ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব (Industrial Revolution in England)
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কথা ইতিহাসে নিশ্চই পড়ে থাকবে। আর যদি না পড়ে থাকো তাহলে এই পোস্টটি তোমার জন্য।
প্রথমেই জেনে নেবো বন্ধু , বিপ্লব বা Revolution কি ? বিপ্লব হোলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে কোনো কিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটে।
আমরা অনেক বিপ্লবের কথাই শুনেছি যেমন, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, ভারতের স্বাধীনতা বিপ্লব ইত্যাদি। কিন্তু এই বিপ্লব কথাটি যখন শিল্পের সাথে জুড়ে যায় তখন সেটিকে বলা হয় শিল্প বিপ্লব ( Industrial Revolution )।
অর্থাৎ শিল্প ক্ষেত্রে একটি বিরাট পরিবর্তন দেখা যায়। যাই হোক এই শিল্প বিপ্লব প্রথম শুরু হয় ইংল্যান্ডে।
তারপর সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপের অন্য দেশগুলিতে। এই পোস্টে তোমাকে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লব সম্পর্কে জানাবো। তাই জানতে হলে এই পুরো পোস্টটি তোমাকে পড়তে হবে।
শিল্প বিপ্লব কি ?
শিল্প বিপ্লব কি বা কাকে শিল্প বিপ্লব বলে প্রথমে এটা জেনে নাও। বন্ধু শিল্প বিপ্লব হলো সেই বিপ্লব যা শিল্পক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছিল।
অষ্টাদশ শতকের শেষের কথা, ঠিক সেইসময় ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শিল্পদ্রব্য উৎপাদনে হঠাৎ এক পরিবর্তন ঘটে যায় একেই শিল্প বিপ্লব বলা হয়।
আর একটু সহজ করে যদি বলি তা হোলো, এর আগে মানুষ তাঁর হাত দুটি দিয়ে শিল্প দ্রব্য উৎপাদন করতো। কিন্তু বিপ্লবের ফলে এলো যন্ত্র। এর ফলে আগের থেকে উৎপাদনও গেল বেড়ে।
শিল্প দ্রব্যের এই উৎপাদন বেড়ে যাওয়াকেই বলা হলো শিল্প বিপ্লব।
শিল্প বিপ্লবের সময়কাল
তুমি কি জানো যে, শিল্প বিপ্লব কথাটিকে সর্বপ্রথম ব্যবহার বা জনপ্রিয় করেছিলেন ফরাসি লেখক অগাস্ট ব্ল্যাঙ্কি। এরপর কথাটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
তবে শিল্প বিপ্লবের সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। তবুও বেশিরভাগ ঐতিহাসিকরাই মনে করেন যে, ১৭৬০-১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের সময়কালই হলো শিল্প বিপ্লবের কাল।
আরও পড়ুন : ভারতীয় রাজ নর্তকীদের ইতিহাস
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের কারণ
ইংল্যান্ডে প্রথমে কুটির শিল্প ছিল। কিন্তু কুটির শিল্প ছোটো শিল্প হওয়ায় শিল্প দ্রব্য কম উৎপাদন হোতো। এই কুটির শিল্পের জায়গায় একদিন চলে এলো কারখানা নিয়ে গড়ে ওঠা যন্ত্র শিল্প।
ফলে আগের থেকে অনেক বেশি পরিমাণে দ্রব্য তৈরী হতে লাগলো। কিন্তু কেন এই যন্ত্র শিল্প ইংল্যান্ডে এসে শিল্প বিপ্লব ঘটালো ? এর পিছনে কিছু কারণ অবশ্যই লুকিয়ে আছে। সেই কারণগুলি সম্পর্কে এইবার আলোচনা করবো।
কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়ন –
কৃষিকাজ কিন্তু শিল্প গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে একটা বড়ো ভূমিকা পালন করে থাকে। ইংল্যান্ডও কিন্তু তার ব্যাতিক্রম ছিল না। ইংল্যান্ড প্রথমে কৃষি প্রধান দেশই ছিল।
ইংল্যান্ডের রাজা ৩য় জর্জের সময় অনেক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়। এরই সাথে রবার্ট বেকওয়েল নামে এক ব্যাক্তি আবিষ্কার করে ফেললেন পশুর কৃত্রিম খাদ্য ও জমির সার।
এর ফলে কৃষিকার্যে ঘটলো এক অভাবনীয় উন্নতি। বহু পতিত জমি কৃষিজমিতে বদলে গেল। জোতদার শ্রেণীরা অবলুপ্ত হয়ে ইংল্যান্ডের শিল্পনগরীর শ্রমিক হয়ে গেলেন।
যে ইংল্যান্ড ছিল কৃষি প্রধান দেশ, সেই ইংল্যান্ড পরিণত হলো শিল্প প্রধান দেশে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ –
প্রাকৃতিক পরিবেশ ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের জন্য সহায়ক হয়েছিল। ইংল্যান্ডের আবহাওয়া ছিল স্যাঁতসেঁতে ভেজা ধরণের। এইরকম আবহাওয়া বয়নশিল্পের জন্য খুব ভালো ছিল।
কারণ আর্দ্র্য বা ভেজা জলবায়ুতে সুতো বোনার সময় চট করে ছিড়ে যেতো না। অন্যদিকে ভৌগোলিক দিকটিও ইংল্যান্ডের পক্ষেই ছিল। ইংল্যান্ড ছিল সমুদ্র, নদী, জলপ্রপাত দিয়ে বেষ্টিত।
সমুদ্র বেষ্টিত হওয়ায় বহু বন্দর গড়ে ওঠে এখানে। যার ফলে মালপত্র পরিবহনে সহায়ক হয়। নদী, জলপ্রপাতের স্রোতকে জলশক্তি উৎপাদনের কাজে লাগানো হয়। তাই এইরকম প্রাকৃতিক পরিবেশ থাকার কারণে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে।
কাঁচামালের সহজলভ্যতা –
শিল্পের উন্নতির জন্য চাই কাঁচামাল। কাঁচামাল ছাড়া শিল্প গড়ে উঠতে পারে না। বৃহৎ শিল্পের উন্নতি ও প্রসারের জন্য কাঁচামাল হিসেবে লোহা, কয়লা ইত্যাদির একান্ত প্রয়োজন।
আর এগুলির প্রত্যেকটাই ইংল্যান্ডে প্রচুর পরিমাণে ছিল। ইংল্যান্ডে মাটির তলায় কয়লা ও লোহার অফুরন্ত ভান্ডার থাকায় শিল্পের সংখ্যা বেড়েছিল। কাঁচামাল সহজলভ্য হওয়ার কারণে ইংল্যান্ড শিল্পে সকলের অগ্রণী হয়ে ওঠে।
মূলধন –
শিল্প-কারখানা গড়তে গেলে মূলধনের প্রয়োজন হয়। মূলধনের যোগান ঠিক থাকলে শিল্প নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে।
ইংল্যান্ডের বণিকেরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাঁদের পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে যে প্রচুর অর্থ রোজগার করেছিল তা তাঁরা শিল্পে বিনিয়োগ করে। এই বণিকরা ধীরে ধীরে মালিকে পরিণত হয়।
ইংল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাঙ্কগুলি শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসে এইসময়। কম সুদের বিনিময়ে ব্যাঙ্কগুলি শিল্প ঋণ দিয়েছিল।
এছাড়াও ছিল কিছু অর্থলগ্নি সংস্থা, যেমন- রথচাইল্ড, বেয়ারিং ইত্যাদি। এরাও শিল্পে মূলধন বিনিয়োগ করেছিল।
শ্রমিক –
শিল্পের প্রসারের জন্য যেসব উপকরণের দরকার হয় তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হোলো শ্রমিক। শ্রমিক তাঁর ঘাম ঝরিয়ে পরিশ্রম করে শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে চলে।
ইংল্যান্ডের কলকারখানার প্রসারের জন্য শ্রমিকের কোনো অভাব ছিল না। কারণ সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ইংল্যান্ডের জনসংখ্যা প্রচুর হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল।
তাছাড়াও ইউরোপের অন্য দেশগুলির থেকেও বহু শ্রমিক ইংল্যান্ডে ভিড় জমিয়েছিল রুটিরুজির সন্ধানে। তাই ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটার এটিকে একটি অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়।
বিভিন্ন যন্ত্রের আবিষ্কার –
অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডে বেশ কয়েকটি যন্ত্রের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল। যন্ত্রগুলি আবিষ্কারের পর শিল্পে অভাবনীয় উন্নতি হতে শুরু করেছিল। প্রথমে বয়ন শিল্পের যন্ত্র আবিষ্কার হয়।
এরপর একে একে অন্য শিল্পগুলির যন্ত্রও আবিষ্কার হয়। ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন কে আবিষ্কার করে বসলেন ‘ফ্লায়িং শাট্ল ‘ বা ‘উড়ন্ত মাকু ‘ নামক বয়ন শিল্পের যন্ত্র।
এরপর এলো বৈজ্ঞানিক হারগ্রিভস-এর আবিষ্কৃত ‘স্পিনিং জেনি ‘ বা সুতো বোনার যন্ত্র। আর্করাইট ও কার্টরাইট নামে দুই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছিলেন ‘ওয়াটার ফ্রেম ‘ বা জলশক্তি চালিত যন্ত্র এবং ‘পাওয়ারলুম ‘ বা শক্তি চালিত তাঁত বোনার যন্ত্র।
ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবে আরও অগ্রগতি শুরু হোলো যখন বৈজ্ঞানিক জেমস ওয়াট (James Watt) বাষ্পীয় শক্তি ব্যবহারের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে আবিষ্কার করলেন ‘স্টিম ইঞ্জিন ‘ বা বাষ্পীয় ইঞ্জিন-এর। এর দ্বারা যন্ত্র চালাবার ব্যবস্থা করা হয়।
বড়ো বড়ো শিল্পের জন্য দরকার হতো কয়লার। তাই খনি থেকে কয়লা শিল্পাঞ্চলে পৌঁছানোর জন্য জর্জ স্টিভেনশন ‘বাস্প চালিত রেলইঞ্জিন ‘ আবিষ্কার করলেন, যার নাম ছিল রকেট।
১৮১১ খ্রিস্টাব্দে জন ম্যাকাডাম নামে এক বিজ্ঞানী পাথর ও পিচ দিয়ে রাস্তা তৈরির কৌশল খুঁজে বার করেছিলেন।
সেইসময় ইংল্যান্ডে খনিতে কাজ করার সময় শ্রমিকরা প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়তেন। শ্রমিকদের এই অসুবিধা দূর করার জন্য বিজ্ঞানী হামফ্রে ডেভি আবিষ্কার করেছিলেন ‘সেফটি ল্যাম্প ‘ (Safety Lamp) বা নিরাপদ বাতির।
মূল্যায়ন
ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব নিঃসন্দেহে ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ড কৃষিপ্রধান দেশ থেকে শিল্পপ্রধান দেশে পরিণত হয়।
শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় সবকটি উপাদান ইংল্যান্ডে মজুত থাকায় ইংল্যান্ড ইউরোপে প্রথম শিল্পপ্রধান দেশ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিল।
পরবর্তীকালে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি ইংল্যান্ডকে অনুসরণ করেছিল। তাই শিল্প বিপ্লব ছাড়া হয়তো এটি সম্ভব ছিল না।
আরও পড়ুন : মৌর্য যুগের শিল্পকলা
আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তুমি অনেক কিছু জানতে পেরেছো। যদি এবিষয়ে তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি Share করে অন্যদেরকেও জানতে সাহায্য কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে। ভালো থেকো বন্ধু , আর ইতিহাস পড়তে থেকো।
Amar akta England silpo biplob boro lakha lajba school joma dabo porjactar jono 😍🙏🙁🙁🙏
দেওয়ার চেষ্টা করবো। আপনার mail id পাঠিয়ে দিতে পারেন অথবা আমার এই ওয়েবসাইটটি ফলো করুন। এখানে অন্য অনেক পোস্ট রয়েছে যা হয়তো আপনার কাজে আসতে পারে। ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।