।
সুদের বিনিময়ে টাকা ধার দেওয়ার ব্যবসা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, সরকারের অফিসাররাও পর্যন্ত ব্যাংকারের কারবার করতেন।
এই যেমন, মুঘল টাঁকশালের কোনো কর্তার কাজ ছিল টাঁকশালের মুদ্রাগুলির ধাতুর গুণমান পরীক্ষা করা।
তাঁর পরীক্ষার পরেই মুদ্রাগুলি বাজারে সাধারণ মানুষের হাতে আসতো। কিন্তু দেখা যেতো তিনি সেই দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতেন না।
বরং টাঁকশালের সেই অফিসার ব্যক্তি সুদের কারবার করতেন। আর তাঁর এই কাজের ফলে মুদ্রার সোনা রুপার মান পরীক্ষার কাজ অবহেলিত হোতো।
আরও পড়ুন : মুঘল চিত্রকলা বা শিল্পকলা
মুঘল হুন্ডি ব্যবস্থা ও টাকার লেনদেন
মুঘল যুগে দূরদেশের বাণিজ্যের সময়ে হুন্ডির ( Hundi ) সাহায্য নেওয়া হোতো। হুন্ডি মুঘল আমলেই চালু হয়। হুন্ডিকে ফারসি ভাষায় বলা হোতো ‘সুরফা‘।
এখন প্রশ্ন হোলো হুন্ডি কি ? হুন্ডি হোলো একটি কাগজ। যে কাগজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা লেখা থাকতো।
হুন্ডি ব্যবহার করতেন ব্যবসায়ীরা। হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা টাকা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পাঠাতে পারতেন। আবার প্রয়োজনে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা ধারও নিতেন।
আধুনিক কালের নগদের লেনদেনের পরিবর্তে চেক ( Cheque ) বা ব্যাঙ্ক ড্রাফট ( Bank draft ) ব্যবহার করা হয়।
মুঘল ভারতে সেইসময় আধুনিক চেক বা ব্যাঙ্ক ড্রাফট না থাকায় হুন্ডির ব্যবহার করা হোতো। অর্থাৎ সেসময়কার হুন্ডি ব্যবস্থা আজকের চেক বা ব্যাঙ্ক ড্রাফট।
হুন্ডির মাধ্যমে যাঁরা নিরাপদে টাকা পাঠাতো, তাঁরা অবশ্যই বাটা বা কমিশন নিতো। কমিশন নির্ভর করতো দূরত্বের ওপর।
কাছাকাছি পাঠালে বাটার হার হোতো কম। আর দূরে পাঠালে হার হোতো বেশি।
ধরা যাক হুন্ডি লাহোরে গ্রহণ করা হোলো এবং আহমেদাবাদে ভাঙানো হোলো। তখন এর বাটার হার হবে প্রায় ৭ শতাংশ। কারণ এক্ষেত্রে লাহোর থেকে সুরাটের দূরত্ব অনেক বেশি ছিল।
আবার আহমেদাবাদে হুন্ডি নিয়ে সুরাটে ভাঙানো হোলো। তখন এর বাটার হার হবে এক থেকে দেড় শতাংশ।
কারণ যেহেতু আহমেদাবাদ ও সুরাটের দূরত্ব ছিল কম। মুঘল ভারতে হুন্ডি চার প্রকারের ছিল।
দর্শনী হুন্ডি, মিতি হুন্ডি, শা-জগ হুন্ডি, জোখামি হুন্ডি।
দর্শন কথাটির অর্থ দেখা। তাই দর্শনী হুন্ডিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে দেখে টাকা প্রদান করা হোতো। এটি ছিল অনেকটা এখনকার ডিমান্ড ড্রাফট ( Demand draft ) র মতো।
মিতি হুন্ডি প্রদান করে হোতো হুন্ডিতে লেখা নির্দিষ্ট দিনের পর। শা-জগ হুন্ডি কোনো বিশেষ ব্যক্তির নামে থাকতো না।
শুধুমাত্র কাকে প্রদান করা হবে এইটুকুর উল্লেখ থাকতো।
হুন্ডিতে লিখিত অঙ্কের টাকা হুন্ডির মালিক পেতেন। এক্ষেত্রে হুন্ডির মালিকের পরিচয় গোপন থাকতো।
কিন্তু হুন্ডি ব্যবহারে একটি অসুবিধা ছিল। যদি ভুলবশতঃ হুন্ডির টাকা ভুল লোকের হাতে চলে যেতো তাহলে হুন্ডিদাতাকেই সেই আর্থিক ক্ষতির দায় নিতে হোতো।
মুঘল ভারতের ব্যাংকাররা
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল ব্যাঙ্ক ব্যবসা বিস্তার লাভ করেছিল। ব্যাংকিং-র সাথে বিমা ( Insurance ) ব্যবসাও চলতো। তবে জীবন বিমা করা যেতো না।
জাহাজে করে যে মালপত্র পাঠানো হোতো তার বিমা চালু ছিল। ঝুঁকি কম থাকায় বিমার খরচ পড়তো নামমাত্র।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে ব্যাংকের বিখ্যাত মালিক ছিলেন গুজরাটের সুরাটের বিরজি ভোরা। এছাড়াও ছিলেন করমণ্ডল উপকূলের মল্লয় ও মালাবারের শেঠিরা।
প্রচূর সম্পত্তির মালিক ছিলেন এই বিরজি ভোরা। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন বানিয়া শ্রেণীর ব্যবসায়ী ও সেইসাথে ভারতের ধনী মানুষজন।
এই ব্যাংক মালিকদের কাছে এতো অর্থ ছিল যে, এঁরা সরকারকেও পর্যন্ত টাকা ধার দেওয়ার ক্ষমতা রাখতো।
পরবর্তীকালে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের সময় আর এক বিখ্যাত ব্যাঙ্ক মালিক ছিলেন মানিক চাঁদ।
মানিক চাঁদের কাজে খুশি হয়ে ঔরঙ্গজেব তাঁকে শেঠ উপাধি দিয়েছিল। মানিক চাঁদ পরিচিত হলেন শেঠ মানিক চাঁদ রূপে।
শেঠ মানিক চাঁদের পরিবারের বংশ পরম্পরায় ব্যাঙ্ক ব্যবসা-ই ছিল প্রধান। মানিক চাঁদের পিতা ব্যাংকের মালিক ছিলেন।
এমনকি তাঁর ছয় ভাই ও ভাইপোও ব্যাঙ্ক ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। ভাইপো ফতে চাঁদ ছিলেন মুর্শিদাবাদের ব্যাংকের মালিক।
একবার সম্রাট ফারুখশিয়র অর্থ সংকটে পড়েছিলেন। সেইসময় তাঁকে সংকট থেকে বাঁচাতে বিপুল পরিমাণে অর্থ সাহায্য করেছিলেন এই ফতে চাঁদ।
ফতে চাঁদের এই সাহায্যে খুশি হয়ে ফারুখশিয়ার তাঁকে ‘জগৎ শেঠ‘ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
জগৎ শেঠ মহাতপচাঁদ যিনি ছিলেন ভারত তথা সুবে বাংলার একজন বিখ্যাত ব্যাংকার।
বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ সে জুন পলাশীর যুদ্ধ ( Battle of Plassey ) সংঘটিত হয়েছিল। বলা হয় যে, এই যুদ্ধের ষড়যন্ত্রের ছক নাকি কষা হয়েছিল এই জগৎ শেঠ মহাতপচাঁদের বাড়িতে বসেই।
আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থা
মুঘল ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার যে ভিত গড়া হয়েছিল, তাকে অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে বর্তমান ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা।
আজকের ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা পৌঁছে গিয়েছে গ্রাম থেকে শহর প্রত্যেকটি মানুষের ঘরে।
বর্তমানে ব্যাঙ্ক প্রত্যেকটি মানুষের কাছে ভরসাযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান। বর্তমান সময়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক হোলো রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ( Reserve Bank of India )।
১৯৩৫ সালের ১লা এপ্রিল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক গড়ে উঠেছিল। বর্তমানে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হলেন শক্তিকান্ত দাস ( Shaktikant Das )।
ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সদর দপ্তর ( Headquarter ) বা প্রধান কার্যালয় মুম্বাইতে অবস্থিত। তবে ১৭৭০ সালে হিন্দুস্তান ব্যাঙ্ক গঠনের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা চালু হয়।
এরপর গড়ে উঠেছিল ব্যাঙ্ক অফ ক্যালকাটা ( Bank of calcutta ), ব্যাঙ্ক অফ মাদ্রাস ( Bank of Madras ), ব্যাঙ্ক অফ বোম্বে ( Bank of Bombay )।
পরবর্তীকালে এই তিনটি ব্যাঙ্ক একসাথে মিলে গড়ে উঠেছিল ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ( Imperial bank of india )।
১৯৫৫ সালে ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র নাম বদলে হয় স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ( State bank of india )। বর্তমানে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার সদর দপ্তর বা কার্যালয় মুম্বাইতে অবস্থিত।
দিন যত এগিয়েছে ভারতে একের পর এক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক গড়ে উঠেছে। যেমন- Bank of india, Bank of baroda, Central bank of india, Uco bank, ICICI bank, HDFC bank ইত্যাদি।
এই ব্যাঙ্ক গুলি তাদের পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। সাধারণ মানুষ এতে উপকৃতও হয়েছেন।
তাই সবশেষে বলা যেতে পারে, আজকের আধুনিক কম্পিউটারাইজ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার পথচলা শুরু মুঘল যুগের ভারতের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার হাত ধরেই।
আরও পড়ুন : শিখ ধর্মের উত্থান
আশা করি পোস্টটি পড়ে ‘মুঘল যুগের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা’ সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে তোমার মতামত জানিও। আর অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। ভালো থেকো বন্ধু…..