মনসবদারি প্রথা কি । What is Mansabdari System in bengali

মনসবদারি প্রথা কি (What is Mansabdari System)

নমস্কার বনধু  কেমন আছো, আশা করি নিশ্চই ভালো আছো। তুমি কি জানো মনসবদারি প্রথা কি ?

কে এই মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন ?

যদি না জেনে থাকো তাহলে এই পোস্টটি থেকে জেনে নাও। আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তুমি উপকৃত হবে।

আগের পোস্টটি আকবর প্রবর্তিত ধর্মমত দীন-ই-ইলাহী সম্পর্কে করেছি। চাইলে লিঙ্কটিতে ক্লিক করে তুমি পোস্টটি পড়তে পারো।

মনসব কথার অর্থ : 

মুঘল শাসনব্যবস্থায় সম্রাট আকবর এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা হিসেবে যুক্ত করেছিলেন ‘মনসবদারি‘ প্রথাকে। রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে অর্থাৎ ১৫৭৩-১৫৭৪ খ্রিস্টাব্দে আকবর মনসবদারি প্রথার প্রবর্তন করেন।

মনসব একটি আরবি শব্দ। মনসব কথার অর্থ হলো পদমর্যাদা বা Rank।

মনসবদারি প্রথার পশ্চাদপট : 

আকবরের পূর্বেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। কিন্তু সাংগঠনিক নিয়ম অনুসারে এই প্রথার প্রচলন করা হয়নি।

আগে সুলতানি আমলে রাজকর্মচারীগণ নগদ মাইনের পরিবর্তে জমি বন্দোবস্ত বা জায়গির পেতেন। সাম্রাজ্যের প্রয়োজনে জায়গিরদাররা সৈন্য দিয়ে সম্রাটকে সাহায্য করতো।

কিন্তু এই জায়গির ব্যবস্থায় কিছু ভুল ছিল। যেমন, জায়গিরদাররা নিম্নমানের সৈন্য দিতো, ধার করা সৈন্য দিতো ইত্যাদি।

এতে যেমন সামরিক দিকটি দুর্বল হতো ঠিক তেমনি রাজকোষে কম অর্থ জমা হওয়ায় সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক দিকটিরও ক্ষতি ঘটতো।

সম্রাট আকবর এই জায়গিরদারি প্রথা তুলে দিলেন। তার বদলে আকবর তাঁর রাজত্বের অষ্টাদশ বছরে নগদে বেতন দিয়ে মনসবদারি প্রথা চালু করলেন।

এর উদ্দেশ্য ছিল সামরিক বিভাগে বিশৃঙ্খলতা দূর করা।

নগদে বেতন পাওয়া মনসবদারদের বলা হতো ‘মনসবদার-ই-নগদি’

কিছু মনসবদার জায়গির পেতেন, এই জায়গির গুলিকে বলা হতো ‘তনখা জায়গির‘।

বস্তুত এই ছিল মনসবদারি প্রথার পটভূমি বা পশ্চাদপট।

মনসবদারি স্তর বিন্যাস : 

মনসবদারগণ ৩৩ টি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল।

পদমর্যাদা অনুযায়ী একজন মনসবদারের অধীনে দশ থেকে পাঁচ হাজার পর্যন্ত সৈন্য থাকতো।

এছাড়াও এর ওপরে সাত হাজারি, দশ হাজারি মনসবদারি পদও ছিল।

রাজা মানসিংহ, রাজা টোডরমল, সেনাপতি কুলিচ খান প্রমুখের অধীনে সাত হাজারি মনসব থাকার কথা জানা যায়।

তবে দশ হাজারি মনসবদার পদের অধিকারী হতে পারতেন শাহজাদাগণরা। 

মনসবদারি প্রথায় জাট ও সওয়ার :

মনসবদারি প্রথায় ‘জাট‘ ও ‘সওয়ার‘ নামে দুটি পদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সম্রাট আকবর তাঁর শাসনকালের ৪০তম বছরে জাট ও সওয়ার নামক দুটি পদ প্রবর্তন করেছিলেন।

বিভিন্ন ঐতিহাসিকরা নিজ নিজ ভাবে জাট ও সওয়ার এর অর্থ ব্যাখ্যা করেছেন।

আরও পড়ো : ইতিহাসে আবুল ফজল

আরভিন ও আবদুল আজিজের মতে, ‘জাট’-এর অর্থ মনসবদারের অধীনে থাকা পদমর্যাদাযুক্ত অশ্বারোহী সেনা। আর ‘সওয়ার’ হলো পদমর্যাদার বাইরেও অতিরিক্ত অশ্বারোহী সেনা।

ড. ত্রিপাঠীর মতে, ‘সওয়ার’ ছিল অতিরিক্ত সেনা।

জাট ও সওয়ার-এর ব্যাখ্যা সম্পর্কে মতভেদ থাকলেও সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, ‘জাট‘ হলো মনসবদারের ব্যক্তিগত পদমর্যাদা এবং ‘সওয়ার‘ হলো তার অধীনে অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যা। 

মনসবদারের অধীনে থাকা সৈন্যদের ঘোড়ার সংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করা হতো। যদি কারোর একটি ঘোড়া থাকতো, তাহলে তাকে বলা হতো ‘এক-আসপা ‘। 

যাঁর দুটি ঘোড়া থাকতো তাকে বলা হতো ‘দু-আসপা‘। আর যাঁর তিনটি ঘোড়া, সে পরিচিত ছিল ‘শি-আসপা‘ নামে।

দাগ ব্যবস্থা :  

মনসবদারদের সৈন্য সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পরও কিছু ত্রুটি রয়ে গিয়েছিল।

সম্রাটের সৈন্য পরিদর্শনের সময় মনসবদারগণ অনিপুণ, অশিক্ষিত ভাড়াটে  সৈন্যদের ও ভাড়াটে ঘোড়াদের সম্রাটের সামনে উপস্থিত করতো।

এই অনিপুণ সৈন্যদের জন্য মনসবদারগণ রাজকোষ থেকে নিয়মিত অর্থ আদায় করতো।    

এই দুর্নীতি বা ত্রুটি সম্রাটের নজরে আসায় তিনি ‘দাগ‘ ব্যবস্থা চালু করেন।

দাগ ব্যবস্থা অনুযায়ী ঘোড়াগুলিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়। সেইসাথে সৈন্যদের বিশদ বিবরণ ও পিতৃপরিচয় সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হয়। 

এর উদ্দেশ্য ছিল প্রয়োজনে সৈন্য ও ঘোড়া প্রদর্শনের সময় মনসবদারগণ যাতে কারচুপি না ঘটাতে পারে। 

মনসবদারি প্রথার গুণাবলী :

মনসবদারি প্রথার কিছু গুণ ছিল। যেমন –

১) যোগ্যতার ভিত্তিতে মনসবদারদের নিয়োগ ও পদোন্নতি ঘটতো। এর ফলে একজন দক্ষ মনসবদার ভবিষ্যৎে দায়িত্ব সহকারে রাজকার্য পরিচালনা করার চেষ্টা করতেন। 

২) ব্যক্তিগত ক্ষমতার ওপর মনসবদারদের উন্নতি ও অবনতি নির্ভর করায় মুঘল যুগে সুবিধাভোগী ও বংশানুক্ৰমিক প্রথা ভারতে গড়ে উঠতে পারেনি। 

৩) মনসব প্রথা প্রবর্তনের ফলে সম্রাটের ক্ষমতা বহুগুন বেড়েছিল। একজন মনসবদারের উন্নতি সম্রাটের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করতো। 

মনসবদারি প্রথা – র ত্রুটি : 

এই প্রথার গুণের পাশাপাশি কিছু ত্রুটিও বিদ্যমান। সেগুলি ছিল –

ক) মনসবদারদের অধীনে নির্দিষ্ট সংখ্যক দক্ষ সৈন্য রাখার যে প্রথা ছিল, দেখা যেতো মনসবদারগণ সেই সেনা রাখতেন না। এর ফলে সামরিক দিকটি দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। 

খ) মনসব পদ লোভনীয় হওয়ায় মনসবদারদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও হিংসা জন্ম নেয়। ফলে সেনা বাহিনীর সঠিক পরিচালন সম্ভব হয়নি। 

গ) এই গোটা প্রথাটি টিকে ছিল সম্রাটের নিজস্ব দক্ষতার ওপর। কিন্তু আকবর পরবর্তীকালে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু ও তাঁর দক্ষতার অভাবে মনসবদারি প্রথায় ভাঙ্গন ধরে।

আরও পড়ো : আকবরের রাজপুত নীতি

মূল্যায়ন 

মনসবদারি প্রথা ছিল আকবরের এক অভিনব পদক্ষেপ। সুকৌশলে অভিজাতদের বেতন প্রথা প্রবর্তনের মাধ্যমে  বেতনভুক কর্মচারীতে পরিণত করে এক আধুনিক আমলাতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। এই প্রথার মাধ্যমে রাজকোষে আয়ের পাশাপাশি সামরিক দিকটিও উন্নত হয়েছিল।  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!