শের শাহের শাসনব্যবস্থা | Sher Shah’s Administration in bengali

শের শাহের শাসনব্যবস্থা (Sher Shah’s Administration)

নমস্কার বন্ধু কেমন আছো, আশা করি নিশ্চই ভালো আছো। এবারে যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করব তাহল ‘শের শাহের শাসন ব্যবস্থা’

আগের পোস্টে প্রাচীন ভারতের ষোড়শ মহাজনপদ নিয়ে আলোচনা করেছি।

পোস্টটি পড়ে অবশ্যই তোমার মতামত আমায় জানিও।

শের শাহের নাম নিশ্চয় তুমি শুনেছ। এবারে তাঁর শাসন ব্যবস্থা কিরকম ছিল এই পোস্টটি থেকে জেনে নাও। 

শের শাহ (Sher Shah) :

শের শাহের প্রকৃত নাম ফরিদ খান শের শাহের পিতার নাম ছিল হাসান।

তিনি ছিলেন বিহারের সাসারামের একজন জায়গিরদার।

শের শাহ তাঁর সৎমায়ের ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে খুব অল্প বয়সে সাসারাম ছেড়ে জৌনপুরে এসে শিক্ষালাভ করতে থেকেন।

তিনি এখানে আরবি, ফার্সি, গণিত, হিন্দি শিখেছিলেন। একবার বাহার খাঁ নামে একজন শাসকের কাছে কাজ করার সময় ফরিদ নিজের হাতে একটি বাঘ শিকার করেছিলেন।

এই সাহসিক কাজের জন্য বাহার খাঁ তাকে ‘শের খাঁ ‘ উপাধি দিয়েছিলেন।

ধীরে ধীরে এই শের খাঁ একসময় শের শাহ সুরি  নাম নিয়ে  দিল্লীর সিংহাসন দখল করে শুরু করেছিলেন আফগানি শাসন।

শের শাহ হয়ে উঠলেন অসাধারণ এক কুশলী যোদ্ধা ও সেই সাথে সুদক্ষ শাসক। গড়ে তুলেছিলেন এক সুদক্ষ শাসন ব্যবস্থা। 

বন্ধু শের শাহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তোমাকে জানালাম। এবারে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক। 

শের শাহের শাসনব্যবস্থা – 

শাসনব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য : 

শের শাহের শাসনব্যবস্থায় কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় তা হল,

১) শের শাহ স্বৈরাচারী হলেও তাঁর শাসনব্যবস্থার আদর্শ ছিল প্রজাদের কল্যাণ করা।

২) তাঁর শাসনব্যবস্থায় ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান ছিল। 

৩) শের শাহের শাসনব্যবস্থায় নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটে এবং পুরোনো পদ্ধতির সংস্কার হয়। 

৪) তাঁর স্বৈরতন্ত্র ছিল উদারনৈতিক। 

কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা :

বিহার ও বাংলাতে শের শাহ প্রথম তাঁর শাসনব্যবস্থার প্রয়োগ করেন।

দিল্লীতে সিংহাসনে বসে তিনি এই শাসনব্যবস্থার কেন্দ্রীয় রূপ দেন।

এই কেন্দ্রীয় শাসনের সর্বেসর্বা ছিলেন শের শাহ স্বয়ং নিজেই। শের শাহ কঠোর পরিশ্রমী হওয়ায় নিজের হাতেই শাসন কার্য পরিচালনা করতেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি চারজন মন্ত্রী নিয়োগ করেছিলেন। এঁরা হলেন –

১) দিওয়ান-ই-উজিরাত বা রাজস্ব ও অর্থমন্ত্রী। 

২) দিওয়ান-ই-আরিজ বা সামরিক মন্ত্রী। 

৩) দিওয়ান-ই-রিসালাত বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী। 

৪) দিওয়ান-ই-ইনসা বা যোগাযোগ ও ইস্তেহার প্রেরণ মন্ত্রী।  

এছাড়াও দিওয়ান-ই কাজাদিওয়ান-ই-বারীদ নামে আরও দুধরণের মন্ত্রী ছিলেন।

যাঁদের কাজ ছিল সুবিচার করা ও গুপ্তচর বিভাগ পরিচালনা করা।

এই সমস্ত মন্ত্রীদের কোনো নীতির নির্ধারণ বা পরিবর্তনের ক্ষমতা ছিল না। একমাত্র এই ক্ষমতা ন্যাস্ত ছিল শের শাহের হাতেই। 

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা :

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে শের শাহ পরিবর্তন করেছিলেন। শাসনের সুবিধার জন্য শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭ টি শিক বা সরকারে ভাগ করেন।

এই সরকার বা শিক গুলি দেখাশোনা করতেন শিকদার-ই-শিকদারানমুনসিফ-ই-মুনসিফান নামক কর্মচারীরা।

গ্রামের শাসন দেখাশোনা করতেন মুকাদ্দাম, খুৎ, মুখিয়া প্রমুখরা।

গ্রাম গুলিকে নিয়ে তৈরি হত পরগনা।

পরগনা গুলি শাসন করতেন আমিল, কানুনগো, কারকুন কর্মচারীরা।

এছাড়াও ছিল আমিন, ফোতদার নামক কর্মচারীরা। আমিনের কাজ ছিল জমি জরিপ করা।

আর ফোতদাররা ছিলেন কোষাধ্যক্ষ। কারকুনরা করতেন কেরানির কাজ। 

আরও পড়ো : ষোড়শ মহাজনপদ

 শের শাহের ভূমি রাজস্ব নীতি : 

শের শাহ নিজে একজন জায়গিরদার ছিলেন। তাই তিনি কৃষকদের অসুবিধাগুলি বুঝেছিলেন।

তাই তিনি জমি জরিপ ব্যবস্থা চালু করেন।

জমির উৎপাদন ক্ষমতা অনুযায়ী জমিকে উৎকৃষ্ট, মাঝারি ও নিকৃষ্ট তিন ভাগে ভাগ করেন। রাজস্ব সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে আদায় করা হত।

অজন্মা বা দুর্ভিক্ষের সময়ে রাজস্ব মকুবও করা হত।

শের শাহের উল্লেখযোগ্য সংস্কার ‘পাট্টা ‘ ও ‘ কবুলিয়ৎ’ প্রথার প্রচলন।

জমিতে কৃষকের অধিকার স্বীকার করে কৃষককে সম্রাট যা দিতেন তাকে বলা হত পাট্টা।

আর সম্রাটের কি প্রাপ্য তা স্বীকার  করে কৃষক যে লিখিত দিত তাকে বলা হত কবুলিয়ৎ। 

শের শাহের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারগুলিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। জেনে নাও তাঁর সংস্কারগুলি সম্পর্কে। 

শের শাহের সংস্কার –

শের শাহের মুদ্রা ব্যবস্থার সংস্কার : 

তখন ভারতে নানা ধরণের মুদ্রা চালু ছিল। শের শাহ মুদ্রা ব্যবস্থার মধ্যে সমতা আনেন।

তিনি সোনা, রূপা, তামার মুদ্রা চালু করেন।

বিভিন্ন মুদ্রায় কোন ধাতু কতটা পরিমানে ব্যবহার হবে তা শের শাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন।

তামার মুদ্রাগুলি ‘ দাম ‘ নামে পরিচিত ছিল। আর রূপার মুদ্রাগুলি পরিচিত ছিল ‘ রূপয়া ‘ নামে।  

শের শাহের বিচার ব্যবস্থার সংস্কার :

তাঁর বিচারব্যবস্থা ছিল নিরপেক্ষ ও উন্নত। বিচার ব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন শের শাহ নিজেই।

ফৌজদারী মামলাগুলি দেখভাল করতেন কাজী, মীর আদল ও শিকদার। শাস্তি ছিল কঠোর।

কেউ কোন অপরাধ করলে শাস্তি হিসেবে ছিল জেল, জরিমানা, অঙ্গচ্ছেদ, প্রাণদণ্ড।

লোকে যাতে নির্বিঘ্নে যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে তার জন্য শের শাহ উপযুক্ত শান্তি শৃঙ্খলার ব্যবস্থা করেছিলেন।

তাই সেইসময়কার ঐতিহাসিক নিজামউদ্দিন বলেছেন, “রাস্তাঘাটে যদি কেউ সোনার থলি নিয়েও রাত্রে ঘুমিয়ে পড়ত, তাহলেও তা চুরি যাওয়ার কোনো ভয় ছিল না  “। 

শের শাহের যোগাযোগ ব্যবস্থার সংস্কার : 

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য সমগ্র দেশে তিনি দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বাংলা থেকে আগ্রা হয়ে দিল্লী এবং পাঞ্জাব থেকে সিন্ধু পর্যন্ত এই দীর্ঘ সড়কপথ।

এই সড়কপথই ‘ গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড ‘ (Grand Trunk Road) বা সড়ক-ই-আজম  নামে পরিচিত। সংক্ষেপে যাকে বর্তমানে ব্যস্ততম জি.টি.রোড বলা হয়।

এছাড়াও আগ্রা থেকে যোধপুর, আগ্রা থেকে বুরহানপুর, লাহোর থেকে মুলতান ইত্যাদি রাস্তাও শের শাহের অমর কীর্তি।

পথচারীদের বিশ্রামের জন্য তিনি বেশ কিছু সরাইখানাও নির্মাণ করেন।

যেখানে হিন্দু-মুসলিম উভয়ই আশ্রয় নিতে পারত। শের শাহ ঘোড়ার পিঠে চড়া ডাক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। এর ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত রূপ পায়। 

উপসংহার :

এইভাবে শের শাহ যে শাসন ব্যবস্থা চালু করেন তা অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হয়।

ঐতিহাসিক কিনি (Keene) মনে করেন যে, ব্রিটিশদের থেকেও শের শাহের শাসন প্রতিভা উজ্জ্বল ছিল।

আকবরের পূর্বে শের শাহ ছাড়া কেউই এইরকম দৃঢ় প্রশাসনিক মনোভাবের পরিচয় দিতে পারেনি। তাই শের শাহের মাত্র পাঁচ বছরের রাজত্বকাল (১৫৪০-১৫৪৫) ভারত ইতিহাসে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। 

আরও পড়ো : ঐতিহাসিক আব্দুল হামিদ লাহোরি

আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তোমার ভালো লেগেছে। যদি তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি কমেন্ট করে আমাকে জানাতে পারো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে লিখতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। ভালো থেকো বন্ধু , আর ইতিহাস পড়তে থেকো  “।   

2 thoughts on “শের শাহের শাসনব্যবস্থা | Sher Shah’s Administration in bengali”

  1. Atanu kr Das

    History sudhu copy pest korlei ki hoi ektu vabte hobe, apni j road construction er Katha bole6en sob gulo dhorle approx. 10,000 hobe. Vebe dekhun to 5years time perioder modhe ki kore sambhab?
    Takhon charun akhon ki sambhab?? Golper goru gache hoi to ut te pare tabole akase ure jabe

    1. এই তথ্যগুলি কোনো কাল্পনিক নয়। ভালো মানের বইতেই এই তথ্য দেওয়া আছে। পনেরো বছর দিল্লীর সিংহাসন পাওয়ার লড়াই করে শাসন কার্য পরিচালনা করেছেন মাত্র পাঁচ বছর একথা সত্য। কিন্তু জি.টি. রোডের মতো সড়ক ব্যবস্থা তারই সৃষ্টি। হয়তো পরবর্তীকালে দিল্লীর সিংহাসনের অন্য শাসকরা শের শাহের সেই কাজ চালিয়ে গিয়ে সম্পূর্ণ করেছেন। আর এখানে গল্পের গরু গাছে তোলার চেষ্টা করিনি, যেটুকু তথ্য সত্য সেটুকুই দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভালো থাকবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!