নীলনদের তীরে গড়ে উঠেছিল মিশরীয় সভ্যতা, বা টাইগ্রীস নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল সুমেরীয় সভ্যতা। ঠিক তেমনি আমাদের ভারতবর্ষের সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল ভারতের প্রাচীনতম হরপ্পা সভ্যতা।
সিন্ধু নদীর তীরে গড়ে ওঠার কারণে এটি সিন্ধু সভ্যতা নামেও পরিচিত ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদ দয়ারাম সাহানী পাঞ্জাবের মন্টগোমারি অঞ্চলে খনন কার্য চালান।
স্যার জন মার্শালের নেতৃত্বে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে দয়ারাম সাহানী আবিষ্কার করেন হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসবশেষ। প্রমাণিত হয়েছে যে, ভারত ও পাকিস্তানের বিশাল এলাকা জুড়ে এই সংস্কৃতি প্রসারিত ছিল।
খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০০-১৫০০ অব্দের মধ্যের সময়কালেই এই সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল।
পশ্চিম দিকে ইরান ও পাকিস্তানের মাঝের অঞ্চলে, আবার অন্যদিকে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে ক্যাম্বে উপসাগর পর্যন্ত এই সভ্যতা প্রসারিত ছিল।
এছাড়াও গুজরাটের লোথাল, ঘর্ঘরা নদীর তীরে কালিবঙ্গান, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের আলমগীরপুর প্রভৃতি স্থান গুলোতে এই সভ্যতার বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে।
উপরে হরপ্পা সভ্যতার একটি ছোট্ট বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
আলোচনা করবো এর নগর পরিকল্পনা ( Harappa Town Planning ) নিয়ে। এই নগর পরিকল্পনা ছিল খুব উন্নতমানের।
ভাবতে অবাক লাগে হরপ্পার নগর পরিকল্পনা আজকের আধুনিক নগর পরিকল্পনাকে সত্যিই হার মানিয়ে দেবে। হরপ্পার প্রতিটি ইঁটের মধ্যে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। পরিকল্পনার মধ্যে ছিল একটি নির্দিষ্ট ছক।
হরপ্পার নাগরিক বৈশিষ্ট্য ও জীবন
প্রায় প্রতিটি নগরে উঁচু ও নীচু দুইধরনের এলাকা ছিল। এই উঁচু এলাকা গুলি সিটাডেল নামে পরিচিত ছিল। সিটাডেল গুলি খুব উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা থাকতো।
যারা একটু অভিজাত বা নগরের শাসক তারা এই সিটাডেল গুলিতে বাস করতেন। আর ওই নীচু এলাকা গুলিতে বাস করতেন নিম্নবিত্তের মানুষেরা।
তাদের জন্য থাকার জায়গা হিসাবে ছিল ছোট দুই কামরার কুঁড়েঘর। এই কুঁড়েঘর গুলির সাথে আজকের ভারতের চা শ্রমিকদের ঘরগুলির এক অদ্ভুত মিল রয়েছে।
দুই ধরণের এলাকাতেই বাড়িগুলির ক্ষেত্রে ইঁটের ব্যবহার দেখা যায়। পোড়া ইঁট এবং রোদে শুকনো করা ইঁট উভয়ই ব্যবহার হত।
যখন জলনিকাশের নালা বা ড্রেন তৈরি হত তখন পোড়া ইঁটকে কাজে লাগানো হত। ইঁট গুলির মাপ ছিল প্রায় ১১ ইঞ্চি লম্বা ৫ ১/২ চওড়া ও ২ ৩/৪ ইঞ্চি পুরু।
প্রত্যেক বাড়িতেই উঠোন সহ রান্নাঘর থাকতো। জানালার ব্যবহার ছিল না, তবে বাতাস চলাচলের জন্য পাথরের ঝাঝরি লাগানো থাকতো।
বিভিন্ন বাড়িতেই স্নানের নির্দিষ্ট জায়গা ছিল। সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য নগরের অনেক স্থানে কুয়ো থাকতো।
হরপ্পার জল নিকাশী ব্যবস্থা
হরপ্পা সভ্যতার প্রধান নগর গুলিতে জল নিকাশের ব্যবস্থা ( Harappa drainage system ) সম্পর্কে ভাবলে অবাক হতে হয়।
বাড়িগুলির থেকে আসা স্নানের জল ও বৃষ্টির জল বাড়ি ও রাস্তায় জমা হয়ে আবর্জনা তৈরি করতে পারতো না। কারণ এই দিক থেকে হরপ্পা বাসীরা খুবই সচেতন ছিলেন।
বাড়ির জল বাড়ির সাথে যুক্ত নালার মধ্যে দিয়ে বাইরে আসতো। পরে সেই জল গিয়ে জমা হত ঢাকনা দেওয়া বড়ো নালাতে। যা হল আজকের আধুনিক ম্যানহোল ব্যবস্থা।
হরপ্পার রাস্তাঘাট
লোকজন চলাচলের রাস্তাগুলি প্রায় ৩০ ফুট চওড়া ছিল। এই রাস্তাগুলি গোটা হরপ্পা শহরটিকে কয়েকটি এলাকায় ভাগ করে দিত।
যেমন আজকের আধুনিক দিনে বড়ো রাস্তা থেকে ছোটো ছোটো গলি তৈরি হয়। ঠিক সেইসময়ও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।
রাস্তা গুলি দিয়ে যানবাহন চলাচল করতো। বড়ো রাস্তাগুলির ধারে অনেক বসত বাড়িও ছিল।
হরপ্পা বাসীদের পরিকল্পনা যে সুচিন্তিত ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম নাগরিক বৈশিষ্ট ছিল এর বড় বড় ইমারত। এক্ষেত্রে বলে রাখি হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কারের ঠিক এক বছর পর (১৯২২) লারকানা অঞ্চলে মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাচীন একটি শহরের আবিষ্কার হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার করেছিলেন একজন বাঙালি, তার নাম রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়। এথেকে বোঝা যাচ্ছে যে, এইদুটি সভ্যতার শহর গুলি একইসাথে গড়ে উঠেছিল।
হরপ্পা সভ্যতার স্নানাগার
মহেঞ্জোদাড়োতে খননকার্যের সময় একটি বিশাল স্নানাগার আবিষ্কার হয়েছে। এই স্নানাগার টির আয়তন আমাদের কে অবাক করিয়ে দেয়।
স্নান করার স্থানটি লম্বা ও চওড়াতে ৩৯ এবং ২৩ ফুট। আর গভীরতায় ৮ ফুট।
এতে জল ঢোকাবার ও বের করার সুন্দর ব্যবস্থা ছিল। জলে ওঠানামার জন্য দুদিক থেকেই সিঁড়ি ছিল।
উন্নতমানের ইঁট দিয়ে সিঁড়ি গুলিকে করা হয়েছিল। স্নানাগারটিতে জল আসতো বাইরের কোনো কুয়ো থেকে।
জল বের হত নালা দিয়ে। এই জলাশয়টির পাশে ছোট ছোট ঘর ছিল।
মনে করা হয় ঘর গুলিতে থাকতেন পুরোহিত শ্রেণীর কোনো লোকজন। ঐতিহাসিক হুইলারের মতে, জলাশয়টি ব্যবহার হত ধর্মীয় কোনো কারণে।
এই জল শুধুমাত্র ব্যবহার করতেন অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা।
আমাদের ভারতবর্ষের মন্দির গুলির চারপাশে অনেক ঘর দেখতে পাওয়া যায়। এই ঘর গুলিও ছিল ঠিক সেইরকম।
হয়তো ধর্ম প্রেমী মানুষেরা এই জলাশয়টিতে স্নান করে তৃপ্তি পেতেন।
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে শহরের নিরাপত্তার জন্য বড় বড় কিছু দুর্গ গড়ে তোলা হয়েছিল। তার প্রমাণ খনন কার্যের সময় পাওয়া গেছে।
হরপ্পার দুর্গটির দেওয়াল ছিল ১৩ মিটার চওড়া। দেওয়ালের প্রতিটি কোণে ছিল গম্বুজ। এটিকে অনেকে পুরোহিত নাসক এর রাজপ্রাসাদ বলে ভাবেন।
দুর্গ গুলি থেকে বোঝা যায় হরপ্পার প্রশাসনের দায়দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি।
হরপ্পার শস্যাগার
হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োতে দুটি শস্য রাখার স্থান আবিষ্কার হয়েছিল। গ্রামে ফলানো শস্য যেমন আজকের দিনে শহরে পাঠানো হয়।
সেইসময়ও ঠিক তেমনটাই করা হত। বলা যায় যে গ্রামের অর্থনীতির ওপরই শহরের সুখ ও সম্মৃদ্ধি টিকে থাকে।
হরপ্পার পাশ দিয়ে বয়ে যেত ইরাবতী নদী। এই শস্য রাখার স্থানটি সেখানেই পাওয়া গেছে।
শস্য রাখার স্থানটির আয়তন ৯০০০ বর্গফুট। এটি দুটো সারিতে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক সারিতে ছয়টি করে শস্যগোলা র সন্ধান মিলেছে।
শস্যগারের পাশাপাশি একটি মঞ্চ দেখা গিয়েছে। মঞ্চের মেঝেতে পাওয়া গিয়েছে গম, যবের দানা, ধানের তুষ।
অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে এখানে শস্য ঝাড়াই মাড়াই এর কাজ করা হত। এর পাশাপাশি কিছু কুঠুরি ঘর দেখা গেছে।
মনে করা হয় শস্য মাড়াই এর কাজে নিযুক্ত শ্রমিকরা এই কুঠুরিগুলিতে বাস করত। মহেঞ্জোদাড়োতেও একটি বৃহৎ মাপের শস্য রাখার স্থান আবিষ্কার হয়েছিল।
যা ছিল গোটা হরপ্পার সমান আয়তনের। এই দুটি নগরের অর্থনীতি নির্ভর করত এই শস্যগার গুলির ওপর।
হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়োতে শাসকদের অস্তিত্ব ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিকরাও এবিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে এতকিছুর পরে বলা যায় যে, নিশ্চয় কারোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এই নগরগুলির পরিকল্পনার পিছনে ছিল।
নাহলে এত সুন্দর রাস্তা পরিকল্পনা, বিভিন্ন স্থানে পোড়া ইঁটের মানানসই ব্যবহার, নগরের সব জায়গায় একই মাপ ও ওজনের ইঁট ব্যবহার ইত্যাদির সমতা রক্ষা সম্ভব ছিল না।
It helped alot in my project
Thank you so much, thanks for the feedback ; stay well.