হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ (Cause of the decline of Harappan Civilization in bengali)
নমস্কার বন্ধু কেমন আছো, আশা করি নিশ্চয় ভালো আছো। হরপ্পা সভ্যতার নাম আশা করি তুমি শুনেছো। হরপ্পার নগর পরিকল্পনা নিয়ে আগে একটা পোস্ট করা হয়েছে। যদি না পড়ে থাকো তাহলে এই পোস্টটি অবশ্যই পড়ে নিও। আমার মনে হয় তুমি কিছুটা ধারণা পাবে।
এবারে আলোচনা করবো হরপ্পা সভ্যতার পতনের কারণ নিয়ে। ২০০০-১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এই সভ্যতা। এটি একটি উৎকৃষ্ট মানের সভ্যতা ছিল। সব থেকে যা আমাদের অবাক করে তা হল এর নগর পরিকল্পনা। নগর পরিকল্পনাতে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া।
কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও হরপ্পার মতো একটি বিশাল সভ্যতার ধ্বংস কিভাবে ঘটল তা সত্যি এক কঠিন প্রশ্ন।
হরপ্পা সংস্কৃতির ধ্বংসের নির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। তবে ধ্বংসাবশেষ থেকে আবিষ্কার হওয়া নিদর্শন গুলোকে ব্যাখ্যা করে ইতিহাসবিদরা অনেকগুলি কারণ খুঁজে বের করেছেন।
তবে একথা ঠিক যে , কোনো একটা কারণে এই সুন্দর সভ্যতার পতন ঘটেনি। এই পতন দীর্ঘদিন ধরে ঘটেছে। ঘটতে ঘটতে শেষে একদিন তা ভেঙ্গে পড়েছে। আজও এ বিষয় নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে গবেষণা চলছে।
কারণ গুলি কে পন্ডিতরা ২ টি ভাগে ভাগ করেছেন। আভ্যন্তরীন ও বহিরাগত।
তাহলে চলো দেখে নিই সেই কারণ গুলিকে।
আভ্যন্তরীন কারণ :
ভূ -প্রকৃতির পরিবর্তন – ভূ -প্রকৃতির পরিবর্তন হতে থাকলে যে কোনো কিছুরই অবক্ষয় নিশ্চিত হয়ে পড়ে। হরপ্পার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হয়েছে। এই প্রাচীন সভ্যতাটির পতনের জন্য ভূ -প্রকৃতির বদলে যাওয়াটা একটা কারণ।
একটা সময় সিন্ধু নদীর আশপাশের অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হত। কিন্তু হঠাৎ করে প্রকৃতির খামখেয়ালিতে বৃষ্টিপাত কমে যায়।
তার ফলে এই পুরো সিন্ধু অঞ্চলটিতে একটা মরুভূমি দেখা দেয়। মাটির নিচের স্তরের জল লোনা হতে শুরু করে।
লোনা জল চাষবাস এর ক্ষেত্রে উপযুক্ত নয়। তাই চাষবাস বন্ধ হয়ে যায়। খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিতে শুরু করে। ইতিহাসবিদদের মতে এই খাদ্যের অভাব খুবই তীব্র ছিল।
বিধ্বংসী বন্যা – বন্যা কিন্তু আমাদের সবার কাছে এক ভীষণবড় প্রাকৃতিক অভিশাপ। বন্যায় অতিরিক্ত জলের ফলে মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু ঘরবাড়ি , সম্পদ সবকিছু নষ্ট হয়।
তাই বেশ কিছু পণ্ডিত হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের পিছনে বন্যাকে একটা বড় কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন। এদের মধ্যে নামকরা পন্ডিতরা হলেন যেমন, এম. আর.সাহনি, আর্নেস্ট ম্যাকে, রাইক্স প্রমুখরা।
তুমি নিশ্চই জানো যে, সিন্ধু নদীর উপত্যকায় হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নামে দুটো নগরী গড়ে উঠেছিল। এই মহেঞ্জোদারোতে পরে যখন খনন কার্য করা হয়েছে তা দেখে অনুমান করা হয় যে এখানে তিনবার বন্যা দেখা দিয়েছিল।
এইবার তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে , বন্যায় এই সভ্যতার পতন হয়েছে তার কি প্রমাণ আছে ?
আরও পড়ো : সিন্ধু সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার সম্পর্ক
দেখা গেছে বন্যার হাত থেকে বাঁচবার জন্য বাড়িগুলি কাঁচা ইঁটের বদলে পাকা ইঁট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। বন্যার জল যাতে নগর দুর্গকে ভেঙে ফেলতে না পারে তার জন্য ৪৫ ফুট চওড়া একটি বাঁধও দেওয়া হয়েছিল।
গুজরাটের লোথালে কোলহ নামে একটি জায়গায় পলিমাটি পাওয়া গিয়েছিল। যা থেকে সহজেই অনুমান করা হয় যে , এখানে কোনোসময় বন্যা হয়েছিল।
লোথাল, দেশলপার, রংপুর বন্যার ফলেই ধ্বংস হয়েছিল এমনটাই অনুমান করেছেন ইতিহাসবিদ এস. আর. রাও।
ঐতিহাসিক রাইক্স এর মতে বন্যাই সিন্ধু সভ্যতার বিনাশ করেছে। সিন্ধুর অধিবাসীরা নদীতে বাঁধ দিয়ে চাষ করত। এর ফলে সিন্ধু নদীতে পলি জমে যায় এবং একটা সময় জলোচ্ছাস ঘটে।
কৃষির উন্নতি না ঘটা – অনেক প্রত্নতত্ত্ব বিদেরা এমনটা মনে করেন যে, প্রথম থেকেই কৃষি অর্থনীতি তেমন প্রসারিত হয়নি। তার ফলে অর্থনৈতিক জীবনে ভয়ঙ্কর রূপ দেখা দেয়।
এর প্রধান কারণ ছিল লোহার সাথে হরপ্পা বাসীদের পরিচয়ের অভাব। কৃষি কাজে লোহা এক গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লোহার তৈরি চাষের সরঞ্জাম চাষবাস কে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
কিন্তু লোহার তৈরি লাঙ্গল বা কুঠার এগুলির মাধ্যমে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি হরপ্পা বাসীরা।
হরপ্পা বাসীরা নদীর জলকে বেঁধে চাষের সময় কাজে লাগাতো। কিন্তু শেষের দিকে এই পদ্ধতিও ভেঙ্গে পড়ে।
কৃষি কাজ আটকে পড়ে। আর এর ফলে অর্থনীতির ক্ষতি হয়।
স্থবিরতা – হরপ্পা সভ্যতার আভ্যন্তরীণ অবক্ষয় এর পিছনে সবথেকে বড় কারণ ছিল হরপ্পা বাসীদের সেকেলে মানসিকতা। যাকে আর একটু ভাল ভাবে স্থবিরতা বলা যায়।
প্রতিদিনকার একই জীবনধারায় চলতে তারা অভ্যস্ত ছিল। সেকেলে প্রথা কে বিসর্জন দিয়ে নিজেদেরকে উন্নত করার ইচ্ছে তাদের ছিল না। কোন উন্নত শক্তির পরিচয় তারা দেয়নি।
এই সভ্যতার সমসাময়িক ছিল মিশরীয় ও মেসোপটেমিয় সভ্যতা। এই দুটি সভ্যতাই বেশ উন্নত ছিল। হরপ্পার সাথে এদের সম্পর্ক ভাল ছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কৃষিকাজ, বাণিজ্য, বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণ করা এইসব গুলি হরপ্পা বাসীরা এই সভ্যতা গুলি থেকে শিখতে পারেনি।
অর্থাৎ নতুন কিছু শেখার আগ্রহ তাদের মধ্যে ছিল না।
আধুনিক ভাবে চাষ আবাদের প্রতি অন্য সভ্যতা গুলির আগ্রহ ছিল। কিন্তু সিন্ধুর অধিবাসীরা সেই দিকে কোন খেয়ালই করেনি। যার ফল হিসাবে কৃষি ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।
অরণ্য ধ্বংস – প্রকৃতির বন জঙ্গল আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে। তাই আমাদের পৃথিবী জুড়ে আজ মানব সভ্যতাও ধীরে ধীরে বিপন্ন হচ্ছে। ঠিক একই ভাবে অরণ্য ধ্বংসকেও হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী করা হয়।
সিন্ধু, বেলুচিস্তান এইসব অঞ্চলগুলির আবহাওয়া সেইসময় রুক্ষ শুষ্ক হয়ে পড়ায় মানুষের থাকার জন্য সঠিক ছিল না। হরপ্পার নগর গুলিতে যে বড় বড় বাড়ি , দুর্গ ,স্নানাগার তৈরি করা হয়েছিল সেগুলি ছিল পোড়া ইঁটের।
বলা হয়ে থাকে যে , এই ইঁট গুলিকে পোড়ানোর জন্য জ্বালানী কাঠের প্রয়োজন হত। এই কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে হরপ্পা বাসীরা অরণ্যকে ধংস্ব করেছিল।
তুমি হয়তো জানো যে, বন জঙ্গলের পরিমাণ কমতে থাকলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও কম হতে থাকে। তাই হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো ধীরে ধীরে বৃষ্টির অভাবে মরু অঞ্চলে পরিণত হয়।
অরণ্য ধ্বংস হবার ফলে বন্য জন্তুদের সংখ্যাও কমতে থাকে। অথচ একটা সভ্যতা টিকে থাকার জন্য এটি ভীষণ ভাবে দরকার ছিল।
বহিরাগত কারণ :
গৃহযুদ্ধ বা বাইরের শত্রূর আক্রমণ – তুমি এতক্ষনে নিশ্চই আভ্যন্তরীণ কারণ গুলি সম্পর্কে বুঝে গেছ। এবার বহিরাগত কারণটিও তোমার জানা দরকার। তাহলে এবার সেটা জেনে নাও।
অনেক পন্ডিতেরাই বাইরের শত্রূর আক্রমণকেই এর পতনের কারণ হিসাবে মনে করেছেন।
এখানে বাইরের শত্রূ হিসাবে আর্য জাতির কথাই তাঁরা বলেছেন। গর্ডন চাইল্ড, মর্টিমার হুইলার প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ব বিদেরা আর্য জাতির আক্রমণকেই এই সভ্যতার পতনের কারণ হিসাবে দেখিয়েছেন।
তাদের কথা অনুযায়ী মহেঞ্জোদারোর রাস্তায় কবর না দেওয়া বহু কঙ্কাল স্তুপ অবস্থায় পাওয়া গেছে।
এমনকি একটি ঘরের ভিতর থেকে এক গুচ্ছ কঙ্কালও আবিষ্কৃত হয়েছে। একটি বড় কুয়োর পাশের সিঁড়িতে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো একজন মহিলার কঙ্কাল।
মানুষের মাথার কিছু খুলি আবিষ্কার হয়েছিল খনন কার্যের সময়। খুলি গুলোতে ভারি অস্ত্রের আঘাত ছিল। এই সবকটি নিদর্শন কোন হিংসার ঘটনাকেই ইঙ্গিত করে।
পন্ডিতরা তাই কোন বিদেশী জাতির আক্রমণকেই এই সভ্যতার পতনের কারণ বলেছেন।
হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের সময়কাল ও ঋগ্বেদ রচনার সময়কাল এই দুটোর মধ্যেই একটা সামঞ্জস্য আছে। তুমি কি জানো, ঋগ্বেদ সবথেকে প্রাচীন। এই ঋগ্বেদে ইন্দ্রকে পুরন্দর বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
এই পুরন্দর শব্দের অর্থ হল নগর ধ্বংসকারী। আবার সিন্ধু তথা হরপ্পার মানুষেরা নগরেই বাস করত। তাই আর্যদের কে এই সভ্যতার ধ্বংসকারী হিসাবে মনে হওয়াটা ভুল কিছু নয়।
মূল্যায়ন :
সবশেষে বলা যেতে পারে সিন্ধু তথা হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কোন সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করা খুব কঠিন। বিভিন্ন পন্ডিতরাও অনুমানের ওপর নির্ভর করেই এই কারণ গুলিকে সামনে এনেছেন।
তবে এই কারণ গুলি যে একেবারে ভুল, এটা বলা যাবে না। কারণ ধরে নেওয়া যেতে পারে উন্নতির একটা সময় পর এই সভ্যতার অবক্ষয় শুরু হয়েছিল।
নানা দিক থেকে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আর সেকারণেই ঘনিয়ে এসেছিল ধ্বংসের সময়।
আরও পড়ো : প্রস্তর যুগ
” লেখাটি পড়ে তোমার কেমন লাগলো তুমি কমেন্ট করে নিশ্চয়ই জানাবে। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার। ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো। “
Nice history harappa samraj 👍
Welcome…