কেমন আছো বন্ধু ? আশা করি নিশ্চয় ভালো আছো। আজ আলোচনা করবো মুঘল সম্রাট হুমায়ুন কে নিয়ে। হুমায়ুনের পুরো নাম নাসিরুদ্দিন মহম্মদ হুমায়ুন। হুমায়ুন ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দের ৬ই মার্চ কাবুলে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন মুঘল সম্রাট বাবর, আর মা মহিম বেগম। মা মহিম বেগম শিয়া সম্প্রদায়ের ছিলেন।
হুমায়ুন কাবুলে থাকার সময়ই তুর্কি, আরবি , ফারসি ভাষাগুলি শেখেন। কিন্তু তার বাবার মতো ভাষায় ততটা দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি।
বাবর যখন উত্তর ভারত জয় করেছিলেন তখন হুমায়ুন হিন্দিও কিছুটা শিখেছিলেন। ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি গণিত , জ্যোতির্বিদ্যা , দর্শন এই বিষয়গুলোতেও তার অনেকটাই জ্ঞান ছিল।
সামরিক শিক্ষাও তিনি লাভ করেছিলেন।
বাবরের পানিপথ ও খানুয়ার যুদ্ধের কথা আগের লেখাতেই বলা আছে। যদি তুমি জানতে চাও তাহলে আগের ব্লগটা এই সাইটে পড়ে নিতে পারো। এই যুদ্ধে হুমায়ুন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর ছিল। আর ২০ বছর বয়সে হুমায়ুন বাদাকশানের শাসনকর্তা হয়েছিলেন। বাদাকশান আফগানিস্তানে অবস্থিত ছিল।
১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে ২৩ বছর বয়সে হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। কিন্তু সিংহাসনে বসা তার কাছে কাঁটার সমান ছিল।
বাবরের সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়া এবং পাঞ্জাব, মুলতান, উত্তরপ্রদেশ, গোয়ালিয়র, বেয়ানা, চান্দেরি পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। এই জায়গাগুলির আফগান শাসকদের বাবর কিছুদিনের জন্য দমন করেছিলেন। কিন্তু তাদের ক্ষমতা পুরোপুরি নষ্ট করতে পারেননি। এই আফগানরাই হুমায়ূনের মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়ায়।
ইব্রাহিম লোদির ভাই মাহমুদ লোদি দিল্লির সিংহাসন ছিনিয়ে নিতে চাইছিলেন। আফগানরাও মাহমুদ লোদিকে ঘিরে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। অন্যদিকে শের শাহই হুমায়ুনের জন্য সবচেয়ে বিপদজনক ছিলেন। বাংলা ও বিহারেও আফগানদের ঘাঁটি ছিল।
বাংলার সুলতান নুসরৎ শাহ এই আফগানদের সাহায্য করেছিলেন দিল্লির বিরুদ্ধে লড়বার জন্য।
এই পরিস্থিতিতে হুমায়ুনের পক্ষে সিংহাসন বাঁচানো খুবই কঠিন ছিল।
রাজপরিবারের কারোর মধ্যে কোনো মিল ছিল না।
রাজপরিবারে এইসময় মির্জাগোষ্ঠীর প্রভাব ছিল মারাত্মক। মির্জাদের মধ্যে দুই ভাই মহম্মদ জামাল ও মহম্মদ সুলতান দিল্লির সিংহাসন পেতে মরিয়া ছিলেন।
বাবর তুর্কি , উজবেক , আফগানদের নিয়ে যে সেনাদল গঠন করেছিলেন, হুমায়ুনের সময় সেই সেনাদল ভেঙ্গে যায়।
হুমায়ুনের ভাইদের মধ্যেও সিংহাসন নিয়ে প্রচন্ড বিবাদ ছিল। কামরান , আসকরী , হিন্দাল এরা ছিল সম্রাট হুমায়ুনের ভাই। এদের প্রত্যেকের দিল্লির সিংহাসনের প্রতি প্রচন্ড লোভ ছিল। কিন্তু সিংহাসনে বসার ব্যক্তিত্ব ও ক্ষমতা এদের কারোর ছিল না।
সম্রাট বাবর ভারতে মাত্র চারবছর ছিলেন। কিন্তু কোনো স্থায়ী শাসনব্যবস্থা স্থাপন করে রেখে যেতে পারেননি। তার উপর আগ্রা ও দিল্লির কোষাগার থেকে যে সম্পদ পেয়েছিলেন তা তিনি তার প্রজাদের ও সঙ্গী সাথীদের মধ্যে অকাতরে দান করে দিয়েছিলেন।
তাই হুমায়ুন যখন সিংহাসনে বসেন তখন এর দরুন এক ভীষণ অর্থ সংকট নেমে আসে। হুমায়ুন নিজেও একজন দুর্বল ও খামখেয়ালী মনের মানুষ ছিলেন। একনাগাড়ে কোনো কঠিন কাজ তিনি করতে পারতেন না। কিন্তু তিনি নিজে কারোর ভালো বন্ধু বা সঙ্গী হতে পারতেন।
ঐতিহাসিক লেনপুল বলেছেন, বাবর হুমায়ুনকে একটি কম্পমান সাম্রাজ্য দিয়ে গেছেন।
ভুল সিদ্ধান্তে হুমায়ুনের ভাগ্যবিপর্যয় :-
তুমি কি জানো , হুমায়ুনের জীবনটা একটি নাটকের মতো। একটি নাটকে যেমন অনেক গুলি পর্যায় থাকে হুমায়ুনের জীবনেও ঠিক এইরকমই পর্যায় ছিল।
১৫৩০-১৫৪০খ্রিস্টাব্দ এই দশটা বছর সাম্রাজ্য রক্ষার লড়াইয়ে কেটেছে।
১৫৪০-১৫৪৫খ্রিস্টাব্দ এই পাঁচ বছর তার কষ্টের ও নির্বাসিত জীবন। এই পাঁচ বছর বিভিন্ন রাজ্যের দরজায় দরজায় সাহায্যের জন্য ঘুরেছেন।
১৫৪৫-১৫৫৪খ্রিস্টাব্দ এই সময়ে কাবুল ও কান্দাহারকে ভিত্তি করে তার সাম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা।
১৫৫৫-১৫৫৬খ্রিস্টাব্দ এই সময়কালেই তার দিল্লির সিংহাসন ফিরে পাওয়া।
যদি আমরা নিজেরা জীবনে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিই তাহলে তা আমাদের ভাগ্যের জন্য ভালো হয় না। ঠিক তেমনি হুমায়ুনও কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর সেকারণেই তাকে জীবনে এতো সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়।
হুমায়ুন তার ভাইদের হাতে কাবুল , কান্দাহার , পশ্চিম পাঞ্জাব , আলোয়ারের শাসনভার তুলে দিয়েছিলেন। তার ভাইরা তার প্রতি কখনোই ভালো ব্যবহার দেখাতো না। তাই হুমায়ুনের পক্ষে আগামীদিনে এই জায়গাগুলি থেকে সৈন্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সিংহাসনে বসার পর তিনি কালিঞ্জর দুর্গ অবরোধ করেছিলেন। এইসময় আফগানরাও নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছিল। হঠাৎ করে হুমায়ুন কালিঞ্জর দুর্গের অবরোধ তুলে আফগানদের বিরুদ্ধে এগিয়ে যান। এখানেই হুমায়ুন ভুলটি করে ফেলেন। কালিঞ্জরের রাজার আফগানদের প্রতি সহানুভূতি ছিল।
হুমায়ুন যদি কালিঞ্জরের রাজাকে বশ্যতা স্বীকার করিয়ে বন্ধু করতে পারতেন তাহলে আফগানদের বিরুদ্ধে লড়াইটা কষ্টকর হত না।
এরপর আফগান আক্রমণের সামনে পড়েন হুমায়ুন। কিন্তু হুমায়ুনের বাহিনী আফগানদের দদরাহর যুদ্ধে হারিয়ে দেয়।
এইসময় আফগান নেতা ছিলেন শের খান। শের খান চুনার দুর্গে আশ্রয় নেন। হুমায়ুন এই দুর্গটি অবরোধ করেছিলেন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে শের খানের সাথে সন্ধি করে হুমায়ুন আগ্রা ফিরে যান। শের খানের ক্ষমতাকে নষ্ট না করেই হুমায়ুন আগ্রায় চলে এসেছিলেন। এটাও হুমায়ুনের একটি বিরাট ভুল ছিল।
আগ্রায় এসে হুমায়ুন আনন্দ ফুর্তি করে সময় কাটাচ্ছিলেন। এদিকে গুজরাটের শাসক বাহাদুর শাহ হয়ে উঠেছিলেন খুবই শক্তিশালী।
বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করেন। চিতোরের রানী দুর্গাবতী এইসময় হুমায়ুনের সাহায্য চান। কিন্তু হুমায়ুন তাকে সাহায্য করেননি।
হুমায়ুন রানী দুর্গাবতী কে সাহায্য করলে মুঘল সাম্রাজ্য রক্ষায় রাজপুতদের সাহায্য পেতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। এটাও ছিল হুমায়ুনের আরও একটি ভুল।
এদিকে শের খান বাংলা ও বিহারকে কেন্দ্র করে তার শক্তি বাড়িয়ে তোলেন। কিছু বয়স্ক ব্যক্তিরা হুমায়ুনকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে , বাহাদুর শাহের সাথে মিত্রতা করে নিতে। যাতে বাহাদুর শাহের সাহায্যে তিনি শের খানকে আটকাতে পারেন।
কিন্তু হুমায়ুন তাদের কথাও শুনলেন না। আরেকটি ভুল করে বসলেন।
শের খান তার বাহিনী নিয়ে আগ্রায় হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে যান। চৌসা নামের একটি জায়গায় শের খানের সাথে হুমায়ুনের মুখোমুখি হয়। খাদ্য , রসদ এইসবের কিছুই হুমায়ুনের কাছে ছিল না। তার উপর ছিল তার ভাইদের সাহায্যের অভাব।
এই সুযোগ কেই কাজে লাগান শের খান। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসা তে শের খান যুদ্ধে হুমায়ুনকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধই চৌসার যুদ্ধ নামে পরিচিত।
তুমি কি জানো যে , শের খান এই যুদ্ধের পরই শের শাহ উপাধি নেন। নিজের নামে তিনি মুদ্রাও চালু করেন।
জানা যায় যে , চৌসাতে প্রচন্ড বৃষ্টির জন্য হুমায়ুনের সেনাবাহিনীর পক্ষে কামান থেকে গোলা ছোঁড়া সম্ভব হয়নি।
তার গোলন্দাজ বাহিনীর এই ব্যর্থতাই তার খারাপ সময় ডেকে এনেছিল।
তুমি কি জানো যে , হুমায়ুন নামের অর্থ কি ? হুমায়ুন নামের অর্থ হল ভাগ্যবান। কিন্তু ভাগ্যের বদলে দুর্ভাগ্যই হুমায়ুনের জীবনের সঙ্গী ছিল।
১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে তার ভাই হিন্দালের শিক্ষক মীর আলি আকবরের মেয়ে হামিদাবানুর সাথে হুমায়ুনের পরিচয় হয়। হামিদবানুর বয়স তখন পনেরো বছর। এই বছরেই হুমায়ুনের সাথে হামিদাবানুর বিবাহ হয়।
হুমায়ুনের এই খারাপ সময়ে পাশে ছিলেন তার বন্ধু বৈরাম বেগ। এই বৈরাম বেগই পরে বৈরাম খান নামে পরিচিত হন।
হুমায়ুনের সিংহাসন লাভ :-
বন্ধু বৈরাম খানকে কান্দাহারের শাসনকর্তার ভার দিয়ে হুমায়ুন কাবুলের দিকে যান।
বৈরাম খান তার চালাকির দ্বারা কাবুলের অভিজাত ও শাসকদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরিয়ে দেন। হুমায়ুনও বিনা বাধায় কাবুলে ঢোকেন। সেখানে তার ছেলে আকবরের সাথে তার দেখা হয়।
কান্দাহার ও কাবুলর পর আফগানিস্তানের কিছুটা অংশ হুমায়ুনের দখলে আসে।
হুমায়ুন যখন আফগানিস্তানে ছিলেন তখন মুঘল শক্তিকে শক্তিশালী করেছিলেন বন্ধু বৈরাম খান। বৈরাম খান সেইসময় হুমায়ুনের কাছে ভগবানের মতো ছিলেন।
হুমায়ুন কাবুল থেকেই ভারত দখলের পরিকল্পনা করেছিলেন।
এইসময় একদিকে যেমন কান্দাহার , কাবুল , গজনির ওপর তার দখল মজবুত হয়েছিল। আবার অন্যদিকে তার ভাইরাও ক্ষমতার লড়াই থেকে দূরে চলে যায়।
তাই দিল্লির সিংহাসন পাওয়া তার পক্ষে আরো সহজ হয়ে গেল।
হুমায়ুনের প্রধান শত্রূ ছিলেন শের শাহ। এই শের শাহ হুমায়ুনকে ভারত থেকে তাড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু ১৫৪৫ খ্রিস্টাব্দে শের শাহের মৃত্যু হয়। তার আফগান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পরে।
কিছুদিন পর শের শাহের ছেলে ইসলাম শাহেরও মৃত্যু হয়। আর হুমায়ুনও ভারত দখলের এই সুযোগকে কাজে লাগান।
কিছু দিন পর মাছিয়ারাতে মুঘল ও আফগান দের মধ্যে বিরাট যুদ্ধ হয়। মাছিয়ারা পাঞ্জাবের লুধিয়ানাতে অবস্থিত। এই যুদ্ধে মুঘলরা আফগান সেনাদের কামানের গোলা ছুঁড়ে দুমড়ে মুষড়ে দেয়।
এই যুদ্ধে জিতে হুমায়ুনের দখলে পুরো পাঞ্জাব চলে আসে।
১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে হুমায়ুন দিল্লিতে আসেন। প্রায় পনেরো বছর পর হুমায়ুন দিল্লির সিংহাসন ফিরে পান। এইভাবে হুমায়ুন মুঘল সাম্রাজ্যকে আবার প্রতিষ্ঠা করেন।
নতুন করে গড়ে তোলেন সবকিছু। ছেলে আকবরকে বন্ধু বৈরাম খানের কাছে পাঠিয়ে দেন। আকবর বৈরাম খানের কাছে মানুষ হতে থাকেন।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দের আনুমানিক ২৪শে জানুয়ারি এক সন্ধ্যাবেলা হুমায়ুন তার লাইব্রেরি তে বসে বই পড়ছিলেন। কাছের একটি মসজিদ থেকে আজানের ডাক ভেসে আসছিলো।
এই ডাক শুনে লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে তাড়াতাড়ি করে নামতে গিয়ে তার পা পিছলে যায়। পড়ে গিয়ে মাথায় ভীষণ আঘাত পান এবং জ্ঞান হারান।
ঠিক এর দুদিন বাদে ২৬শে জানুয়ারি মুঘল সম্রাট হুমায়ুন মারা যান।
লেখাটি পড়ে তোমার কেমন লাগলো তুমি কমেন্ট করে নিশ্চয়ই জানাবে। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার। ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো।