সমাজসংস্কারক রামমোহন রায় | Social Reformer Ram Mohan Roy in bengali

সমাজসংস্কারক রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) (Social Reformer Ram Mohan Roy)

কেমন আছো বন্ধু , আশা করি নিশ্চই ভালো আছো। রাজা রামমোহন রায়ের নাম নিশ্চয় শুনেছ ? হ্যাঁ এবারের  পোস্টে রামমোহন রায়কে নিয়েই আলোচনা করব।  

জানাবো তাঁর অবদান সম্পর্কে। তাহলে আলোচনায় যাওয়া যাক। 

বন্ধু প্রথমেই রামমোহন রায়ের জন্ম , শিক্ষা সম্পর্কে কিছু জেনে নিই। তারপর তাঁর কার্যকলাপ সম্পর্কে জানবো।

জন্ম ও শিক্ষা (Birth and Education) :

রামমোহন রায় ছিলেন ভারতের ধর্মীয় ও সামাজিক জাগরণের প্রধান বার্তাবাহক। 

এই মানুষটি বর্তমান হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে ১৭৭২ সালে জন্মেছিলেন। পরিবারটি ছিল রাঢ়ী কুলিন ব্রাহ্মণ পরিবার। মুঘল শাসক দ্বিতীয় শাহ আলমের পুত্র দ্বিতীয় আকবর শাহ রামমোহন রায়কে ‘রাজা ’ উপাধি দিয়েছিলেন।

তাই ইতিহাসে তাঁকে রাজা রামমোহন রায় নামেই সম্বোধন করা হয়।  

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রামমোহন রায়কে ‘ভারত পথিক ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। 

বাল্যবয়সে তিনি পাটনায় আরবি, ফার্সী ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। কাশীতে তিনি সংস্কৃত শিক্ষা লাভ করেছিলেন।

জন ডিগবি নামে এক ইংরেজ কর্মচারীর কাছে রামমোহন রায় ইংরেজী শিক্ষা নিয়েছিলেন।

ব্যক্তিত্ব :

তাঁর ব্যক্তিত্বে দেশ ও দেশবাসীর প্রতি গভীর মমতা ছিল। সমাজের গোঁড়ামি রামমোহন রায়কে ব্যথিত করেছিল। 

তাঁর চরিত্রে স্বচ্ছতা ও উদারতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। ধর্মের মূল কথা জানার জন্য বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ তিনি পাঠ করেছেন। 

রামমোহন রায় ছিলেন একজন নির্ভীক ও যুক্তিবাদী মানুষ। 

১৮০৩-০৪ খ্রিস্টাব্দে ফার্সী ভাষায় তিনি রচনা করেছিলেন ‘তুহুফাৎ-ই -মুয়াহিদ্দিন ’।

এই গ্রন্থে তিনি ধর্মের কুসংস্কার-র বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরেছেন। এবারে সংস্কারক রূপে তাঁর অবদান আলোচনা করা হল।

ধর্মসংস্কার :

রাজা রামমোহন রায় উপলব্ধি করেছিলেন ধর্মীয় কুসংস্কার প্রথমে দূর করতে হবে। তা নাহলে জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। 

ধর্ম সেইসময় কুসংস্কার, পৌত্তলিকতা, বহু ঈশ্বরবাদ প্রভৃতিতে আচ্ছন্ন। 

এই পরিস্থিতিতে তিনি প্রচার করলেন ‘ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়’ তত্ত্বকে। এজন্য তাঁকে বাইবেল, বেদ-বেদান্ত, কোরান পাঠ করতে হয়েছে।

রামমোহন রায়ের রচিত গ্রন্থ তুহুফাৎ-ই-মুয়াহিদ্দিনে তিনি ধর্মীয় দালালদের সমালোচনা করেছেন। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে একজন সর্বশক্তিমানের দ্বারাই গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে। এবং তা পরিচালিতও হচ্ছে। 

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘আত্মীয় সভা ’। এখানে মূলত সমাজের ধর্মীয় সমস্যা নিয়েই আলোচনা হত।

আরও পড়ুন : চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

রামমোহন রায় ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ‘ব্রাহ্মসভা ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে এটি ‘ব্রাহ্ম সমাজ ’ নামে পরিচিতি পায়। এখানে একেশ্বরবাদ সম্পর্কে প্রচার করা হত। এর সদস্য ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ প্রমুখরা। 

বেদান্ত দর্শনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল। ফলস্বরূপ ৫ টি প্রধান উপনিষদ যেমন- কেন, ঈশ, কঠ, মুণ্ডক, মান্ডক্যর বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। 

সমাজসংস্কার :

তৎকালীন সমাজ ছিল মধ্যযুগীও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। আর সমাজে ছিল ‘সতীদাহ ’ প্রথার মত অমানবিক প্রথা। 

এই প্রথা অনুযায়ী স্বামীর মৃত্যু হলে জ্বলন্ত চিতায় তাঁর স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হত। এর ফলে বহু অসহায় রমণীরা আগুনে পুড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এর আগে এই প্রথা বন্ধের জন্য সম্রাট আকবর, অহল্যাবাঈ ব্যর্থ হয়েছিলেন।শেষে রাজা রামমোহন রায় এগিয়ে এলেন। 

তুলে ধরলেন এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে মনুসংহিতা ও অন্যান্য শাস্ত্রের যুক্তি। বোঝালেন সমগ্র দেশবাসীকে। 

রামমোহনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। শেষপর্যন্ত ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭ নং রেগুলেশন পাশ করে তিনি সতীদাহ প্রথা বে-আইনী ঘোষণা করেন।  

সমাজে পুরুষদের বহুবিবাহ বন্ধের বিরুদ্ধেও রামমোহন আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

নারীসংস্কার :

নারীসংস্কারেও রামমোহন রায়ের অগ্রণী ভূমিকা ছিল। 

নারীদের স্বার্থে তিনি বিধবা বিবাহ, পণপ্রথা, বহুবিবাহ ইত্যাদির সমালোচনা করেছেন। সতীদাহের মত কুপ্রথার অবসান ঘটিয়েছেন। 

সম্পত্তির ওপর নারীর অধিকার সমর্থন করে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে একটি বই তিনি প্রকাশ করেছিলেন। 

পুত্রের ন্যায় কন্যারও পিতৃ সম্পত্তিতে অধিকারের কথা তিনি প্রচার করেন। 

শিক্ষাসংস্কার :

শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রেও রাজা রামমোহন রায় ছিলেন পথিকৃৎ। তিনি ইংরেজী শিক্ষার প্রচলন চেয়েছিলেন। 

তাঁর মতে সমাজের কুসংস্কার, গোঁড়ামি দূর করার জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রচলন হওয়া উচিত। 

সেই কারণে লর্ড আমহার্স্টকে তিনি একটি চিঠি লেখেন।  

সেই চিঠিতে বিজ্ঞান, গণিত, পাশ্চাত্যদর্শন প্রভৃতি শিক্ষার দাবী জানান। উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের ইংরেজী শিক্ষা শুরু করার প্রচেষ্টাকে রামমোহন রায় সমর্থন জানিয়েছিলেন। 

General Assemblies Institute (স্কটিশ চার্চ কলেজ) সেইসময় গড়ে তুলেছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ। একাজে রামমোহন রায় সাহায্য করেন। তিনি নিজে ১৮২৬ সালে একটি বেদান্ত কলেজ তৈরি করেন। 

উদ্দেশ্য ছিল, মানুষকে কুসংস্কার -এর অন্ধকার থেকে ঐশ্বরিক চিন্তার আলোয় নিয়ে আসা। 

সাহিত্য-সাংবাদিকতায় সংস্কার :

তিনি সাহিত্যিক ছিলেন না। কিন্তু সমাজ সংস্কার মূলক বই রচনার মাধ্যমে সাহিত্যকে বিশেষ রূপ দিয়েছেন। 

বেদান্তের বাংলা অনুবাদ করেছেন। জাতিভেদ বিরোধী গ্রন্থ বজ্রসূচী বাংলায় অনুবাদ করে সাড়া ফেলেছিলেন। 

সংবাদ কৌমুদী  প্রকাশের মাধ্যমে রামমোহন রায় ভারতীয়দের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করেছিলেন। এছাড়াও তিনি একটি উর্দু পত্রিকাও পরিচালনা করতেন। তার নাম ‘মিরাত-উল-আকবর ’। 

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে :

১) তিনি ভারতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবর্তন করেন। 

২) জুরী আইনেরও তিনি প্রতিবাদ করেন। 

৩) কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যের সমালোচনা করেছিলেন রামমোহন রায়। 

৪) জমিদারী প্রথা ও সম্পদ নিকাশির তিনি নিন্দা করেন। 

এইভাবে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষের পথ তৈরী করেন। 

পরিশেষে : 

তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের রূপকার। একজন প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী মানুষ। সমাজের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁকে লড়াই করতে হয়েছিল। দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল কুসংস্কারগ্রস্ত। এই পরিস্থিতিতে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ডাক তিনি দিয়েছিলেন। সেকারণেই ইতিহাসে তিনি আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। 

আরও পড়ুন : রেগুলেটিং অ্যাক্ট ও পিটের ভারত আইন

পোস্টটি পড়ে যদি তোমার ভালো লেগে থাকে তাহলে তুমি কমেন্টে তোমার মতামত জানিও। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার। ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!