কুষাণ যুগের শিল্পকলা ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিক।
ভারতবর্ষ এক বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ। ভারতের ইতিহাস সুদীর্ঘকালের। এই সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে বিদেশী আক্রমণ বারে বারে ঘটেছে ভারতে।
এমনই একটি বিদেশী জাতি হোলো কুষাণ জাতি। একটা সময় মৌর্যরা ছিল ভারতের কেন্দ্রীয় শক্তি।
কিন্তু ভারতে সমস্ত শক্তিরই পতন হয়েছে, ইতিহাসে তার সাক্ষী। মৌর্যদের পতনের পর ভারতের কেন্দ্রীয় শক্তিব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদেশী শক্তিগুলি তৎপর হয়ে ওঠে ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করতে।
এই বিদেশী শক্তিগুলি ছিল ব্যাকট্রিয় গ্রিক, শক, পার্থিয়, কুষাণ। ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মিনান্দার, ইউক্রটিডিস প্রমুখরা।
পার্থিয় বা পহ্লব শাসকদের মধ্যে গন্ডফার্নেস ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
এই গন্ডফার্নেসের মৃত্যুর পর পার্থিয় রাজ্যে এক অবক্ষয় এসেছিল। এই অবক্ষয়ের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল কুষাণরা।
কুষাণ যুগের শিল্পকলা ( Kushan period art )
ক) গান্ধার শিল্প ( Gandhara art )
i) গান্ধারের অবস্থান
গান্ধার প্রাচীন ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত একটি রাজ্য ছিল।
প্রাচীন ভারতে যে ষোলোটি মহাজনপদ ছিল তার মধ্যে গান্ধার হোলো অন্যতম। বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি ছিল এই গান্ধারের অধীনে।
তখন গান্ধারের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা।
সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র এই গান্ধার রাজ্যটি। ধীরে ধীরে গান্ধার বিদেশী শাসকদের অধিকারে চলে যায়।
একসময় কুষাণদের অধিকারে এসেছিল ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী গান্ধার রাজ্যটি। কুষাণ শাসক কণিষ্কের সময় গান্ধার শিল্পচর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।
কুষাণ যুগের গান্ধার শিল্প ভারতীয় শিল্প বৈচিত্র্যের এক উজ্জ্বল নমুনা।
এখন প্রশ্ন হোলো, কেন গান্ধারকে কেন্দ্র করে এই শিল্প গড়ে উঠলো ?
আসলে গান্ধার এমন একটি অঞ্চল ছিল যেখানে পারসিক, গ্রীক, শক, কুষাণ সবাই তাদের অধিকার কায়েম করে।
সেইসাথে পারস্য, রোম এই দেশগুলির সাথেও গান্ধার অঞ্চলটির পরিচিতি গড়ে ওঠে।
এর ফলে গ্রীক, শক, কুষাণ, রোমান, পারস্য সবার ভাবধারা, আদবকায়দা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
জন্ম নেয় এক শিল্পের, তার নামই গান্ধার শিল্প ( Gandhar art )। কুষাণদের সময়েই গান্ধার শিল্প উন্নতির চরমে ওঠে।
ii) গান্ধার শিল্পের উৎপত্তিস্থল
গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি হয়েছিল বেগ্রাম, সোয়াট উপত্যকা, তক্ষশিলা, হাদ্দা, তাখত-ই-বাহী প্রভৃতি জায়গায়।
খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে শুরু হয়ে ৪০০ বছরেরও বেশি সময় যাবৎ গান্ধার শিল্প টিকে ছিল।
তবে কুষাণ সম্রাট কণিষ্কের সময় গান্ধার শিল্প বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। কারণ সম্রাট কণিষ্ক শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
আরও পড়ুন : মৌর্য যুগের শিল্পকলা
iii) গান্ধার শিল্পের বৈশিষ্ট্য
এবারে গান্ধার শিল্পের কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যাক। বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে এই শিল্প সম্বন্ধে আরও অনেক স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে।
- ১) ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে গান্ধার প্রদেশকে কেন্দ্র করে এই শিল্প জন্মলাভ করেছিল।
- ২) গ্রীক ও রোমান শিল্প রীতিতে বৌদ্ধ ও ভারতীয় ধর্ম, দর্শনকে রূপদান গান্ধার শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
- ৩) গান্ধার শিল্পের মূল বিষয় ছিল বৌদ্ধ ধর্ম এবং বুদ্ধমূর্তি।
- ৪) গান্ধার শিল্পে বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের দিকটি প্রকাশ পেয়েছিল।
- ৫) গান্ধারের শিল্প নিদর্শন তৈরির সময় ব্যবহার করা হোতো পাথর, প্লাস্টার, চুন, বালি ও রং।
- ৬) গান্ধারে বুদ্ধ মূর্তি তৈরির সময় মূর্তিতে গ্রীক দেবতা অ্যাপোলো, জিউস প্রভৃতিদের রূপ দেওয়া হয়েছিল।
- ৭) গান্ধার শিল্পরীতিতে গ্রীক শিল্পরীতির ছাপ স্পষ্ট। তাই গ্রীক শিল্পরীতি অনুযায়ী বুদ্ধ-বোধিসত্ব মূর্তিগুলোতে কোঁকড়ানো চুল, মাংসপেশীওয়ালা চওড়া কাঁধ, মোটা গোঁফের ব্যবহার ইত্যাদি করা হয়েছে।
- ৮) গান্ধার শিল্পরীতির মূর্তিগুলিতে রোমান টোগা পোশাকের মতো দেখতে ভারী পোশাকের ব্যবহারও দেখতে পাওয়া যায়।
iv) গান্ধার শিল্পের মূল বিষয়বস্তু
গান্ধার শিল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিল বুদ্ধ ও বৌদ্ধধর্ম। বুদ্ধদেবের মূর্তি নির্মাণের প্রচলন গান্ধার শিল্পের মধ্যে দিয়েই শুরু হয়।
কিন্তু এই শিল্পের জন্মের আগে চক্র, বোধিবৃক্ষ, খালি পড়ে থাকা সিংহাসন ইত্যাদি প্রতীকের দ্বারা বুদ্ধদেবকে কল্পনা করা হোতো।
কিন্তু গান্ধারে গ্রীক ও ভারতীয় শিল্পরীতির মিশ্রণে বুদ্ধদেবের যে মূর্তিগুলি বানানো শুরু হয়েছিল তা সত্যিই অনন্য।
ভারতীয় জীবন, ধর্ম ও মূর্তির নির্মাণে এই বিদেশীয় প্রভাবই গান্ধার শিল্পের প্রধান গুরুত্ব। তাই বলা যায় যে, শিল্প নির্মাণে গান্ধার শিল্পীদের হাত ছিল গ্রীক-রোমানদের আর হৃদয় ও মস্তিষ্ক ছিল ভারতীয়দের। সত্যিই যেন এক দারুণ মেলবন্ধন।
খ) মথুরা শিল্প ( Mathura art )
i) মথুরার অবস্থান
উত্তর ভারতের একটি বিখ্যাত শহর মথুরা। বর্তমানে ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত। প্রাচীন ভারতে ষোলোটি মহাজনপদের মধ্যে শূরসেন নামে একটি রাজ্য ছিল।
সেইসময় এর রাজধানী ছিল মথুরা।
প্রাচীন গ্রীক লেখকরা তাঁদের রচনাতে মথুরাকে ‘মেথোরা’ নামে অভিহিত করেছিলেন। মথুরা যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত।
স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ( Lord Krishna birthplace ) এই মথুরাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই ভারতে কৃষ্ণ উপাসনার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে মথুরার খ্যাতি আজও অটুট।
মনে করা হয় যে, মধুরা, মধুপুরী, মদুরা প্রভৃতি নামগুলি থেকেই মথুরা নামটির উৎপত্তি হয়েছে।
মথুরাকে বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে মনে করা হয়। একসময় কুষাণ শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল মথুরা। কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক নিজেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন।
কুষাণদের পৃষ্ঠপোষকতায় যেমন গান্ধারে একটি শিল্পরীতি গড়ে উঠেছিল। ঠিক তেমনি মথুরাতেও কুষাণদের সময়কালে এক শিল্পরীতি গড়ে ওঠে, যা মথুরা শিল্প ( Mathura art ) নামে পরিচিত।
ii) মথুরা শিল্পের বিষয়বস্তু
গান্ধার শিল্পের মতো মথুরা শিল্পেরও মূল বিষয়বস্তু ছিল বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধৰ্ম।
মথুরা শিল্পে বুদ্ধ মূর্তিগুলির নির্মাণে শিল্পীরা অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
iii) মথুরা শিল্পের উৎপত্তিস্থল
মথুরাতে এই শিল্পের উৎপত্তি হলেও সারনাথ, সাহেত-মাহেত ( শ্রাবস্তী ), কৌশাম্বীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মথুরা শিল্পের বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে।
মথুরা শিল্পে সিক্রি থেকে নিয়ে আসা লাল রঙের বেলেপাথরের ব্যবহার করা হয়েছিল। যা এই শিল্পের জৌলুসতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
iv) মথুরা শিল্পের বৈশিষ্ট্য
মথুরা শিল্পের কিছু বৈশিষ্ট্য দেওয়া হোলো। বৈশিষ্ট্যগুলি থেকে এই শিল্প সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
- ১) মথুরা নগরীকে কেন্দ্র করে এই শিল্প বিকাশলাভ করেছিল।
- ২) গান্ধারের মতো মথুরা শিল্পেও বুদ্ধমূর্তি তৈরির রীতি প্রচলিত ছিল।
- ৩) এই শিল্পরীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করা হয়েছিল। কারণ শুধু বুদ্ধদেবের মূর্তি নয় সেইসাথে জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিও নির্মিত হয়।
- ৪) মথুরার সমস্ত শিল্প ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছিল লাল বেলেপাথর দিয়ে।
- ৫) মথুরা শিল্পের বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলির মুখমন্ডল গোল আকারের হোতো। মস্তক থাকতো মুন্ডিত ও মূর্তিতে গান্ধার শিল্পের মতো গোঁফ ছিল অনুপস্থিত।
- ৬) কণিষ্কের মস্তকবিহীন দন্ডায়মান মূর্তিটি মথুরা শিল্পরীতির এক নিদর্শন।
- ৭) মথুরা শিল্প ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় ভাবধারায় পুষ্ট।
- ৮) মথুরা শিল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিল বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম।
কুষাণ যুগের মথুরা শিল্পের বুদ্ধ ও বোধিসত্ত্ব মূর্তিগুলি অফুরন্ত শক্তি ও প্রাণোচ্ছলতায় ভরপুর। বুদ্ধের মস্তক গোলাকার, মুন্ডিত এবং গোঁফবিহীন।
হয় সিংহাসনে, নতুবা পদ্মাসনে বুদ্ধদেব বসায়মান। মুখে স্মিত হাসি। ডান হাত অভয়মুদ্রা ভঙ্গিতে এবং বাঁহাত ঊরুর ওপর রাখা। চওড়া কাঁধ ও বুক সামনের দিকে ফোলানো।
শরীরের পোশাক কিছুটা ভাঁজ অবস্থায়।
শুধু বুদ্ধমূর্তি নয় জৈন তীর্থঙ্করদের মূর্তিও মথুরা শিল্পে স্থান পেয়েছে। যেমন, মহাবীর, ঋষভনাথ, সম্ভবনাথ প্রমুখদের মূর্তি।
এছাড়াও শাসকদের মূর্তিও মথুরা শিল্পের এক অন্যতম নিদর্শন। কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক, বিম কদফিস, শক শাসক চষ্টন প্রমূখদের মূর্তিও শিল্পীরা নির্মাণ করেছিলেন।
ইতিহাসের পাতায় সম্রাট কণিষ্কের মস্তকহীন যে মূর্তি আমরা দেখি তা মথুরা শিল্পের নিদর্শন।
মূর্তিটির গায়ে ভারী পোশাক, পায়ে বুট জুতো এবং কোমরে তরবারি গোঁজা। বর্তমানে মথুরা মিউজিয়ামে মূর্তিটি সংরক্ষিত রয়েছে।
যদি গান্ধারের সাথে মথুরা শিল্পের তুলনা করা হয়, তাহলে বলা যায় মথুরা শিল্প সম্পূর্ণ ভারতীয় ভাবধারায় পরিপূর্ণ।
অপরদিকে গান্ধার শিল্প ছিল হেলেনীয় বা গ্রীকের মতো বিদেশী প্রভাবে পরিপূর্ণ। পার্থক্য রয়েছে উভয় শিল্পের মূর্তিগুলির পোশাকেও।
যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে।
কুষাণ কারা
কুষাণ যুগের শিল্পকলা আলোচনা প্রসঙ্গে কুষাণদের সম্পর্কেও জানা জরুরী।
কুষাণরা হোলো মধ্য এশিয়ার ইউ – চি নামের এক যাযাবর জাতি।
একসময় হিউং – নু , শক ও ইউ – চি এই তিন যাযাবর জাতি ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
ইউ – চি-রা হিউং – নু এবং শকদের পরাজিত করে অক্ষু বা আমুদরিয়া নদীর তীরে এসে উপস্থিত হয়। এখানে থেকেই ইউ – চি-রা ব্যাকট্রিয়া দখল করে নেয়।
এরপর ইউ চি-রা পাঁচটি শাখায় ভাগ হয়ে যায়। হিউ – মি, শুয়াং – মি, কুই – শুয়াং, হি – তুয়েন এবং তু – মি এই হোলো সেই পাঁচটি শাখা।
এদের মধ্যে কুই – শুয়াং বা পরিচিত কুষাণরাই সবচাইতে শক্তিশালী জাতি হিসেবে নিজেদের মেলে ধরে।
কুজুল কদফিসেস ছিলেন এই কুষাণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মূল কর্ণধার।
বিদেশ থেকে এসে কুষাণরা প্রায় ২০০ বছর ভারতে শাসন চালিয়েছিল।
সেই সুবাদে কুষাণরা ভারতীয় সংস্কৃতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ছাপ ছেড়ে যায়। কুষাণযুগের শিল্পকলা সত্যিই যেন জীবন্ত ও অনন্য।
উপসংহার
সবশেষে বলা যেতে পারে কুষাণ যুগে শিল্পের ক্ষেত্র সত্যিই উর্বর। যেন বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ।
সাঁচী স্তূপের চারটি তোরণ, মথুরা, সারনাথ-র স্থাপত্য ভাস্কর্য কুষাণ যুগের অপূর্ব সৃষ্টি।
বৈদেশিক জাতিগুলির মধ্যে, কুষাণদের শিল্পকলায় ( Kushan art ) এই অবদান সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।
কুষাণ রাজারা শিল্পকলার ক্ষেত্রে যে অধ্যায় রচনা করেছিলেন গুপ্তরাজারা সেই পথে হেঁটে তার গৌরব আরও বৃদ্ধি করেন।
আরও পড়ুন : ষোড়শ মহাজনপদ
আশা করবো এই পোস্টটি পড়ে কুষাণ যুগের শিল্পকলা সম্বব্ধে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে তোমার মতামত জানিও। আর অবশ্যই পোস্টটি অন্যদের সাথে শেয়ার কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। ভালো থেকো বন্ধু…...