ভারতীয় রাজ নর্তকীদের ইতিহাস (History of Indian Royal Dancers)
তুমি কি ভারতীয় রাজ নর্তকীদের সম্পর্কে জানতে চাও ? তাহলে তুমি সঠিক পোস্টে এসেছো। বন্ধু ভারতবর্ষ এক বৈচিত্র্যে ভরা দেশ।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে নর্তকীরা তাঁদের নৃত্য প্রদর্শন করে চলেছে। বলা যেতে পারে নাচ ভারতের এক চিরকালীন কলা। নর্তকীরা তাঁদের নাচের মাধ্যমে সবার মন জয় করে থাকেন।
নর্তকীদের পায়ের নূপুরের আওয়াজকে মানুষ বহুকাল আগে থেকেই উপভোগ করেছেন। তাই নাচগান ছাড়া সত্যিই আমাদের জীবন যেন অচল।
এই পোস্টে জানবো ভারতের প্রাচীনকাল, মুঘল ভারত এবং পরবর্তী কালের ব্রিটিশ ভারতের নর্তকীদের সম্পর্কে। তাই এর জন্য পুরো পোস্টটি তোমায় পড়তে হবে।
প্রাচীন কালের নর্তকীরা
পৌরাণিক, বৈদিক এমনকি হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়ো সভ্যতাতেও নৃত্যপটু নর্তকীদের উপস্থিতি রয়েছে। মানুষ সেইসময় থেকেই নাচ,গান উপভোগ করতে ভালোবাসতো। যদি পৌরাণিক যুগের দিকে তাকাই তাহলে সেখানেও বহু নৃত্য পারদর্শী নর্তকীদের দেখতে পাবো।
যেমন- উর্বশী, মেনকা, রম্ভা এবং আরো অনেক। হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। কথিত আছে এঁরা নাকি দেবরাজ ইন্দ্রের সভায় রাজনর্তকী ছিলেন। ঋগ্বেদেও কিন্তু পুংশ্চলী, মহানাগনি প্রভৃতি নর্তকীদের উল্লেখ রয়েছে।
মহেঞ্জোদাড়োতে মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার হয়েছিল নৃত্যরত এক নারীর ব্রোঞ্জের মূর্তি। ইতিহাস বইয়ের পাতায় নাচের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মূর্তিটির ছবি তুমি হয়তো দেখে থাকবে।
সুতরাং এই সভ্যতাতেও নর্তকীদের উপস্থিতির টের পাওয়া যায়। দণ্ডির লেখা ‘দশকুমার চরিত‘, ভানুদত্তের ‘রসমঞ্জরী‘, ভরতের ‘নাট্যশাস্ত্র‘ ইত্যাদি প্রাচীন গ্রন্থগুলিতেও নর্তকীদের কথা বলা হয়েছে।
আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রাচীন মন্দির যদি তুমি কখনো দেখতে যাও, তাহলে সেই মন্দির গুলির গায়ে নর্তকীদের খোদাই করা মূর্তি দেখতে পাবে।
এর থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে সেইসময়কার রাজসভাগুলিতে তাঁরা নৃত্য প্রদর্শন করতো। তবে হ্যাঁ তাঁদের এই নৃত্য অবশ্যই ছিল ধ্রপদী নৃত্য।
মুঘল ভারতের নর্তকীরা
মুঘল যুগে নৃত্যের ধরণ বদলে যায়। তার কারণ মুসলিমদের অধিকাংশই এসেছিল পারস্য থেকে। তাই পারস্যের সংস্কৃতি, আদব -কায়দা এখানে চালু হয়। পারস্য, খোরাসান থেকে নর্তকীদের দল মুঘলদের দরবারে বিনোদনের জন্য চলে এসেছিল।
জানা যায় সুলতান বলবনের পুত্র কুরা খান, বাহমনি রাজ্যের শাসক মহম্মদ শাহ প্রমুখের দরবার সেজে উঠেছিল নর্তকী ও গায়কদেরকে নিয়ে। মুঘল বাদশারা তাঁদের দরবারে আসরকে জমজমাট করে রাখতেন নাচের মাধ্যমে।
এই নর্তকীদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল। যেমন- সেজদ, ভুগলিয়ে, কানজিরি, লোলনি, হরাকেনি এছাড়াও আরো অনেক। এই গোষ্ঠীদের নামগুলি আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে লিখেছেন। নর্তকীরা তাঁদের নাচ দেখিয়ে বাদশাকে খুশি করতেন।
তার বদলে উপরি পাওনা হিসেবে পেতেন কাঞ্চনী নামক খেতাব। সম্রাট আকবরও কোনো এক নর্তকীর নাচ দেখে খুশি হয়ে তাঁকে দিলরুবা নামে ভূষিত করেছিলেন। আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরও নর্তকীদের নাচে মজেছিলেন।
এমনটা শোনা যায় যে জাহাঙ্গীর নাকি এক ফরাসি অতিথির অনুরোধে এক নর্তকীকে বিবাহের জন্য তাঁকে সমর্পণও করেছিলেন। আবার সম্রাট শাহজাহানও যথেষ্ট খাতির করতেন তাঁর দরবারের নর্তকীদের।
ইটালীয় পর্যটক মানুচ্চির বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, শাহজাহান তাঁর হারেমেও স্থান দিয়েছিলেন বেশ কিছু নর্তকীদের। তুমি কি জানো যে, সম্রাট শাহজাহান-র পুত্র দারাও সুন্দরী এক নর্তকীর প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁর নাম ছিল রানাদিল। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই নর্তকীর সাথেই কাটিয়েছেন।
এমনকি মারাঠারাও এই নর্তকীদের থেকে দূরে সরে থাকেননি। ছত্রপতি শাহু থেকে, পেশোয়া বাজিরাও পর্যন্ত এই নর্তকীদের যথেষ্ট খাতির করতেন।
মাস্তানি নামে এক নর্তকীর সাথে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল পেশোয়া বাজিরাওয়ের। সেই প্রেমকাহিনী এখনও জীবিত ইতিহাসের পাতায়। এই প্রেমকাহিনী নিয়ে বলিউডে কয়েক বছর আগে মুক্তিও পেয়েছিল ‘বাজিরাও মাস্তানি‘ (Baji Rao Mastani) নামক সিনেমাটি।
ব্রিটিশ ভারতের নর্তকীরা
মুঘলরা প্রধানত দিল্লিকে কেন্দ্র করেই তাঁদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। কিন্তু এই সাম্রাজ্য একদিন ভেঙ্গে পড়ে। ততদিনে ইংরেজরা এদেশে তাঁদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে শুরু করেছিল।
ধীরে ধীরে এই নর্তকীরাও দিল্লির জলসাঘর ছেড়ে পাড়ি জমাতে থাকে লক্ষ্নৌ, কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে। বদলে যেতে শুরু করলো নাচের ভঙ্গিমা। নাচের সাথে সাথে তাঁরা গান গাইতেও শুরু করলেন। গান বলতে ছিল ঠুমরি, গজল।
অষ্টাদশ শতকে ইউরোপ থেকে ভারতে আসা সাহেবদের কাছে নাচ হয়ে উঠেছিল এক বিশেষ আনন্দদায়ক। সেই সময় নর্তকীরা নাচের পোশাক হিসেবে ব্যবহার করতেন সাদা মসলিন এবং রঙ বেরঙের ফিতেয় পরিপাটি করে সাজানো ঘাগড়া জাতীয় পোশাক।
গয়না হিসেবে আঙ্গুলে পড়তেন আংটি ও নাকে পড়তেন নথ। খোঁপায় থাকতো সুগন্ধি ফুল। আর পায়ে থাকতো ঘুঙুর। ঘুঙুরের তালে তাল মিলিয়ে তাঁরা নাচতেন। সাথে বাজতো বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র। একবার ভেবে দেখো কি অসাধারণ পরিবেশটাই না তৈরী হতো সেইসময়।
বহু ইংরেজ পর্যটক ভারতে এসে নর্তকীদের নাচের প্রশংসা করে গেছেন। ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো-র আমলে কলকাতায় নিকি নামে এক নর্তকীর নাচ বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। তাঁকে ডাকা হতো ‘কলকাতার ক্যাটালোনি ‘ নামে।
আর এক গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ডের বোন এমিলি ইডেনও ভারতীয় নর্তকীদের নাচের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। নর্তকীদের নাচে মত্ত হয়ে ইংরেজ সাহেব ও দেশীয় ধনী ব্যক্তিদের গলা থেকে বেরিয়ে আসতো ‘ওয়াহ’ ‘ওয়াহ’ ধ্বনি।
অবশ্য নর্তকীদের নাচের বিরুদ্ধে আন্দোলনও গড়ে উঠেছিল। কেশবচন্দ্র সেনের মতো ব্যক্তিত্ব এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন শিক্ষিত ভারতীয় ও খ্রিস্টান মিশনারিরা।
তাঁরা নর্তকীদের এই নাচকে ভারতীয় সংস্কৃতি তথা শাস্ত্রবিরোধী বলে মনে করতেন। তাঁরা সরকারের কাছে নাচ বন্ধ করার জন্য আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। বরং ইংরেজ সরকার মান্যতা দিয়েছিল ভারতের এই চিরকালীন কলাকে।
আধুনিক কালের নর্তকীরা
কলকাতা সহ গোটা ভারতবর্ষে সেইসময় বহু নর্তকীর উপস্থিতি ছিল। যেমন- মালকাজান, গহরজান, আখতারি বাঈ, অদ্দা বেগম এবং এছাড়াও আরোও অনেকে। এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন খ্যাতনামা নর্তকী।
কিন্তু একটা সময় তাঁদের দিনও ফুরিয়ে আসে। তাঁরা আর আগের মতো ঝাড়বাতির তলায় নাচে না। বরং খুলে দিয়ে যায় এক নতুন দিগন্তের দরজা। যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করে আরও একদল নতুন আধুনিক নর্তকীরা।
এই আধুনিক নর্তকীরা ফিরিয়ে আনেন ভারতের প্রাচীন ধ্রপদী নাচকে (Classical Dance) । অন্ধ্রপ্রদেশে কুচিপুড়ি নৃত্যের চালু হলো। তুমি হয়তো গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের নাম শুনে থাকবে। তিনি ওড়িশায় চালু করলেন ওড়িশি নৃত্যের।
একে একে কথাকলি, মোহিনী আট্টম সহ বিভিন্ন নাচ ফিরে এলো ইন্দ্রানী রহমান, যামিনী কৃষ্ণমূর্তির মতো বিভিন্ন নর্তকী শিল্পীর হাত ধরে। আর একজন শিল্পীর নাম না বললে তাঁর প্রতি হয়তো অসম্মান করা হবে।
তিনি হলেন বিরজু মহারাজ ( Birju Maharaj )। যিনি কিনা কত্থক নৃত্যের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। কত্থক উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের নৃত্য। সম্প্রতি ১৬ ই জানুয়ারি ২০২২ তারিখে উনি পরলোক গমন করেছেন। বিরজু মহারাজের কাকা শম্ভূ মহারাজ, লাচু মহারাজ তাঁরাও ছিলেন বিখ্যাত কত্থক নৃত্য শিল্পী।
এছাড়াও আরেক বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের ( Uday Shankar ) অবদানও কিন্তু ভুলবার নয়।
মূল্যায়ন
ভারতে প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে মুঘল যুগ ও পরে ইংরেজ আমল হয়ে আধুনিক ভারতে নর্তকীরা তাঁদের নৃত্য প্রদর্শন করে গেছেন এবং এখনো করছেন।
কিন্তু শুভসূচনা হয়েছিল সেই প্রাচীনকাল থেকেই। মুঘল আমলে তা আরও পূর্ণতা পায়। সেইসমস্ত খ্যাতনামা নর্তকীদের সুবাদেই ভারতে বহু ঘরানার সৃষ্টি হয়।
নর্তকীরা তাঁদের নাচের মাধ্যমে অনেক মানুষের মন জয় করেছেন। অনেক আনন্দ দিয়েছেন। আজও কান পাতলে কোনো ঝাড়বাতির তলায় কোনো নর্তকীর ঘুঙুরের আওয়াজ শোনা যাবে।
আশা করি এই পোস্টটি পড়ে তুমি অনেক কিছু জানতে পারলে। যদি এবিষয়ে তোমার কোনো মতামত থাকে তাহলে তুমি Comment করে আমাকে জানাতে পারো। আর অবশ্যই পোস্টটি Share করে অন্যদেরকেও জানতে সাহায্য কোরো। তোমার মূল্যবান মতামত আমাকে অনুপ্রেরণা জোগাতে ভীষণভাবে সাহায্য করে ।
তথ্য সূত্র : ঐতিহাসিক অনৈতিহাসিক ; শ্রীপান্থ