আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা | Akbar’s Land Revenue System in bengali

আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা (Akbar’s Land Revenue System in bengali )

মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সম্রাট আকবর ইতিহাসে বেশ চর্চিত একটি নাম। তিনি তাঁর বিভিন্ন ভালো পদক্ষেপের জন্য ইতিহাসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

তাঁর ভালো পদক্ষেপগুলির মধ্যে মনসবদারি প্রথা, দীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন,  রাজপুতনীতি বেশ উল্লেখযোগ্য।

কিন্তু এগুলি ছাড়াও তাঁর আরো একটি সু-পদক্ষেপ হলো ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সুষ্ঠূ সংস্কার করা।

এই পোস্টে আলোচনা করবো আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা নিয়ে। জানবো আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকগুলি সম্পর্কে।

তাই পুরো পোস্টটি পড়বার জন্য তোমার কাছে অনুরোধ রইলো।

পটভূমি

আলাউদ্দিন খলজী প্রথম জমি জরিপ প্রথা চালু করেন। এর ফলে কৃষকদের সাথে শাসকের সরাসরি সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং একটি সঠিক রাজস্ব ব্যবস্থার সূচনা হয়।

এই রাজস্ব ব্যবস্থার সূচনা ঘটেছিল গ্রামেই। কারণ কৃষি জমির পরিমান গ্রামেই বেশি ছিল। আর সেইসূত্রে কৃষকরাও গ্রামেই বাস করতো। 

আলাউদ্দিনের পর যিনি ভূমি রাজস্বের প্ৰয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি হলেন শের শাহ। শের শাহ উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারত যেহেতু কৃষিপ্রধান দেশ তাই কৃষির থেকে আসা রাজস্বই অর্থনীতিকে ধরে রাখবে।

সেইমতো একটি দৃঢ় রাজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর রাজস্ব পদ্ধতি বাতিল বলে গণ্য হয়।

পরবর্তীকালে আকবর শের শাহের ভূমি রাজস্ব পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে এক আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত রূপ দান করেন। 

আকবর তাঁর রাজস্ব সংস্কারের কাজে অনেকের সাহায্য পেয়েছিলেন। এঁরা ছিলেন যেমন- খাজা আব্দুল মজিদ, মুজফ্ফর তুরাবতী, রাজা টোডরমল। এঁদের সহায়তায় আকবর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যান। 

কানুনগো  

মুজফ্ফর তুরাবতী-র সুপারিশে আকবর ‘কানুনগো’ নামে কর্মচারীদের নিয়োগ করেন। কানুনগো-রা রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারী হিসেবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করতো।

সেইসাথে জমিদারি ব্যবস্থাটাও তাঁদের দেখতে হতো। কানুনগো-রা রাজস্ব সংস্কারের বিষয়ে তাঁদের কিছু মতামত দিয়েছিল।

কিন্তু এইসময় হঠাৎ উজবেক বিদ্রোহ দেখা দেওয়ায় এই মতামত গুলিকে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। তার ওপর কানুনগো-দের কাজকর্মে সততার অভাব ছিল। তাই এই ব্যবস্থা সফল হয়নি। 

ক্রোরী ও দহশালা ব্যবস্থা 

১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে জায়গির জমিগুলির উচ্ছেদ করে সারা দেশের জমিকে খালিসা জমিতে পরিণত করেন সম্রাট আকবর। রাজস্ব আদায় করার জন্য তিনি নিয়োগ করলেন ‘ক্রোরী’ নামক এক কর্মচারীদের।

আকবর তাঁর সাম্রাজ্যকে ভাগ করলেন ১৮২ টি ভাগে। প্রতিটি ভাগে নিয়োগ করলেন এই ক্রোরীদের। ক্রোরী কথার অর্থ কোটি। যেহেতু ক্রোরীদের উপর ১ কোটি করে রাজস্ব আদায়ের ভার ছিল, তাই তাঁদের নাম হয়েছিল ক্রোরী।

কিন্তু এই ব্যবস্থাতেও আকবর ব্যর্থ হলেন। অগত্যা এই ব্যবস্থাকে বন্ধ করে আকবর চালু করলেন ‘দহশালা’ ব্যবস্থা।

এই ব্যবস্থায় জমির দশ বছরের উৎপাদিত ফসলের গড় নিরিখে রাজস্ব ধার্য করা হতো। যেহেতু তখন নগদে রাজস্ব প্রদান করা যেত, তাই দশ বছরের মূল্য হিসেবে যা হবে সেই রাজস্বই স্থির করা হতো।

এই ব্যবস্থার ফলে কৃষকের রাজস্ব দেওয়া ও সরকারের রাজস্ব আদায়ে কোনো গন্ডগোলের সৃষ্টি হতো না, কারণ দুপক্ষই রাজস্বের পরিমাণটা জানতেন। 

আরও পড়ুন : আকবরের রাজপুত নীতি

টোডরমলের সুপারিশ ও জাবতি প্রথা  

আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী ছিলেন টোডরমল। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর টোডরমলকে ‘দেওয়ান-ই-আসরাফ’ বা প্রধান রাজস্ব সচিবের মর্যাদা দিয়েছিলেন। ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দে আকবর গুজরাট জয় করেন।

গুজরাটের রাজস্ব ব্যবস্থা কেমন হবে তা ঠিক করার জন্য টোডরমলকে তিনি গুজরাটে পাঠিয়েছিলেন। টোডরমল গুজরাটে সফলতার সাথে জমিগুলির জরিপ ও রাজস্ব নির্ধারণের কাজ সম্পন্ন করেন।

এরপর রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ের ভার তাঁর ওপর দেওয়া হয়। টোডরমল জমি জরিপের সময় ‘গজ-ই-ইলাহি‘ নামক মাপের মাধ্যমে জরিপ ও রাজস্ব পরিমাণ ধার্য করেছিলেন।

যদিও একাজ করতে তাঁকে সত্যিই যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিল। ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে টোডরমল রাজস্ব পদ্ধতির সংস্কারের জন্য আকবরের কাছে তাঁর কিছু সুপারিশ রেখেছিলেন। যা টোডরমল সুপারিশ বা টোডরমল বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। সুপারিশ গুলি হলো – 

ক) আবাদি জমির সঠিক জরিপ করা। 

খ) প্রতিটি জমির উৎপাদিত শস্যের গড় নির্ণয় করা। 

গ) প্রতিটি জমির রাজস্বের পরিমাণ কতটা হবে তা ঠিক করা। 

জমির উর্বরতা অনুযায়ী জমিগুলিকে ৪ টি ভাগে ভাগ করার কথাও বলেন টোডরমল। সেই চারটি ভাগ হলো,

পৌলজ ; প্রতি বছর যে জমিতে চাষ করা যাবে। বা উৎকৃষ্ট প্রকৃতির জমি। 

পরৌতি ; যে জমিতে কয়েকবার চাষ করে আবার এক-দুই বছর ফেলে রাখা হয়। 

চাচর ; যে জমি তিন-চার বছর অন্তর চাষ করা যায়। 

ব্যঞ্জর ; যে জমি পাঁচ বছরের বেশি সময় ফেলে রাখার পর চাষ করা হয়। 

এই সমস্ত জমির গড় উৎপাদনের ১/৩ অংশ রাজস্ব হিসেবে ধার্য করা হয়।

এই রাজস্ব নগদের মাধ্যমে দেওয়া যেত। জমির উৎপাদনের হার বাড়লে রাজস্বও বাড়তো। টোডরমলের এইরূপ ব্যবস্থা ‘জাবতি প্রথা‘ নাম পরিচিত।

এই ব্যবস্থায় কৃষকের সুবিধাই হয়েছিল। কারণ সরকারের সাথে তাঁদের সরাসরি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যার ফলে রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীদের অত্যাচার সহ্য করতে হতো না। 

আবার কোনো কারণে চাষের ক্ষতি ঘটলে রাজস্ব মকুবেরও ব্যবস্থা ছিল। এই জাবতি প্রথা মুলতান, গুজরাট, মালব, আগ্রা, দিল্লী প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। 

রাজস্ব ধার্যের বিভিন্ন প্রথা 

আকবরের আমলে রাজস্ব ধার্যের কয়েকটি প্রথা প্রচলিত ছিল। এগুলি ছিল যেমন- নসক, কানকুট, গল্লাবক্স ইত্যাদি। এগুলি সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক। 

কানকুট  নামটি শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও রাজস্ব ধার্যের গুরুত্বপূর্ণ প্রথা ছিল এটি। এই প্রথায় ফসলি জমির মোট পরিমাণ নির্ধারণ করে তার ভিত্তিতে মোট উৎপাদনের হিসাব করা হতো।

ইরফান হাবিবের মতে, কানকুট ব্যবস্থা ভালো চাষেরই অনুরূপ এক ব্যবস্থা। পুর্বে প্রচলিত হস্ত-ও-বুদ্, লাঙল গুনতি এইসমস্ত রাজস্ব পদ্ধতির থেকে কানকুট পদ্ধতি ছিল অনেকটাই যথাযথ। 

গল্লাবক্স – রাজস্ব ধার্যের আরো একটি প্রথা হলো ‘গল্লাবক্স’ প্রথা। এর অন্য একটি নাম হলো ভাওয়ালি। গল্লাবক্স শব্দটি মূলত ফারসি শব্দ। গল্লাবক্স ছিল ভাগচাষ প্রথা।

এই প্রথা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট হারে শস্য ভাগ করা হতো। জমিতে যা শস্য উৎপন্ন হতো তা কৃষক ও সরকার উভয়ের মধ্যে ১/৩, ১/৪ বা ১/৫ ভাগে বন্টিত হতো।

এই ভাগাভাগি হতো খুসাবাতাই, খাল্লাবাতাই প্রভৃতি পদ্ধতির মাধ্যমে। কৃষক এই প্রথায় বেশ কিছুটা সুবিধা পেতো। সিন্ধুদেশ, কাশ্মীর, কাবুলে প্রচলিত ছিল গল্লাবক্স প্রথা। 

নসক – নসক অনেকটা জমিদারি ব্যবস্থার অনুরূপ। এই পদ্ধতিতে জমির উৎপাদনী ক্ষমতা দেখে রাজস্ব ধার্য না করে বরং আন্দাজের ভিত্তিতে রাজস্ব বিবেচনা করা হতো। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত থাকার কথা জানা যায়। 

রাজস্ব আদায়ের বিভিন্ন কর্মচারী 

রাজস্ব আদায় করবার জন্য বিভিন্ন কর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন। আলমগুজার ছিলেন রাজস্ব আদায়ের কর্মচারী। এছাড়াও ছিলেন আমিন, বিতিকচি, পোদ্দার, পাটোয়ারী, মুকাদ্দাম প্রভৃতি কর্মচারীগণ। 

আরও পড়ুন : মনসবদারি প্রথা কি

মূল্যায়ন 

আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থায় কৃষক স্বার্থের দিকটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছিল। কৃষকদের ওপর অতিরিক্ত রাজস্বের বোঝা যাতে রাজস্ব আদায়কারী কর্মচারীরা না চাপিয়ে দিতে পারে তাঁর জন্য আকবর সদাসতর্ক ছিলেন। এর ফলে জমিগুলির মান উন্নত হয় ও উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়। ড. শ্রীবাস্তবের মতে, ‘ব্রিটিশ শাসন সময়ের চাইতে আকবরের শাসনকালে ভারতীয় কৃষকদের অবস্থা অনেক ভালো ছিল। ‘ 

আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তোমার ভালো লেগেছে। যদি তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি  অন্যদের সাথে Share কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। ভালো থেকো বন্ধু, আর ইতিহাস পড়তে থেকো। 

2 thoughts on “আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা | Akbar’s Land Revenue System in bengali”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!