মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প ( Mughal Architecture )
ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জাতি শাসন করেছে। দ্রাবিড়, শক, হুন, পাঠান, মুঘল এবং একদম শেষে ইংরেজরা।
এই পোস্টের মূল বিষয় মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প -কে ( Mughal Architecture ) নিয়ে। তাই মুঘলদের কথাই বলা যাক।
ভারতে মুঘল রাজবংশ ( Mughal Dynasty ) প্রতিষ্ঠা করেন বাবর ( Babur ) ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে।
বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়ার একজন মুসলিম রাজা। এরপর দেখতে দেখতে বাবরের পরবর্তী মুঘল সম্রাটরা ভারতে দুশো বছরের বেশী শাসন চালালেন।
ভালো মন্দ মিশিয়ে রেখে গেলেন তাঁদের অবদান। অবদান রাখলেন স্থাপত্য শিল্প, চিত্রকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
মুঘলরা ভারতে এসে ভারতের স্থাপত্যের সাথে তাঁদের স্থাপত্য মিশিয়ে দেন। জন্ম নেয় এক নতুন স্থাপত্য শিল্পের।
মুঘল শাসকদের স্থাপত্যগুলি আজও যেন ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। তাই মুঘল স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে জানতে এই পোস্টটি অবশ্যই সহায়ক হবে।
মুঘল স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্য ( Mughal Architecture )
শিল্প, স্থাপত্য কিভাবে গড়তে হয় তাঁর পুরো জ্ঞান নিয়েই মুঘলরা ভারতে পা রেখেছিলেন। ভারতে আগে থেকেই স্থাপত্যের একটি শিল্পধারা ছিল।
মুঘলরা এই ভারতীয় ধারার সাথে পারস্যের শিল্পধারাকে মেশালেন। এক নতুন শিল্পরীতির প্রবর্তন হোলো, নাম তার মুঘল শিল্প।
মুঘল স্থাপত্যের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য হোলো, স্থাপত্যে গম্বুজের ব্যবহার। গম্বুজ অর্থাৎ বিরাট বিরাট থামওয়ালা প্রাসাদ।
গম্বুজের ব্যবহার কিন্তু মুঘলদের আসার আগে ভারতে হয়নি। গম্বুজের ব্যবহার বাগদাদে করা হয়েছিল। মুঘলরা সেখান থেকে এই ধারা ভারতে নিয়ে আসে।
এছাড়াও মিনার ও সৌধের ওপর বিশাল চূড়াও মুঘল স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য। বাংলা ও বাংলার বাইরে মসজিদ গুলিতে এমন স্থাপত্য দেখা যায়।
অন্যদিকে ভারতীয় কারিগরেরা মুঘল স্থাপত্যের কাজে হাত লাগালেন। তৈরি করলেন দর্শনীয় প্রাসাদ, মসজিদ ইত্যাদি।
ভারতে মুঘল শাসকদের স্থাপত্যগুলি
১) বাবরের আমলের স্থাপত্য
ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাবর। তিনি ছিলেন একজন সাহসী সৈনিক। আবার শিল্প চর্চা করাকেও ভালোবাসতেন। কিন্তু যুদ্ধে বেশি ব্যস্ত থাকার কারণে সেইরকম স্থাপত্য গড়ে তুলতে পারেননি।
শিল্প প্রেমিক হলেও বাবরের ভারতীয় শিল্প স্থাপত্য সম্পর্কে সেইরকম ধারণা ছিল না।
জানা যায় ভারতে প্রাসাদ বানানোর জন্য বাবর রোমের কনস্টান্টিনোপল থেকে শিল্পীদের আনতে চেয়েছিলেন। কারণ ওখানকার শিল্পীরা প্রাসাদ তৈরিতে বেশ দক্ষ ছিলেন।
বাবরের শাসনকালের মেয়াদ খুব অল্প ছিল। তবু এই অল্প সময়ে তিনি দুটি সৌধ গড়লেন।
১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে বাবর হরিয়ানার পানিপথে নির্মাণ করেছিলেন কাবুলবাগ মসজিদ ( Kabuli Bagh Mosque; built in 1527 by Babur )। এবং দ্বিতীয়টি সম্ভলের জামা মসজিদ ( Sambhal Mosque )।
২) হুমায়ুনের আমলের স্থাপত্য
মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের ( Humayun ) নামের অর্থ ভাগ্যবান। কিন্তু তাতে কি এসে যায়। বরং ভাগ্য তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিল না। সিংহাসন হারিয়ে হুমায়ুন কে যাযাবরের মতো জীবন কাটাতে হয়েছিল। ইতিহাস এর সাক্ষী।
তাই মুঘল স্থাপত্যে নির্মাণে তিনি সেরকম ছাপ রেখে যেতে পারেননি। তা সত্ত্বেও হুমায়ুন নির্মাণ করেছিলেন ফতেহাবাদ মসজিদ ( Fatehabad Mosque )।
আরও পড়ুন : আবদুল কাদির বদায়ুনি
দিনপনাহ বা জগতের আশ্রয় নামে একটি নগর তৈরির পরিকল্পনা করলেও সেটি হুমায়ুনের করা হয়নি।
আকবরের স্থাপত্য
হুমায়ুনের পুত্র সম্রাট আকবরের ( Akbar ) স্থাপত্য কাল থেকেই মুঘল স্থাপত্যে জোয়ার আসে। আকবরের সময় থেকে স্থাপত্যে ভারতীয় রীতি দেখা দিতে শুরু করে।
আকবর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভাবান সম্রাট। তিনি নিজেই প্রাসাদ বা সৌধের নকশা তৈরী করতেন। আর কারিগরেরা সেই নকশা দেখে বানাতেন চোখ ধাঁধানো একেকটি প্রাসাদ।
১) আগ্রা ফোর্ট
সম্রাট আকবর আগ্রা দুর্গ ( Agra fort ), লাহোর দুর্গ ( Lahore fort ), এলাহাবাদ দুর্গ ( Allahabad fort ) এই তিনটি দুর্গ তৈরী করেন।
আগ্রা দুর্গ বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খোলা। কিন্তু এলাহাবাদ দুর্গে বর্তমানে পর্যটকদের প্রবেশের অনুমতি নেই। কারণ এই দুর্গটি ভারতীয় সেনাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয়েছে।
কিন্তু এলাহাবাদে ( বর্তমান নাম প্রয়াগরাজ ) একমাত্র কুম্ভ মেলার সময় পর্যটকদের দুর্গে প্রবেশের অনুমতি মেলে। এই দুর্গগুলি থাকবার জন্যই বানানো হয়েছিল।
আকবর এই দুর্গগুলির ভেতরে লাল বেলেপাথরের অট্টালিকা তৈরী করেছিলেন। আকবরী মহল ও জাহাঙ্গীরী মহল হোলো সেইরকম দুটি সুন্দর অট্টালিকা।
এই অট্টালিকা গুলোর দেওয়ালে হাতি, সিংহ, ময়ূর ইত্যাদি প্রাণীর ছবি আঁকা আছে। যা ভারতীয় রীতিকেই তুলে ধরে।
২) ফতেপুর সিক্রি
চলে আসি আকবর নির্মিত ফতেপুর সিক্রির স্থাপত্যের কথায়।
ফতেপুর সিক্রি ( Fatehpur Sikri ) ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের আগ্রা জেলাতে অবস্থিত।
ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে ফতেপুর সিক্রি ইউনেস্কো ( UNESCO ) ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সংরক্ষণের তকমা পেয়েছে। ১৫৬৯ – ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর এখানে বহু প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
সিক্রি মুঘল ভারতের একটি গ্রাম। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে আকবর গুজরাট বিজয় বা ফতেহ করার পর এখানে নির্মাণ করেন বুলন্দ দরওয়াজা ( Buland Darwaza )।
আর স্থানটির নাম হয় ফতেপুর সিক্রি, ‘the city of victory’।
প্রায় ১৭৭ ফুট উঁচু এই বুলন্দ দরওয়াজা একটি বিশাল গেট বা ফটক। ২০২০ সালের প্রথমদিকে বুলন্দ দরওয়াজা সহ গোটা ফতেপুর সিক্রি আমার দেখবার সুযোগ হয়েছিল।
এখানে মার্বেল ও বেলেপাথরের কাজ দেখে সত্যিই অবাক হতে হয়।
৩) আকবরের অন্য মুঘল স্থাপত্য
জাম-ই-মসজিদ, বীরবল প্রাসাদ, অনুপ তালাও, যোধাবাঈ মহল, পঞ্চমহল, দিওয়ান-ই-খাস, হারাম সারা ইত্যাদি ফতেপুর সিক্রির মুঘল স্থাপত্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
এই প্রতিটি প্রাসাদের পিলার, ব্যালকনি, জানালা সব যেন অসাধারণ সৌন্দর্য্যে ভরপুর।
এছাড়াও সাদা মার্বেল পাথরের সেলিম চিস্তির ( Salim Chisti Tomb ) দরগা টি অপরূপ সুন্দর একটি স্থাপত্য।
ডঃ স্মিথ ফতেপুর সিক্রিকে ‘ A romance in stone ‘ বলে বর্ণনা করেছেন।
জাহাঙ্গীরের আমলের স্থাপত্য
সম্রাট আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর ( Jahangir ) তাঁর পিতার মতো মুঘল স্থাপত্য তৈরিতে অতটা আগ্রহী ছিলেন না।
বরং জাহাঙ্গীরের আগ্রহ বেশি ছিল চিত্রশিল্প তৈরিতে। মুঘল চিত্রশিল্প তাঁর আমলেই বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল।
ফতেপুর সিক্রি ও আগ্রার মাঝে সেকেন্দ্রা নামক স্থানে আকবরের সমাধি জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত হয়।
কিন্তু জাহাঙ্গীর পত্নী নূরজাহানের স্থাপত্যশিল্পে অনুরাগ ছিল বেশি।
তবে যাইহোক লাহোর প্রাসাদ, শালিমারবাগ ( Shalimar bagh / garden ) জাহাঙ্গীরের তৈরি অপূর্ব স্থাপত্যশিল্প। শালিমারবাগ জম্মু কাশ্মীরের শ্রীনগরে অবস্থিত।
আরও পড়ুন : শিবাজি ও মারাঠা শক্তির উত্থান
শাহজাহানের আমলের মুঘল স্থাপত্য
১) স্থাপত্যে শাহজাহানের অবদান
মুঘল স্থাপত্য শিল্পে শাহজাহানের ( Shah Jahan ) অবদান আকবরের ঠিক পরেই। এমনটা বলা হয় যে, শাহজাহানের রাজত্বকাল মুঘল ইতিহাসে স্বর্ণযুগ।
এই স্বর্ণযুগ স্থাপত্য শিল্পের উৎকর্ষের জন্য। শাহজাহান একজন মহান স্থপতি। তাই শাহজাহানের অন্য নাম ‘The prince of builders’।
শাহজাহানের শিল্প সৌধগুলি শৌখিন। সৌধগুলিতে ব্যবহার করা হয়েছিল মূল্যবান রত্নের। লাল বেলেপাথরের বদলে শ্বেতপাথরের মার্বেল শিল্পে বেশি ব্যবহার করা হয়।
শিল্পসৌধ, প্রাসাদ তৈরি যেন একপ্রকার নেশা ছিল শাহজাহানের। সেই নেশায় মত্ত হয়ে বানিয়েছেন একের পর এক প্রাসাদ, অট্টালিকা প্রভৃতি।
আগ্রা, দিল্লি, লাহোর প্রভৃতি স্থানগুলিতে শাহজাহান নির্মিত সৌধগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
দিল্লি ও আগ্রার দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, মতি মসজিদ, মুসাম্মান বার্জ, শিশমহল এই সবকটি তাঁর অনন্য কীর্তি।
মোতি মসজিদের সৌন্দর্য অপূর্ব। দেওয়ান-ই-আম -এর উত্তরদিকে এর অবস্থান। মোতি মসজিদ নির্মাণ করেন শাহজাহান।
২৩৪ ফুট লম্বা ও ১৮৭ ফুট চওড়া মতি মসজিদ নির্মাণে তখনকার সময় খরচ হয়েছিল প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা।
২) শাহজাহান নির্মিত লালকেল্লা
আগ্রা দুর্গকে অনুকরণ করে শাহজাহান নির্মাণ করেন লালকেল্লা ( Red fort / Lal qila ) বা লাল কিলা। সম্পূর্ণ লাল বেলেপাথরে তৈরি বলে তাই এই নাম।
দিল্লিতে অবস্থিত লালকেল্লা ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। আজও স্থাপত্যটি ভারতবর্ষের অহংকার ও গর্ব।
প্রতিবছর ২৬শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস ও ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী আপামর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন এইখান থেকে।
আজও দিল্লি ভারতের রাজধানী।
লালকেল্লার ভিতরে দেওয়ান-ই-আম -এর পিলার ও গম্বুজের আকার দক্ষতার সাথে করা হয়েছিল। যাতে যেকোনো স্থান থেকে সিংহাসনে বসা সম্রাটের কথা শোনা ও সম্রাটকে যাতে দেখা যায়।
৩) ময়ূর সিংহাসন
ময়ূর সিংহাসন, যা শাহজাহানের অনন্য কীর্তি। সুদূর পারস্যের শিল্পী বেবাদল খান এটি নির্মাণ করেছিলেন। সিংহাসনটি ময়ূরের আদলে তৈরি।
সিংহাসনের মাথায় কোহিনুর হীরে ও দামি দামি রত্ন দেওয়া একটি ছাতা রয়েছে। সেখান থেকে ঝুলতো আঙুরের থোকার মতো মুক্তো। দেখে মনে হোতো ময়ূর টি যেন তা ছিঁড়ে খাচ্ছে।
এই অসাধারণ ময়ূর সিংহাসনটি নাদির শাহ লুঠ করেছিলেন ১৭৩৯ সালে ভারত আক্রমণের সময়।
রঙমহলে ব্যবহার করা হয়েছিল সোনার পাত। রঙমহল মূলত আনন্দ উপভোগের স্থান হিসেবে ব্যবহার করা হোতো।
যমুনা নদীতে বাঁধ দিয়ে ক্যানেলের সাহায্যে এখানে একটি জলের ফোয়ারা বানানো হয়েছিল।
৪) শাহজাহান নির্মিত তাজমহল
এই সমস্ত স্থাপত্য শিল্পকেও ম্লান করে দিয়েছিল শাহজাহানের তৈরী করা তাজমহল ( Tajmahal )।
শাহজাহানের তাঁর পত্নী মমতাজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যমুনা নদীর তীরে তাজমহলের নির্মাণ করেন। শাহজাহান ও মমতাজের প্রেমের প্রতীক এই তাজমহল।
গঠন ও সৌন্দর্যের জন্য তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের ( Tajmahal, seven wonders of the world ) একটি।
গোটা তাজমহল তৈরি হয়েছে সাদা মার্বেল পাথর বা শিলাতে। ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ মোট বাইশ বছর সময় লেগেছিল তাজমহল তৈরি করতে।
তাজমহল বানাতে খরচ হয়েছিল আনুমানিক তিন কোটি টাকা।
পারস্যের স্থপতিকার ওস্তাদ ইসা ও কয়েক হাজার শিল্পী শ্রমিকেরা পরিশ্রম করে তাজমহল বানিয়েছেন।
পারস্য ও মুঘল রীতিকে এখানে অনুসরণ করা হয়েছে। জ্যোৎস্না রাতে তাজমহলের সুন্দরতা অমর ও শাশ্বত।
আরও পড়ুন : মৌর্য যুগের শিল্পকলা
আশা করি পোস্টটি পড়ে মুঘল যুগের স্থাপত্য শিল্প সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি এবিষয়ে কোনো মতামত থাকে তাহলে Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি শেয়ার কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণ ভাবে সাহায্য করে।