ফ্রান্স ও জার্মানির শিল্পবিপ্লব ( Industrial Revolution of France & Germany )
শিল্প বিপ্লব প্রথম শুরু হয় ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ড প্রধানত একটি কৃষিপ্রধান দেশ ছিল। কৃষিকাজ চলতো পুরোনো পদ্ধতিতে।
কিন্তু এই পুরোনো পদ্ধতিতে তো বেশিদিন চলা যায় না। তাই সেইসময় ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জ যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের উদ্যোগ নিলেন।
রীতিমতো বৈজ্ঞানিক প্রথায় আবিষ্কার হোলো বিভিন্ন যন্ত্রপাতির। আর সেইসাথে কৃষিতে এলো অভাবনীয় সাফল্য।
দেখতে দেখতে ইংল্যান্ড পরিণত হোলো কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্প প্রধান দেশে। ইংল্যান্ড শিল্প নগরীতে পরিণত হওয়ায় বহু শ্রমিকের ভিড় জড়ো হতে লাগলো সেখানে।
একেবারে সংক্ষেপে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের প্রাথমিক ধারণা এখানে রাখলাম। যাতে বুঝতে সুবিধা হয়।
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব নিয়ে আগের দুটি পোস্ট অবশ্যই দেখে নিও।
যাই হোক এই শিল্প বিপ্লবের ঢেউ ইউরোপের ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়াসহ অন্য দেশগুলোতেও এসে পৌঁছোয়। ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের এইরূপ গতি দেখে এই দেশগুলির চোখ খুলে যায়।
তারাও ভাবতে থাকে কিভাবে তাদের দেশেও শিল্প গড়ে তোলা যায়।
এই ভাবনা থেকেই ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশে নতুন করে শিল্প বিপ্লব ঘটে। এরপর কি ঘটে তা জানার জন্য এই পোস্টটি পুরোটা পড়তে হবে।
ফ্রান্সের শিল্প বিপ্লব
ফ্রান্স পশ্চিম ইউরোপের একটি দেশ। সেইসাথে ইউরোপের শক্তিধর দেশও।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী দেশ ফ্রান্স। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক ক্ষেত্র হিসেবেও ফ্রান্সকে ধরা হয়।
সেই বহুকাল থেকেই ফ্রান্স শিল্পকলা, দর্শন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তির অন্যতম কেন্দ্র। রুশো, ভলতেয়ার, মন্তেস্কুর মতো মহান দার্শনিকরা ফ্রান্সের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন।
বিশ্বের সবচাইতে সুন্দর পর্যটন স্থানগুলি ফ্রান্সে অবস্থিত।
বর্তমানে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস ( Parris ) ফ্রান্সের সুন্দর একটি শহর ও মূল কেন্দ্র।
ফ্রান্স রাজনীতি ও সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠেছিল নেপোলিয়ান বোনাপার্টের হাত ধরে। বলা যায় নেপোলিয়ান ছিলেন আজকের আধুনিক ফ্রান্সের কান্ডারী।
মূল বিষয় থেকে সরে এসে এই তথ্যগুলি তুলে ধরার কারণ একটাই, তা হোলো ধারণা তৈরী করা।
কোনো বিষয় পড়ার আগে সেসম্পর্কে ধারণা থাকাটা খুব জরুরী।
ফিরে আসি মূল কথাতে। শিল্পের দিক থেকে ফ্রান্স গোড়ার দিকে খুবই পিছিয়ে ছিল। ফ্রান্সে শিল্প বিপ্লব আসে অনেক দেরিতে।
প্রায় ১৮৪৮ সালের পর ফ্রান্সে শিল্প গড়ে উঠতে থাকে।
ফ্রান্সের শিল্প বিপ্লব দেরিতে আসার কারণ, ফ্রান্সে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ব্যবহারের চল তখন সেইভাবে ছিল না। যন্ত্র চালাতে গেলে সেইসময় বাষ্পীয় ইঞ্জিনের একান্ত প্রয়োজন ছিল।
তাছাড়া ফ্রান্সের রাজপরিবারের দিক থেকেও শিল্পের প্রতি একটা অনীহা ছিল।
ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণী চাইতো পুরাতন কৃষি ব্যবস্থা বজায় থাকুক। যাতে কৃষকদের শোষণ করা যেতে পারে।
ইতিমধ্যে ফরাসী বিপ্লব ঘটে গোটা ফ্রান্সে।
ফ্রান্সের মধ্যযুগীয় অন্ধকারময় সমাজ বিপ্লবের আঘাতে চুরমার হয়ে যায়।
এরপরে নেপোলিয়ানের হাতে ক্ষমতা আসায় তিনি সমগ্র ফ্রান্সের আধুনিকীকরণ করেন।
আরও পড়ুন : শিল্প বিপ্লবের ফলাফল
ফ্রান্সে শিল্পের অগ্রগতি –
শিল্প গড়ে ওঠার একটি অন্যতম শর্ত রেলপথ স্থাপন। কারণ শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে তৈরী দ্রব্য দূরে বা কাছে পাঠাতে রেলপথের দরকার।
আর স্থলপথে পাঠাতে সুন্দর পাকা রাস্তার প্রয়োজন।
১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা উন্নত যন্ত্রপাতিগুলি বানাতে থাকেন। প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার লাভ হয়।
এর ফলে প্রথমদিকে প্রায় ৩০,০০০ কিলোমিটার পাকা সড়ক তৈরী হয়। প্যারিস থেকে সেন্ট জার্মেইন অব্দি রেলপথ গড়ে ওঠে।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে ফ্রান্সের শিল্প ব্যবস্থা রকেট গতিতে এগিয়ে চলে।
আরো বেশি করে বাষ্পীয় ইঞ্জিন, রেলপথ তৈরী হয়। শিল্পে প্রচুর পরিমাণে লোহা, কয়লার দরকার হয়। বলা ভালো এইদুটি জিনিস শিল্পের প্রধান কাঁচামাল।
পেরিয়ার ব্রাদার্স, লাফিট, হোপের মতো বড়ো বড়ো পুঁজিবাদী সংস্থাগুলো নিজেদের তাগিদে লোহা, কয়লার কারখানা স্থাপনে এগিয়ে আসে।
শিল্পের জন্য প্রয়োজন শিল্প ঋণের।
এর জন্য গড়ে উঠলো ক্রেডিট মবিনিয়ার, ক্রেডিট ফসিয়ার ইত্যাদির মতো শিল্প ঋণ প্রদানকারী ব্যাঙ্ক।
আলসাস ও লোরেন ছিল ফ্রান্সের প্রধান দুটি কয়লা ও লোহা খনি। এইদুটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে বহু কারখানা ফ্রান্সে গড়ে ওঠে।
এছাড়াও গড়ে উঠেছিল সুতীর কাপড়ের কারখানা, রেশম শিল্পের কারখানা, রাসায়নিক কারখানা ইত্যাদি।
এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছিল রেলপথের জন্য। রেলপথ যেন ফ্রান্সের শিল্প অঞ্চলগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলেছিল।
ফ্রান্স আরো বেশি শিখরে পোঁছায় বিলাসদ্রব্যের শিল্পের জন্য। যার মধ্যে প্রধান হোলো সুগন্ধি। আজও কিন্তু ফ্রান্সের সুগন্ধি শিল্প ( Perfume industry ) সারা বিশ্বের কাছে সমাদৃত।
জার্মানির শিল্প বিপ্লব
জার্মেনিয়া নামটি থেকেই জার্মানি নামটি এসেছে। জার্মানি মধ্য ইউরোপের একটি দেশ।
ইউরোপের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।
বর্তমানে জার্মানি ইউরোপের একটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশ। সেইসাথে ইউরোপের প্রবল শক্তিধর দেশগুলির একটি।
জার্মানির রাজধানী শহর বার্লিন ( Berlin )।
জার্মানরা বিশ্বের ইতিহাসে শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি সবেতেই উৎকৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে।
উইলহেলম লেইবনিজ, ইমানুয়েল কান্ট, কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস, ফ্রেডরিখ নিৎসে প্রমুখ মহান জার্মান দার্শনিকরা জার্মানি তথা সারা বিশ্বের গৌরব।
জার্মানির অর্থনীতির ভিত্তি খুবই শক্তিশালী। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান অর্থনৈতিক মেরুদন্ড।
জার্মানির মোটরগাড়ি শিল্পকে বর্তমানে সারা বিশ্ব কদর করে।
বহুপূর্বে জার্মানি পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানিতে বিভক্ত ছিল। বার্লিনকে কেন্দ্র করে দুই জার্মানির মধ্যে প্রাচীরের সীমারেখা টানা হয়েছিল।
যা বার্লিন প্রাচীর ( Berlin wall ) নামে পরিচিত। ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে গিয়ে দুই জার্মানি মিলে মিশে যায়। রূপ নেয় এক নতুন জার্মানি।
জার্মানিতেও শিল্প বিপ্লব দেরিতে আরম্ভ হয়েছিল।
১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে যখন শিল্প বিপ্লবের জোয়ার বইছে তখন জার্মানি সমস্যায় জর্জরিত। জার্মানি তখন একটি কৃষি প্রধান অঞ্চল।
গোটা জার্মানিতে বাণিজ্য কেন্দ্র বলতে হ্যামবুর্গ ও ফ্রাঙ্কফুর্ট-র মতো দুটো শহর। একমাত্র কুটিরশিল্পই জার্মানির মানুষের চাহিদা মেটাতো।
সময়ের চাকা ঘুরলো, ১৮৭০ সালের পর জার্মানি শিল্পে বাণিজ্যে শক্তিধর হয়ে উঠলো।
বিজ্ঞান , প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে হাতিয়ার করে জার্মানির শিল্প পালতোলা নৌকোর মতো এগিয়ে চললো। এ যেন এক চমকপ্রদ উত্থান।
১৮৭০-১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ জার্মানির জন্য শিল্পগঠনের যুগ ছিল। এরপর জার্মানিকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
কিন্তু প্রথমে ১৮১৫-১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিল্প গড়তে অনেক বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল দেশটিকে।
প্রথমত, জার্মানি ৩৮ টি রাজ্যে বিভক্ত ছিল। একেকটি রাজ্যের শুল্ক ( Tax ) ব্যবস্থা ছিল একেকরকম।
এরফলে শিল্পের কাঁচামাল এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পাঠাতে অনেকসময় বেশি হারে শুল্ক দিতে হোতো।
দ্বিতীয়ত, জার্মানিতে পরিবহন ব্যবস্থা ভালো ছিল না।
এখানে নদীগুলির অবস্থান এমন ছিল যার ফলে, নদী পার করে কয়লা, লোহার মতো কাঁচামাল নিয়ে আসা ছিল কষ্টসাধ্য।
তৃতীয়ত, শিল্পের প্রধান উপাদান মূলধনের ( Capital ) অভাব ছিল। মূলধন ছাড়া শিল্প গড়ে উঠতে পারে না।
কিন্তু কৃষিপ্রধান জার্মানিতে মূলধন জোগানোর মতো ভালো মূলধনী সংস্থাই সেসময়ে গড়ে ওঠেনি।
ইত্যাদি কারণগুলি জার্মানিতে শিল্প বিপ্লব দেরিতে আসার অন্যতম কারণ।
জার্মানিতে শিল্পের অগ্রগতি –
১৮৪০ সালের পর থেকে জার্মানির শিল্প গঠনের টালমাটাল পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
জার্মানির বিভিন্ন রাজ্যে শিল্পায়নের শুভ হাওয়া বইতে শুরু করে। রেলপথ নির্মাণ জার্মানির শিল্প গঠনের ভোল বদলে দেয়।
এতদিন জার্মানির যে দুর্গম ও সম্পদশালী অঞ্চলগুলিতে যাওয়া অসাধ্য ছিল রেলপথ এসে সেই কাজকে সহজ করে দেয়।
ফ্রেডরিখ লিস্ট ( Friedrich List ) ছিলেন একজন জার্মান অর্থনীতিবিদ।
জার্মানিতে রেলপথ নির্মাণের তিনি ছিলেন প্রধান জনক।
ফ্রেডরিখ লিস্ট সর্বপ্রথম জার্মানিতে লাইপজিগ থেকে ড্রেসডেন পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ করেন।
এই রেলপথের মাধ্যমেই শিল্পের কাঁচামাল কারখানাগুলোতে সহজে পৌঁছে যায়। তথ্য অনুযায়ী ১৮৫০ সালে জার্মানিতে ৩ হাজার মাইলের বেশি রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছিল।
পরে এই সংখ্যা আরও বেড়েছিল।
জার্মানির রাজ্যগুলিতে যেহেতু নির্দিষ্ট শুল্ক ব্যবস্থা ছিল না তাই ‘জোলভেরাইন ‘ বা শুল্ক সংঘ গঠিত হয়।
এরফলে গোটা জার্মানিতে একই হারে শুল্ক, জিনিসপত্রের এক ওজন, একই মুদ্রা ব্যবস্থা চালু হয়। অর্থাৎ মাল চলাচলে আর কোনো বাধা রইলো না।
সময়কাল ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ, জার্মানির শিল্পের অগ্রগতি আগের চেয়েও আরও বেশি প্রাণবন্ত ও চমকপ্রদ।
বাড়তি ৬ হাজার মাইল রেলপথ, বেসরকারি মূলধনী সংস্থার আবির্ভাব ও সেইসাথে ব্যাঙ্ক গড়ে ওঠা।
ব্যাঙ্কগুলি একযোগে কাজ শুরু করে। বিভিন্ন শিল্পের জন্য ব্যাঙ্কগুলি লোন দেওয়া শুরু করে।
বেসরকারি মূলধনী সংস্থাগুলিও শিল্পে লগ্নি করতে আগ্রহ দেখায়। এইসময়কালে জার্মানিতে টেলিগ্রাফ পরিষেবা চালু হয়।
বিশিষ্ট জার্মান ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ওয়ার্নার ভন সিমেন্স ( Werner von Siemens ) জার্মানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করেন।
শিল্পে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। বিদ্যুৎ চালু হওয়ায় জার্মানির শিল্পের পক্ষে তা শুভ ফলদায়ক হয়।
ধীরে ধীরে লোহা, কয়লা, রাসায়নিক উৎপাদনে জার্মানির স্থান উপরে উঠে আসে।
এছাড়াও রাবার, নাইট্রেটের মতো রাসায়নিক, জীবনদায়ী ঔষধ, যুদ্ধের অস্ত্র নির্মাণ ইত্যাদির মতো শিল্প নির্মাণে জার্মানি এক ও অদ্বিতীয় হয়ে ওঠে।
তার ওপর জার্মান বিজ্ঞানীদের একের পর এক আবিষ্কার জার্মানিকে জগৎজোড়া নাম এনে দেয়।
জার্মানি তার প্রযুক্তিবিদ্যাকে হাতিয়ার করে শিল্পে এই সাফল্য পেয়েছিল।
জার্মান জাতির ঐক্যবদ্ধতা, কর্মদক্ষতা, প্রতিভাকে অবশ্যই কুর্নিশ জানাতে হয়।
সেইসাথে ইউরোপের সেরা জাতি হয়ে ওঠার প্রবল ইচ্ছা জার্মানির সাফল্যের মুকুটে এক নতুন পালক যোগ করে।
আরও পড়ুন : ভারতীয় রাজ নর্তকীদের ইতিহাস
আশা করি এই পোস্টটি পড়ে ফ্রান্স ও জার্মানির শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতে পেরেছো। যদি এই পোস্টটি ভালো লেগে থাকে তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে তোমার মতামত জানিও। আর অবশ্যই পোস্টটি অন্যদের সাথে শেয়ার কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। ভালো থেকো বন্ধু …..