বাবর ও মুঘল রাজবংশ । Babur and Mughal Dynasty in bengali

কেমন আছো বন্ধু ?…. আশা করি নিশ্চই খুব ভালো আছো। মুঘল রাজবংশ ও তার প্রতিষ্ঠাতা বাবরের নাম নিশ্চয় শুনেছ। যদি তার ইতিহাস না জেনে থাকো , তাহলে এই আলোচনা থেকে জেনে নাও। 

তুমি কি জানো, প্রতিটি বংশের একটি পরিচয় থাকে। অর্থাৎ বংশটি কোথা থেকে এসেছে, বা তার প্রতিষ্ঠাতা কে। তুমি যে বংশে জন্মেছ তারও কিন্তু একটা নিজস্ব পরিচয় আছে। যদি তুমি তা জানতে চাও তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারো। 

ইতিহাসে মোঙ্গল নাম একটি জাতি ছিল। এরা ছিল ভীষণ দুর্ধর্ষ ও নির্ভীক। এই মোঙ্গল কথাটি থেকেই মুঘল বা মোগল কথাটি এসেছে। তাহলে এরা থাকতো কোথায় ? এদের আদি ঘরবাড়ি ছিল মঙ্গোলিয়া।

তুমি আমির খসরুর নাম শুনেছ ? আমির খসরু কে ভারতের তোতাপাখি বলে ডাকা হত। ইনি মোঙ্গলদের ভয়ঙ্কর আকৃতি ও ভীষণ সাহসী প্রকৃতির বিবরণ দিয়েছেন। এই জাতিটি অনেকগুলি ছোটো দলে বিভক্ত ছিল। পশুপালন ও হরিণ শিকার করা ছিল তাদের একমাত্র কাজ। 

তেমুচিন নামে মোঙ্গলদের একজন নেতা ছিলেন। তিনি মোঙ্গলদের একত্রিত করে তাতার নামে একটি দুর্ধর্ষ জাতিকে হারিয়ে দিলেন। তুমি কি জানো এই তেমুচিন কে ছিলেন ? তেমুচিন ছিলেন চেঙ্গিস খান। চেঙ্গিস খান নামটি ছিল উপাধি।

এই চেঙ্গিস খান সমস্ত মোঙ্গলদের কে এশিয়ার প্রধান শক্তিতে পরিণত করেন। তিনি চীনদেশ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়াকে তার সাম্রাজ্যের মধ্যে নিয়ে নিয়েছিলেন। একবার চেঙ্গিস খান ভারত আক্রমণ করতে এলে ইলতুৎমিস তার বুদ্ধির দ্বারা দিল্লিকে রক্ষা করেছিলেন। 

কিন্তু চেঙ্গিস খানকে সেইসময় আটকে দেওয়া গেলেও, পরে মোঙ্গলরা অনেকবার ভারতকে আক্রমণ করেছে। চেঙ্গিস খান মারা যাওয়ার পর তার পুত্র চাঘটাই খান রাজত্ব শুরু করেন। এইসময় তৈমুরলংএর আবির্ভাব হয়। তৈমুরলং কে খোঁড়া তৈমুর নামে ডাকা হত। কারণ তার একটি পা খোঁড়া ছিল। 

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর :- 

তোমাকে প্রথমেই বলি বাবর কথাটির অর্থ হল বাঘ। বাবরের পুরো নাম জহিরুদ্দিন মহম্মদ বাবর। তৈমুরলং এর ছেলে আবু সৈয়দ মির্জা ছিলেন বাবরের দাদু। এই আবু সৈয়দ মির্জা যখন মারা যান তখন তার চতুর্থ ছেলে ওমর শেখ মির্জা ছোট্ট ফারগানা রাজ্যের সম্রাট হন। এই ওমর শেখ মির্জাই ছিলেন বাবরের বাবা। বাবর জন্মগ্রহণ কর্রেছিলেন এই ফারগানা তে। 

বাবরের বাবা এই ছোট্ট রাজ্যের সম্রাট হয়ে কিন্তু খুশি ছিলেন না। কারণ তার বড়ভাই আহম্মদ মির্জা তৈমুরের রাজধানী সমরখন্দ ও বুখারা সহ জায়গাগুলি নিয়ে নিয়েছিলেন। 

একদিন বাবরের বাবা ওমর শেখ মির্জা তার বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁক ঝাঁক পায়রা দের সৌন্দর্য দেখছিলেন। কিন্তু হঠাৎই তিনি ছাদ থেকে পড়ে যান এবং তার মৃত্যু হয়। এইসময় বাবরের বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। এই বয়সেই বাবর ফরগানা রাজ্যের সম্রাট হন। 

অল্প সময়ের মধ্যেই তুর্কি ও পারস্য ভাষা তিনি শিখে ফেলেন। 

বাবরের মায়ের নাম ছিল কুতলুকনিগম খানুম। তিনি ছিলেন মোঙ্গল বা মুঘল নেতা ইউনুস খানের মেয়ে। 

বাবরও তার বাবার মতো নির্ভীক ও দৃঢ় মানুষ ছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই বাবর সমরখন্দ জয় করার স্বপ্ন দেখতেন। কারণ সমরখন্দ ছিল মধ্য এশিয়ার মধ্যে খুব সুন্দর নগর। বিশেষ করে এখানে লেখাপড়ার মান ছিল খুব ভালো। 

কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর বাবর সমরখন্দ অধিকার করেন। নিজের রাজ্য ফারগানা তে ষড়যন্ত্র র খবর পেয়ে তিনি সমরখন্দ ছেড়ে চলে আসেন। ঠিক তখনই উজবেক নেতা সইবানি খান সমরখন্দ দখল করে নেন। 

তুমি কি জানো যে, বাবর তার নিজের একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। তার নাম ছিল বাবরনামা বা তুজুক -ই -বাবরী। এটি  তুর্কি ভাষায় লেখা হয়েছিল। 

এই বইটিতে বাবর নিজেকে তাসের রাজার সাথে তুলনা করেছিলেন। কারণ তিনি বারবার হেরেছেন, আবার সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু কখনই ভয় পেয়ে যাননি। ফারগানা দখল করতে না পেরে এরপর ভারতবর্ষে তার সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকেন। 

ভারতকে জয় করতে গেলে তার একটি শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনীর দরকার ছিল। তাই উস্তাদ আলি কুলির সাহায্যে বাবর একটি গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তোলেন। 

উজবেক , আফগান এদের বিরুদ্ধে লড়ে বাবর তাদের যুদ্ধ করার কৌশল শিখে নিয়েছিলেন। সেই কৌশল তার সেনাবাহিনীতে কাজে লাগান। পারস্য দের কাছ থেকে বাবর বন্দুকের ব্যবহার শিখেছিলেন। 

জেনে রাখো বন্ধু , যুদ্ধের ময়দানে প্রথম কামানের ব্যবহার করেছিলেন বাবর। আর তিনি এর ব্যবহার শিখেছিলেন উস্তাদ আলি কুলির থেকে। 

পানিপথের যুদ্ধে বাবর :- 

সেইসময় দিল্লিতে লোদি বংশ শাসন করছিলো। লোদিশাসক ইব্রাহিম লোদি ছিলেন একজন স্বেচ্ছাচারী শাসক। তার আচরণও ছিল নিষ্ঠূর। তার এই আচরণের জন্য আমীর , ওমরাহরা তার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন। এইকারণে তারা বাবরকে ভারত আক্রমণের জন্য আহ্বান জানান। 

শোনা যায়, মেবারের রানা সঙ্গও বাবরকে ভারত আক্রমণ করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। 

এরপর বাবর আর দেরি না করে ১৫২৪ খ্রিস্টাব্দে ঝিলাম ও চেনাব নদী পার করে পাঞ্জাবে আসেন। এখানে তিনি দীপালপুর লুঠ করেন। এরপর লাহোর দখল করেন। লাহোর , দীপালপুর , শিয়ালকোটে বাবর তার বাহিনীকে মোতায়েন করে কাবুল ফিরে যান। 

কাবুলে ফিরে গেলেও ভারতের ওপর বাবরের চোখ ছিল সজাগ। 

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত পানিপথে এসে বাবর উপস্থিত হন। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। বাবরের সৈন্য সংখ্যা ৮-১০,০০০ এর বেশি ছিল না। কিন্তু অন্যদিকে ইব্রাহিম লোদির সৈন্য ছিল প্রায় ১ লক্ষ। 

জানা যায় যে, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই এপ্রিল থেকে ১৯ শে এপ্রিল পর্যন্ত এই আটদিন দুই পক্ষই একে অপরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। 

অবশেষে এলো সেই দিন। ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১শে এপ্রিল বিখ্যাত পানিপথের যুদ্ধক্ষেত্রে বাবরের সৈন্যবাহিনীর সাথে ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য বাহিনীর লড়াই শুরু হল। বাবর প্রথম তার কামান ও বন্দুকের ব্যবহার করলেন।

কিন্তু অন্যদিকে ইব্রাহিম লোদির বাহিনীর কামান বা বন্দুক কোনোটাই ছিল না। কামানের গোলার মুখে প্রাণ গেলো ইব্রাহিম লোদির সৈন্যদের। ইব্রাহিম লোদিও নিজের প্রাণ হারালেন এই যুদ্ধে। 

জেনে রাখো বন্ধু , ইব্রাহিম লোদিই একমাত্র সুলতান যিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়তে লড়তে প্রাণ হারান। এই দৃষ্টান্ত দিল্লির অন্য সুলতানদের মধ্যে নেই।  

পানিপথের যুদ্ধ জেতার পর বাবর দিল্লির দিকে এগিয়ে যান। দিল্লির জামি মসজিদে বাবরের নামে খুৎবা পাঠ করা হয়। এবং তিনি নিজেকে ভারতবর্ষের বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। 

তুমি কি জানো বন্ধু  , বাবরের ছেলে হুমায়ুন তাকে আগ্রা তে একটি দামি হিরে উপহার দেন। হুমায়ুন এই হিরেটি পেয়েছিলেন গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমজিতের কাছ থেকে। 

এই হিরে টিকেই ঐতিহাসিকরা বিখ্যাত কোহিনুর মণি বলেছেন। 

এরপর বাবর যাকে তার শত্রূ বলে মনে করেছিলেন তিনি হলেন রাজপূত নায়ক রানা সংগ্রাম সিংহ। রানা সংগ্রাম সিংহ ছিলেন এক শক্তিশালী যোদ্ধা। যুদ্ধে তিনি একটি চোখ , একটি হাত ও একটি পা হারিয়েছিলেন। 

তার দেহে প্রচুর আঘাত ছিল। কিন্তু তবুও তিনি মানসিক জোর হারাননি। 

১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে আগ্রা থেকে কিছুটা দূরে খানুয়া নামে একটি জায়গায় বাবরের সাথে রানা সংগ্রাম সিংহের যুদ্ধ হয়। বাবর এই যুদ্ধেও জয় লাভ করেন। ইতিহাসে এই যুদ্ধ খানুয়ার যুদ্ধ নামে পরিচিত। 

বাবরের ভারত বিজয়ের সৌভাগ্যের ফল তার কপালে বেশিদিন টেকেনি। ছেলে হুমায়ুন কে সম্বলের জাগির এর দায়িত্ব দিয়ে পাঠালে হুমায়ুন সেখানে অসুস্থ হন। 

হুমায়ুন কে চিকিৎসার জন্য আগ্রাতে আনা হয়। এখানেই বাবরের সাথে আবু বাকা নামে এক পীরের দেখা হয়। আবু বাকা হুমায়ূনকে সুস্থ করে দেবার কথা দেন। কিন্তু তিনি এও বলেন, এর বিনিময় বাবরকে কোনো মূল্যবান জিনিস দান করতে হবে। 

তাই বাবর নিজেকে দান করেন। তিনি প্রার্থনা করেন আল্লাহ যেন হুমায়ুনকে সুস্থ করে দেন। আর হুমায়ূনের অসুখ যেন তাকে দিয়ে দেন। কিছুদিন বাদে হুমায়ুন সুস্থ হয়ে ওঠেন। 

কিন্তু ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের মৃত্যু হয়। তাকে আগ্রার কাছে আরামবাগে সমাধিস্থ করা হয়।  

লেখাটি পড়ে তোমার কেমন লাগলো তুমি কমেন্ট করে নিশ্চয়ই জানাবে। এর থেকে আমি আরও উৎসাহ পাবো নতুন কিছু লেখার।  ভালো থেকো, আর ইতিহাস পড়তে থেকো। 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!